স্পেনের স্থাপত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে
মুসলমানদের অবদান মূল্যায়ন কর।
অথবা, স্পেনের স্থাপত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞানের
ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান আলোচনা কর।
উত্তর ভূমিকা: প্রাচীন যুগে
পাশ্চাত্য সমাজে জ্ঞানচর্চার ব্যাপক প্রচলন থাকলেও মধ্যযুগে তারা তাদের জ্ঞানচর্চার
ঐতিহ্য হারিয়ে অজ্ঞতার ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। এমতাবস্থায় মুসলিমগণ স্পেনকে কেন্দ্র
করে সমগ্র ইউরোপে জ্ঞানের আলো প্রজ্বলিত করে ইউরোপকে রেনেসাঁর দিকে এগিয়ে দিতে সহায়তা
করে।
ঐতিহাসিক P. K. Hitti বলেন, "মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় বৃদ্ধিবৃত্তির ইতিহাসে স্পেন একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে।" মুসলিমগণ জ্ঞানবিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য ইত্যাদি উন্নয়নের পাশাপাশি স্থাপত্য শিল্পের উন্নয়নের জন্যও কাজ করেন। তাদের শাসনামলে স্পেনে অনিন্দ্যসুন্দর বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মিত হয়।
স্পেনের স্থাপত্য ক্ষেত্রে মুসলমানদের
অবদান নিয়ে স্পেনের স্থাপত্য ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান আলোচনা করা হলো-
১. কর্ডোভা মসজিদ: স্পেনের মুসলিম
শাসনামলের গোড়ার দিকেই কর্ডোভা মসজিদ নির্মিত হয়। মসজিদটি মূলত সেন্ট ভিনসেন্ট নামক
গির্জার স্থলে নির্মিত। প্রথমদিকে এ গির্জার অর্ধেক ক্রয় করে মুসলিমগণ সেখানে নামাজ
আদায় করতেন। পরবর্তীতে প্রথম আব্দুর রহমান সম্পূর্ণ গির্জাটি ক্রয় করে তাকে মসজিদে
রূপান্তরিত করেন।
২. স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য: কর্ডোভা মসজিদটি প্রাচ্য তথা মেসোপটেমীয় এবং পাশ্চাত্য তথা রোমীয় বাইজান্টাইন সিরীয় উপাদানের সংমিশ্রণে নির্মিত। মসজিদটি বিশাল আয়তাকার এলাকা জুড়ে অবস্থিত। এটি উত্তর-দক্ষিণে ৫৮৫ ফুট ও পূর্ব- পশ্চিমে ৪১০ ফুট বিস্তৃত। মসজিদটিতে অশ্বনালাকৃতির খিলান ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদের তিনদিকে রিওয়াকা, উত্তর-পূর্ব ও পশ্চিম দিকে দুটি করে মোট ছয়টি প্রবেশ পথ রয়েছে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে এ মসজিদের ভিতর একটি গির্জা নির্মিত হয়।
৩. সেভিল জামে মসজিদ: মুওয়াহিদুনদের
শাসনামলে সেভিল জামে মসজিদ নির্মিত হয়। এটি খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর এক অপূর্ব স্থাপত্যিক
নিদর্শন। সেভিলে প্রতিষ্ঠিত এ মসজিদটি দৈর্ঘ্যে ৪৯২ ফুট এবং প্রস্থে ১২০ ফুট। কায়রোওয়ান
জামে মসজিদের ভূমি নকশার অনুকরণে নির্মিত এ মসজিদটিতে কেবলার দিকে সম্প্রসারিতভাবে
১৭টি লাইন ছিল। এ মসজিদের সাথেই বিখ্যাত জিরাল্ডা নির্মিত হয়েছিল। সেভিল দখলের পর খ্রিস্টানগণ
এ মসজিদটি ধ্বংস করে সেখানে গির্জা নির্মাণ করে।
৪. টলেডোর জামে মসজিদ: টলেডোর জামে
মসজিদটি মারদুনের মসজিদ নামেও পরিচিত। এটি ৯৯০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়। এটি চতুষ্কোণাকার
একটি ক্ষুদ্র মসজিদ। এ মসজিদটিকেও পরবর্তীতে খ্রিস্টানগণ গির্জায় পরিণত করে।
৫. আল জাফরিয়া প্রাসাদ: আল জাফরিয়া প্রাসাদ সারাগোসা শহরে নির্মিত এক অতুলনীয় স্থাপত্যিক নিদর্শন। এটি একাদশ শতকে ইবনে জাফর আল মুকতাদির কর্তৃক নির্মিত হয়। এর সৌন্দর্যের কারণে জগৎবাসী আজও একে বিশেষভাবে স্মরণ করে। ৬. আল হামরা প্রাসাদ: স্পেনের মুসলিমদের জাগতিক স্থাপত্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য হলো গ্রানাডার আল হামরা প্রাসাদ। নাসিরি বংশের শাসনামলে এ প্রাসাদটি নির্মিত হয়। এ প্রাসাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনের ইতিহাস গ্রন্থে বলা হয়েছে, "স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য এবং অলংকারিক চাতুর্য ও বৈপরীত্যে। স্পেনে মুর তথা মুসলিম শিল্পকলার উজ্জ্বল ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী নিদর্শন হচ্ছে আল হামরা।"
স্পেনের জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলমানদের
অবদান নিয়ে স্পেনের জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান আলোচনা করা হলো-
১. দর্শনশাস্ত্র: মুসলিমদের নিকট
থেকে ইউরোপীয়গণ যেসব বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতো তন্মধ্যে দর্শনশাস্ত্র ছিল অন্যতম। মুসলিম
শাসিত স্পেনে মুসলিম দর্শন, গ্রিক দর্শন ইত্যাদির ব্যাপক চর্চা হতো, ইবনে বাজা, ইবনে
তোফায়েল, ইবনে রুশদ, ইবনে মায়মুন, ইবনুল আরাবি প্রমুখ খ্যাতনামা দার্শনিকগণ ইউরোপীয়দের
মধ্যে দর্শনশাস্ত্রের জ্ঞান বিস্তারে ব্যাপক অবদান রেখেছিলেন।
২. জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ফলিত জ্যোতির্বিজ্ঞান: জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ফলিত জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে ইউরোপীয়গণ মুসলিমদের নিকট থেকে ব্যাপক জ্ঞানলাভ করেছিলেন। মুসলিম শাসিত স্পেনে জগদ্বিখ্যাত জ্যোতির্বিদদের আবির্ভাব ঘটেছিল। যারা প্রাচ্যদেশীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের জ্ঞানকে ইউরোপে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আল মাজরিতি, আল জারকারি, ইবনে আফলা, আল বিতরুজি, এডিলাইড প্রমুখ স্পেনীয় জ্যোতির্বিদ ও ফলিত জ্যোতির্বিদগণ ইউরোপে জ্ঞান সম্প্রসারণে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।
৩. ইতিহাস চর্চা: ইতিহাস চর্চায়
মুসলিমদের খ্যাতি জগৎজোড়া। মহানবি (সা.) এর জীবদ্দশাতেই মুসলিমদের মধ্যে ইতিহাস চর্চা
শুরু হয়। পরবর্তীতে মুসলিমদের মধ্যে ইতিহাস চর্চার ব্যাপকতা দেখা দেয় এবং মুসলিমগণ
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইতিহাসের জ্ঞান ছড়িয়ে দেন। মুসলিম শাসিত স্পেনে আল কুতিয়া,
ইবনে খালাফ, ইবনে বাসকুয়াল, আল তুলাইতুলি, ইবনুস খতিব, ইবনে খালদুনের মতো জগদ্বিখ্যাত
ঐতিহাসিকগণ আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তাদের মাধ্যমে ইউরোপে প্রাচ্যের ইতিহাসের জ্ঞান বিস্তৃত
হয়েছিল।
৪. উদ্ভিদবিদ্যা: উদ্ভিদবিদ্যায় মুসলিমগণ ব্যাপক পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। এক্ষেত্রে স্পেনের মুসলমানদের পারদর্শিতা ছিল অসামান্য। ঐতিহাসিক P. K. Hitti বলেন, "সাধারণ এবং ফলিত উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্পেনের মুসলিমগণ তাদের গবেষণা উদ্ভাবনের স্বাক্ষর রেখে গেছেন।" স্পেনের মুসলিম উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে উদ্ভিদবিজ্ঞানের জ্ঞান সম্প্রসারিত হয়েছিল।
৫. গণিতশাস্ত্র: গণিতশাস্ত্রের
উন্নয়নে স্প্যানিশ মুসলিমদের অবদান অনস্বীকার্য। মুসলিমগণ গণিতশাস্ত্রের বিভিন্ন শাখায়
পদচারণা করেছিলেন। ইউরোপে গণনার চাতুর্য ও কৌশল প্রবর্তনের ক্ষেত্রে মুসলিম স্পেনের
খ্যাতনামা গণিতবিদগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
৬. চিকিৎসাশাস্ত্র: চিকিৎসাশাস্ত্র
সম্পর্কে স্পেনীয় মুসলিমদের জ্ঞান ছিল সমকালীন বিশ্বের মধ্যে অতুলনীয়। আল জাহরাবি,
ইবনে জুবুর, ইবনে বুশদ, ইবনুল হায়সাম প্রমুখ চিকিৎসাবিদ চিকিৎসাশাস্ত্রের জ্ঞান অকৃপণভাবে
বিতরণ করেছিলেন। ইউরোপীয়গণ তাদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে চিকিৎসা বিষয়ে ব্যাপক ব্যুৎপত্তি
লাভ করেছিল।
৭. রসায়নশাস্ত্র: মুসলিম পণ্ডিতগণ ইউরোপীয়দের মধ্যে রসায়নশাস্ত্রের জ্ঞানের বিস্তৃতি ঘটিয়েছিলেন। দ্বাদশ শতাব্দীতে মুসলিমদের মাধ্যমে রসায়নশাস্ত্রের জ্ঞান ইউরোপে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে তা সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।
৮. ভূগোল: ইউরোপীয়গণ স্পেনীয়
মুসলিমদের নিকট থেকে ভূগোলবিষয়ক জ্ঞানলাভ করেছিল। মুসলিম স্পেনে আল বাকরি, আল ইদ্রিসি,
ইবনে যুবাইর প্রমুখ বিখ্যাত ভূগোলবিদের আবির্ভাব ঘটেছিল। তারা ইউরোপবাসীকে ভূগোলের
জ্ঞানে জ্ঞানান্বিত করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার
পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, স্পেনে মুসলিমগণ শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে প্রচলিত কুসংস্কারের
মূলে কুঠারাঘাত করে সমগ্র স্পেনে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালান। স্থাপত্যশিল্পের
উন্নয়ন ও বিকাশে স্পেনীয় মুসলমানদের অবদান অনস্বীকার্য। মুসলিম শাসিত স্পেনে ধর্মীয়
ও স্বাগতিক বহু স্থাপনা নির্মিত হয়েছিল যা জগৎবাসীকে আজও অবাক করে দেয়। স্থাপত্য ক্ষেত্রে
তাদের অবদানকে তাই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়।
আরো পড়ুন পূর্ণাঙ্গ সাজেশন ও তার উত্তর
একত্রে
স্পেনের মুসলমানদের ইতিহাস (৭১০-১৪৯২)