তারিক বিন জিয়াদ ও মুসা বিন নুসায়ের কর্তৃক স্পেন বিজয়ের ঘটনা লিখ। এ বিজয় এত সহজ হয়েছিল কেন?

Tarek

তারিক বিন জিয়াদ ও মুসা বিন নুসায়ের কর্তৃক স্পেন বিজয়ের ঘটনা লেখ। এ বিজয় এত সহজ হয়েছিল কেন?

উত্তর ভূমিকা: মুসলমানগণ কর্তৃক স্পেন বিজয় মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। মুসলিম অভিযান পূর্ব স্পেন প্রায় ৩০৩ বছর গথিক রাজাদের শাসনাধীন ছিল। শাসক গোষ্ঠীর অত্যাচারের কবলে পড়ে সার্ফ, ক্রীতদাস, ইহুদি, বর্গাদার শ্রেণির অবস্থা সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে। দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় অবস্থা চরম খারাপ পর্যায়ে পৌঁছায়। এরূপ পরিস্থিতিতে দামেস্কের উমাইয়া খলিফা আল ওয়ালিদের অনুমতিক্রমে মুসা বিন নুসাইর এবং তারিক বিন জিয়াদ স্পেনে অভিযানের প্রয়াস পান।

তারিক বিন জিয়াদ ও মুসা বিন নুসায়ের কর্তৃক স্পেন বিজয়ের ঘটনা: নিম্নে তারিক বিন জিয়াদ ও মুসা বিন নুসায়ের কর্তৃক স্পেন বিজয়ের ঘটনা বর্ণনা দেওয়া হলো-

১. প্রথম অভিযান: সিউটা ও আলজেসিরাসের গভর্নর কাউন্ট জুলিয়ান এবং উত্তর আফ্রিকার স্পেনীয় উদ্বাস্তুদের অনুরোধে মুসা বিন নুসাইর স্পেন অভিযানের নেতৃত্ব প্রদান করার জন্য দামেস্কের খলিফার নিকট অনুমতি প্রার্থনা করেন। খলিফা লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে অনুমতি মঞ্জুর করেন। ৭১০ খ্রিস্টাব্দে মুসা বিন নুসাইর, তারিক বিন জিয়াদকে চারশ পদাতিক ও একশত অশ্বারোহী বার্বার সৈনিকসহ স্পেনের দক্ষিণ উপকূল জরিপ ও প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠান। তারিক বিন জিয়াদ তার কাজ সমাধান করে স্পেনে ফিরে আসেন এবং অনুকূল রিপোর্ট প্রদান করেন।


২. দ্বিতীয় অভিযান: মুসা বিন নুসাইর ৩০০ আরব ও ৭ হাজার বাবার সৈন্যের একটি দল তাঞ্জিয়ারের শাসনকর্তা তারিক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে স্পেনে প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে সৈন্য সংখ্যা ১২ হাজার এ উন্নীত হয়। কাউন্ট জুলিয়ান কর্তৃক প্রেরিত চারটি জাহাজে করে তারা স্পেনের পাবর্ত্য অঞ্চলে অবতরণ করেন। আলজেসিরাস শহরকে ঘাঁটি হিসেবে সুরক্ষিত করে তারা পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয় এবং কারতেয়া ও লাগুন দে জান্দিয়া অধিকার করেন। স্পেনে মুসলমানদের আগমনের সময় রাজা রডারিক দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত ছিলেন। তারিক বিন জিয়াদের অভিযানের খবর পেয়ে তিনি টলেডোতে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি প্রায় ১ লক্ষ সৈন্যের একটি বাহিনী গঠন করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। ওয়াদিলাক্কোর নিকটবর্তী শারিশাতে উভয় পক্ষের যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে রাজা রডারিক শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও নিহত হয়। এ অভিযানে কর্ডোভা এবং টলেডোর পতন হয়।

৩. মুসা বিন নুসাইর ও তারিক বিন জিয়াদের যৌথ অভিযান: ৭১২ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদের অসমাপ্ত অভিযান সমাপ্ত করার উদ্দেশ্যে মুসা বিন নুসাইর ১৮ হাজার সৈন্য নিয়ে স্পেনে পদার্পণ করে। মুসা বিন নুসাইর ও তারিক বিন জিয়াদের সম্মিলিত বাহিনী এরপর আরাগোনা, সারাগোসা, বার্সিলোনা, আস্তুরিকা, লিওন, লেগিও এবং ক্যান্টাবেরিয়া দখল করে। মাত্র দুই বছরে সমগ্র স্পেনে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।


৪. মুসা বিন নুসাইর বিন নুসাইর ও তারিক বিন জিয়াদের প্রত্যাবর্তন: ৭১১ খ্রিস্টাব্দে থেকে ৭১৪ খ্রিস্টাব্দে এর মধ্যে প্রায় সমগ্র স্পেন মুসলমানদের দখলে আসে। খলিফা আল ওয়ালিদের নির্দেশে ৭১৪ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে মুসা বিন নুসাইর ও তারিক বিন জিয়াদ দামেস্কের পথে রওয়ানা হন। যাত্রার আগে মুসা বিন নুসাইর স্পেনে মুসলিম বিজয়কে সুদৃঢ় করার জন্য প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলেন। তিনি পুত্র আব্দুল আজিজকে স্পেনের গভর্নর নিযুক্ত করেন।

স্পেন বিজয় মুসলমানদের জন্য সহজ হওয়ার কারণ: মুসলিম বাহিনীর স্পেন বিজয় সহজ হওয়ার পিছনে অনেকগুলো কারণ ছিল। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো-

১. স্পেনের সামাজিক বৈষম্য: মুসলিম বাহিনীর সহজ স্পেন জয়ের পিছনে যে কয়টি কারণ ছিল তার মধ্যে অন্যতম সামাজিক বৈষম্য। মুসলমান বিজয়ের প্রাক্কালে স্পেনে শাসক ও শাসিতদের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান ছিল। স্পেনের, গথিক রাজা ছিল খ্রিস্টধর্মাবলম্বী। এ সময়ে ইহুদিদের ওপর চরম অত্যাচার ও নির্যাতন চালানো হয়। শাসকদের অমানসিক অত্যাচার ও চরম বৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থা জনগণ ও রাজার মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করে। স্পেনের সমাজে জাতিগত, ব্যক্তিগত ও সাম্প্রদায়িক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে। ফলে স্পেনীয় সমাজে অত্যাচারিত, নিগৃহীত ও উৎপীড়িত সার্ফ ও ইহুদিগণ তাদের ওপর সমস্ত নির্যাতন থেকে মুক্তির আশায় গথিক শাসনের অবসান কামনা করে এবং মুসলিম বাহিনীকে স্পেন অভিযানের আমন্ত্রণ জানায়। স্পেনের এ সামাজিক বৈষম্য মুসলমানদের বিজয়কে সহজতর করেছিল।


২. রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা: স্পেনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থা ছিল চরম অরাজকতাপূর্ণ এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থা ছিল দুর্বল। আর এ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রাদেশিক শাসকগণ প্রায় স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করতেন। অন্যদিকে, রাজা রডারিক গথ রাজা উইটিজাকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করলে উইটিজার জামাতা ও পুত্র তার পতনের জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল। এ অবস্থায় যখন মুসলমানরা স্পেন আক্রমণ করে তখন সেই আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা রাজা রডারিকের ছিল না, যা মুসলমানদের স্পেন বিজয়কে সহজ করে তোলে।

৩. অর্থনৈতিক কারণ: মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে স্পেনের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় চরম বৈষম্য সাধারণ জনগণের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। সুবিধাভোগী শ্রেণির কোনো প্রকার কর দিতে হতো না। অপরদিকে, সাধারণ জনগণের ওপর মাত্রাতিরিক্ত করের বোঝা চাপানো হয়। ফলে জনমনে চরম অসন্তোষ বিরাজ করে। ফলে তারা গথিক শাসনের অবসান কামনা করে। সুতরাং তৎকালীন স্পেনের শোচনীয় অর্থনীতিক অবস্থা মুসলমানদের বিজয়াভিযানকে সহজীকরণ করে।

৪. ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা: তৎকালীন স্পেনের শাসক শ্রেণির ধর্ম ছিল খ্রিস্টধর্ম। এ সময়ে খ্রিস্টান শাসকেরা জোরপূর্বক ইহুদিদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে। কোনো ইহুদি এর বিরোধিতা করলে তাকে নির্যাতন করা হতো। ধর্মীয় স্বাধীনতা বলতে সেখানে কিছুই ছিল না। যার ফলে স্পেনে ইহুদি সম্প্রদায় খ্রিস্টান শাসকদের পতন কামনা করে। ফলে পরবর্তীতে মুসলিম অভিযানকে স্বাগত জানায়, যা মুসলিম বিজয়কে সহজে সাফল্যের দ্বার প্রান্তে পৌছে দেয়।


৫. মুসলিম বাহিনীর দক্ষতা: মুসলিম বাহিনীর স্পেনে দ্রুত সাফল্য লাভের পিছনে অন্যতম কারণ ছিল দক্ষ সেনাবাহিনী। স্পেন বিজয়ের সময় মুসলিম বাহিনী মূলত ইসলামি আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে যুদ্ধ করেছিল। মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন মুসা বিন নুসাইর ও তারিক বিন জিয়াদ। এ দুইজন সেনাপতি ছিলেন অত্যন্ত অভিজ্ঞ এবং দক্ষ। তাদের দক্ষতার কারণে মুসলিম বাহিনী অতি দ্রুত সমগ্র স্পেনে সহজেই আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়।

৬. স্পেনীয়দের দুর্বল সেনাবাহিনী: তৎকালে স্পেনে কোনো সুশৃঙ্খল ও দক্ষ সেনাবাহিনী ছিল না। দাসদের মধ্য থেকে সেনাবাহিনীর সৈন্য সংগ্রহ করা হতো। তাদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করা হতো। তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। তারা ছিল সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত। ফলে যুদ্ধের সময় এ সেনাবাহিনী দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধ করেনি, যার ফলে মুসলমানারা অতি দ্রুত বিজয় লাভ করে।


উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মুসলমানদের স্পেন বিজয় ছিল ইসলামের ইতিহাসের একটি মোড় পরিবর্তনকারী অধ্যায়। মুসলিম অভিযানপূর্ব স্পেনের অভ্যন্তরীণ অবস্থা ছিল খুবই ভয়াবহ এবং স্পেনীয় জনগণ মুক্তির আশায় বাহ্যিক কোনো শক্তিকে স্পেনে কামনা করে যারা স্থানীয় অত্যাচারী রাজার অবসান ঘটাবে। আর এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে সাধারণ জনগণের সহযোগিতায় মুসলমানরা সহজেই স্পেন জয় করতে সমর্থ হন।

আরো পড়ুন পূর্ণাঙ্গ সাজেশন ও তার উত্তর একত্রে

স্পেনের মুসলমানদের ইতিহাস (৭১০-১৪৯২)

 

Post a Comment

Previous Post Next Post