স্পেনের মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির একটি
সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
অথবা, স্পেনের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে
মুসলমানদের অবদান মূল্যায়ন কর।
অথবা, স্পেনের মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি
সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তর ভূমিকা: ইউরোপ মহাদেশের
আইবেরীয় উপদ্বীপের গুরুত্বপূর্ণ দেশ স্পেন। পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর, পূর্বে ভূমধ্যসাগর
ও উত্তরে পিরেনিজ পর্বতমালা বেষ্টিত স্পেন রাষ্ট্রটিতে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের শুরুতে
মুসলিমদের আগমন ঘটে। সেসময় বিজয়াভিযানের মাধ্যমে মুসলিমগণ স্পেনের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত
হয়। অতঃপর প্রায় ৮০০ বছর ব্যাপী স্পেন শাসন করে তারা স্পেনকে ইউরোপের বুকে মুসলিম সভ্যতা
ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র রূপে প্রতিষ্ঠিত করে।
স্পেনের মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি: মুসলিমরা দীর্ঘকাল স্পেনকে নিজেদের শাসনাধীনে রেখে একে জ্ঞানবিজ্ঞান, শিল্প সংস্কৃতির অনন্য কেন্দ্রে পরিণত করেন। নিম্নে স্পেনে মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো-
১. জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা: মুসলিম শাসনামলে
স্পেন জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এসময় দেশ বিদেশের জ্ঞানপিপাসু
ব্যক্তিবর্গ স্পেনের বিভিন্ন জ্ঞানচর্চা কেন্দ্রে ভিড় জমাত। মুসলিম শাসিত স্পেনে চিকিৎসাশাস্ত্র,
অঙ্কশাত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, ইতিহাস, দর্শন, আইনশাস্ত্র ইত্যাদি শিক্ষা
দেওয়া হতো। মুসলিম স্পেনে জ্ঞানচর্চার স্বরূপ তুলে ধরতে গিয়ে ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন,
"শিল্পকলা, সাহিত্য ও বিজ্ঞান যেভাবে উৎকর্ষতা লাভ করেছিল তা ইউরোপের অন্য কোথাও
পরিলক্ষিত হয়নি।"
২. ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধন: মুসলিম শাসিত
স্পেনে ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপক উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা ও
মুসলিমদের জ্ঞানপিপাসার ফলে এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এসময় আরবি ভাষার পাশাপাশি
অন্যান্য ভাষারও ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল। ভাষাতত্ত্ববিদ আলি আবু আল কালি, আল যুবাইদি,
সাহিত্যিক ইবনে আবদি রাব্বিহি প্রমুখ ব্যক্তি স্পেনে ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে ব্যাপক
ভূমিকা পালন করেন।
৩. কাব্যচর্চা: ইসলামের প্রাণকেন্দ্র আরব ভূমিতে সুপ্রাচীন কাল থেকে কাব্যচর্চার প্রচলন ছিল। ইসলামের আবির্ভাবের পর মুসলিমদের মধ্যেও কাব্যচর্চার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মুসলিমগণ বিজয়াভিযানের মাধ্যমে যেসব স্থানে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন সেসব স্থানেও তারা কাব্যচর্চার ধারা অব্যাহত রাখেন। স্পেনের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। স্পেনের উল্লেখযোগ্য কবি ছিলেন ইবনে হাজম, ইবনুল খতিব, ইবনে আবদ প্রমুখ'।
৪. শিল্পের বিকাশ সাধন: স্পেনে মুসলিমদের
সুদীর্ঘ শাসনামলে বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ সাধিত হয়েছিল। যথা:
ক. মৃৎশিল্প: স্পেনে মুসলিম
শাসনামলেই সর্বপ্রথম মৃৎশিল্পের বিকাশ সাধিত হয়। মুসলিম শামনামলের গোড়ার দিকে স্পেনে
মৃৎশিল্পের তেমন উন্নয়ন লক্ষ করা না গেলেও খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতক থেকে স্পেনে ব্যাপকভাবে
মৃৎপাত্রের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এসময় মালাগা, মুর্সিয়া, ভ্যালেন্সিয়া প্রভৃতি অঞ্চল
মৃৎশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধি অর্জন করে। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক P. K. Hitti বলেন,
"ধাতব শিল্পে এনামেলের বিশিষ্ট প্রয়োগ না থাকলেও মৃৎপাত্রে মিনার কাজ খুবই আকর্ষণীয়
ছিল।"
খ. কাগজ শিল্প: স্পেনে জ্ঞানচর্চার প্রসার ঘটায় কাগজ শিল্পের বিকাশ সাধিত হয়েছিল। মুসলিমদের মাধ্যমেই স্পেন তথা ইউরোপে প্রথম কাগজের উৎপাদন শুরু হয়। এসময় কর্ডোভা ছিল কাগজ উৎপাদনের প্রধান কারখানা। কর্ডোভাকে কেন্দ্র করে কাগজ শিল্প স্পেনের সীমানা ছাড়িয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রধানত তুলা থেকে মুসলিম স্পেনে কাগজ উৎপাদন করা হতো। মুসলিমদের এ শিল্প ইউরোপে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়।
গ. বয়ন শিল্প: মানব সভ্যতা
বিকাশের সাথে সাথে পৃথিবীতে, বয়ন শিল্পের বিকাশ সাধিত হয়েছে। উন্নত সভ্যতার ধারক ও
বাহক হিসেবে মুসলিমগণ স্পেনে বয়ন শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটান। প্রধানত লিনেন ও কার্পাস
জাতীয় বস্ত্র বুননের জন্য মুসলিম স্পেন খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেছিল। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক
এস. পি. স্কট বলেন, "লিলেন এবং কার্পাস জাতীয় পোশাক সম্বন্ধে তাদের যথেষ্ট জ্ঞান
ছিল।"
৫. চর্ম শিল্প: মুসলিম স্পেনে চর্ম শিল্পের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছিল। স্পেনের মুসলিমরা কাঁচা চামড়াকে ট্যানিং করে ব্যবহারের উত্তম পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তারা চামড়ার যথার্থ ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের পাত্র তৈরি করতেন। চামড়ার তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্রে তারা বিভিন্ন ধরনের কারুকাজ করে চর্ম শিল্পে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছিলেন। স্প্যানিশ মুসলিমগণ চর্ম শিল্পে অত্যন্ত উন্নত ছিলেন বলে ইতিহাস পাঠে অবগত হওয়া যায়।
৬. অন্যান্য শিল্প: মুসলিম স্পেনে
হস্তলিপি শিল্প, লোকজ শিল্প, পুস্তক বাঁধাই শিল্প, কালি প্রস্তুত শিল্প, হাতির দাঁতের
খোদাই শিল্প, স্থাপত্য শিল্প ইত্যাদিরও বিকাশ সাধিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক মুসলিম স্পেনের
এসব শিল্পের গুণগত মানের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
৭. সংগীতের উৎকর্ষ সাধন: মুসলিম স্পেনের
বহু স্বনামধন্য সংগীতশিল্পী সংগীত জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। মুসলিম শাসিত স্পেনে বিভিন্ন
শাসকের আমলে সংগীতের ব্যাপক চর্চা পরিলক্ষিত হয়। স্পেনীয় মুসলিম শাসক দ্বিতীয় আব্দুর
রহমান বিখ্যাত সংগীত শিল্পী জিরাব দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে ইতিহাসে
উল্লেখ রয়েছে। মুসলিম স্পেনের সংগীতের বিবরণ দিতে গিয়ে ঐতিহাসিক P. K. Hitti বলেন,
"জিরাব এবং ইবনে ফিরনাস কর্তৃক প্রবর্তিত সংগীতের সূত্র এবং প্রয়োগগুলো পারস্য
আরব এবং এই পদ্ধতি ধীরে ধীরে গ্রিক ও পিথাগোরীয় সূত্রে রূপান্তরিত হয়।
৮. গৃহসজ্জা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: ইউরোপীয় জনগণ যখন অসভ্য ও বর্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল স্পেনের মুসলিমগণ তখন স্পেনকে অপরূপ সাজে সজ্জিত করে তুলেছিলেন। মুসলিম স্পেনের গ্রানাডা নগরী, কর্ডোভা নগরী, আল জোহরা, আল জাহিরা ও আল হামরা প্রাসাদ মুসলিম স্পেনের গৃহসজ্জার অনন্যতার ক্ষেত্রে কালের সাক্ষী হিসেবে এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
জার্মানির এলবে এবং হারবার নদী সহ হামবুর্গ শহর |
৯. কৃষি ও ব্যবসায় বাণিজ্য: মুসলিম শাসিত
স্পেনে কৃষি ও ব্যবসায় বাণিজ্যের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছিল। কৃষিক্ষেত্রে নব নব পদ্ধতির
প্রয়োগ ও বাণিজ্যিক কর্মকান্ডের পরিধি সম্প্রসারিত করার ফলে মুসলিম শাসনামলে স্পেনের
কৃষি ও বাণিজ্যির বিকাশ ঘটেছিল। মুসলিম শাসিত স্পেনের কৃষি বাণিজ্যিক উন্নয়নকে ঐতিহাসিকগণ
অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বর্ণনা করেছেন।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার
পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, স্পেন তথা সমগ্র ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী যখন অজ্ঞতা ও অপসংস্কৃতির
ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত মুসলিম শাসকগণ তখন উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রদীপ নিয়ে স্পেনের
ভূমিতে আবির্ভূত হন। তাদের সংস্পর্শে স্পেনসহ সমগ্র ইউরোপের জনগণ নিজেদের উন্নত সভ্যতা
সংস্কৃতির যোগ্য উত্তরসূরিতে পরিণত করে। যার ধারা আজও ইউরোপের বুকে অব্যাহত রয়েছে।
তাইতো ঐতিহাসিক P. K. Hitti বলেন, "মধ্যযুগীয় ইউরোপের বুদ্ধিবৃত্তির ইতিহাসে স্পেন
একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে।"
আরো পড়ুন পূর্ণাঙ্গ সাজেশন ও তার উত্তর একত্রে
স্পেনের মুসলমানদের ইতিহাস (৭১০-১৪৯২)