আমির দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের ওপর চার ব্যক্তির
প্রভাব পর্যালোচনা কর।
অথবা, কীভাবে ফকিহ ইয়াহইয়া বিন ইয়াহইয়া এবং সঙ্গীতজ্ঞ জিরাব দ্বারা দ্বিতীয় আব্দুর রহমান প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন তা ব্যাখ্যা কর।
উত্তর ভূমিকা: ৮২২ খ্রিস্টাব্দে
স্পেনের স্বাধীন উমাইয়া আমিরাতের তৃতীয় শাসক প্রথম হাকাম মৃত্যুবরণ করলে তার পুত্র
দ্বিতীয় আব্দুর রহমান কর্ডোভার সিংহাসনে আরোহণ করেন। আমির দ্বিতীয় আব্দুর রহমান শিল্প
ও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। তিনি সর্বদা, জ্ঞানীগুণী, শিল্পী, কবি ও সংগীতজ্ঞ,
দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতে ভালোবাসতেন। তার শাসনামলে তিনি চারজন প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ
দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। এ বিশিষ্ট ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ছিলেন ধর্মবেত্তা
ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়া, প্রতিভাধর সংগীতজ্ঞ জিরাব, প্রভাবশালী খোজা নসর এবং বিদুষী সম্রাজ্ঞী
সুলতানা তারুব।
আমির দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের ওপর চার ব্যক্তির প্রভাব: নিম্নে আমির দ্বিতীয় আব্দুর রহমান তার শাসনামলে যে চারজন ব্যক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১. ধর্মবেত্তা ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়া: মুসলিম স্পেনে
মালেকি মাজহাব প্রবর্তনের মূলে প্রভাবশালী ফকিহ বা ধর্মবেত্তা ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়ার
অবদান ছিল অপরিসীম। আমির প্রথম হিশামের রাজতকালে মালেকি মাজহাব রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা
লাভ করে এবং বাষ্ট্রীয় ধর্মমতের মর্যাদা পায়। ফিকহ সম্বন্ধে ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়ার অন্তর্দৃষ্টি
ও ব্যুৎপত্তি জ্ঞানের জন্য তার ওস্তাদ ইমাম মালেক তাকে স্পেনের সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী
ব্যক্তি উপাধি দেন। ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়া মাসমুদা গোত্রের বার্বার ছিলেন এবং স্বীয় নিষ্ঠা
ও বুদ্ধিবৃত্তির বলে স্পেনে প্রভাবশালী ফকিহ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের ওপর ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়ার প্রভাব: দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের শাসনামলে ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়ার প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায় কারণ প্রথম হিশামের মতো তিনি ফকিহদের সমাদর করতেন এবং রাষ্ট্রীয় কার্যে তাদের মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় এখানে মালেকি ধর্মমত সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। স্পেনে এ মাজহাবের প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়ার অবদান অনস্বীকার্য। দ্বিতীয় আব্দুর রহমান তার পান্ডিত্যের যথার্থ স্বীকৃতি দেন এবং বিচারকার্যের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য তার পরামর্শ গ্রহণ করতেন। এভাবে শাস্ত্রজ্ঞ ও ফকিহ ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়া আব্দুর রহমানের ওপর অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হন।
২. সংগীতজ্ঞ জিরাব: দ্বিতীয় আব্দুর
রহমানের রাজত্বকালে অপর যে ব্যক্তি সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করেন তিনি হচ্ছেন প্রখ্যাত
সংগীতজ্ঞ আবুল হাসান আলি বিন নাফি ওরফে জিরাব। ঐতিহাসিক P. K. Hitti এর ভাষায়,
"তিনি (আব্বাসি খলিফা) হারুন অর 'রশিদ ও তার পুত্রদের দরবারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ
সংগীত বিশারদই ছিলেন না; বরং একাধারে শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের অনুরাগী ছিলেন।"
বাগদাদে জিরাব প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ ও গায়ক ইসহাক আল মাউসিলির নিকট সংগীতচর্চা করেন। ক্রমশ
জিরাব স্বীয় পারদর্শিতা ও শৈল্পিক গুণাবলিতে তার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ইসহাক আল মাউসিলিরকে,
অতিক্রম করার প্রয়াস পান। ফলে গুরু ও শিষ্যের মধ্যে মনোমালিন্য বাধে। এ অসহনীয় অবস্থা
থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য জিরাব বাগদাদ থেকে ভাগ্যান্বেষণে উত্তর আফ্রিকায় যান। ৮২১
খ্রিস্টাব্দে তিনি উত্তর আফ্রিকা থেকে স্পেনে আগমন করেন।
দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের ওপর জিরাবের প্রভাব: স্পেনের আমির প্রথম হাকাম মৃত্যুবরণ করলে তার স্থলাভিষিক্ত হন পুত্র দ্বিতীয় আব্দুর রহমান। কথিত আছে যে সংগীতজ্ঞ হিসেবে জিরাবের খ্যাতি ও প্রভাব এরূপ ছিল যে, তার আগমনের বার্তা পেয়ে আমির স্বয়ং অশ্বারোহণে নগর প্রান্তে গিয়ে তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান। দ্বিতীয় আব্দুর রহমান জিরাবের জন্য বাৎসরিক ২৪ হাজার দিনার বেতন বরাদ্দ করেন এবং তাকে কর্ডোভায় ৪০ হাজার দিনার মূল্যের এক প্রাসাদতুল্য বাসস্থান প্রদান করা হয়। দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের দরবার আব্বাসি খলিফা হারুন অর রশিদের দরবারের মতো জ্ঞানীগুণী, কবি, সাহিত্যিক ও সংগীতজ্ঞ দ্বারা অলংকৃত থাকত। সুমিষ্ট কণ্ঠ, ছন্দায়িত সুর সঙ্গীতে পারদর্শী জিরাব অতি অল্প সময়ে দ্বিতীয়, আব্দুর রহমানের দরবারে একজন প্রভাশালী অমাত্য হয়ে পড়েন। তিনি মূলত স্পেনে আরব সংগীতের একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং সংগীতচর্চার একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধারা প্রবর্তন করেন। তিনি সংগীত জগতের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। তিনি বিভিন্ন সুর উদ্ভাবন ও বাদ্যযন্ত্র আবিষ্কার করেন। দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের রাজত্বে জিরাব সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশিষ্ট অবদান রাখেন।
৩. খোজা নসর : দ্বিতীয় আব্দুর
রহমানের দরবারে তৃতীয় যে ব্যক্তি অসামান্য প্রভাব বিস্তার করেন তিনি হলেন মূক অনারব
একজন ভৃত্য। তিনি ছিলেন খোজা এবং হাজিবের দায়িত্ব পালন করতেন। স্বীয় ব্যুৎপত্তি, অসামান্য
মেধা ও পারদর্শিতার ফলে সামান্য অবস্থা হতে তিনি রাজ্যের প্রধান সচিবের পদ লাভ করেন।
শাসনকার্যে তিনি অপরিসীম দক্ষতার পরিচয় দেন।
দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের ওপর খোজা নসরের প্রভাব: আমির দ্বিতীয় আব্দুর রহমান খোজা নসরের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন এবং তার ওপর শাসনভার অর্পণ করে সংগীতের আসরে জিরাবের সঙ্গে বেশিরভাগ সময় চিত্তবিনোদন করতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি প্রভাবশালী সুলতানা তারুবের প্ররোচনায় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। সুলতানা তারুব খোজা নসরকে দিয়ে ভাবী উত্তরাধিকারী আমিরজাদা মুহম্মদকে বিষপ্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করেন। মুহম্মদের পরিবর্তে স্বীয় পুত্র আব্দুল্লাহকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনয়নের জন্য সুলতানা তারুব যে ষড়যন্ত্র করেন তা ফাঁস হয়ে পড়লে ৮৫০ খ্রিস্টাব্দে নসরকে আমিরের নির্দেশে নিজ হাতে তৈরী বিষ নিজেরই খেতে হয়।
৪. সুলতানা তারুব: দ্বিতীয় অব্দুর
রহমানের স্ত্রী সুলতানা তারুব ছিলেন পরমাসুন্দরী। তার রূপ. ও যৌবনের তুলনা ছিল না।
একাধারে তিনি ছিলেন বিদুষী, সৌখিন, ষড়যন্ত্রকারী, চতুর ও উচ্চাভিলাষী। ধনসম্পদের প্রতি
তার অসাধারণ মোহ ছিল। অলংকারের প্রতি তার অসামান্য দুর্বলতা ছিল। বিশেষ করে স্বর্ণলংকারের
প্রতি। তিনি ১০ হাজার দিনার মূল্যের একটি গলার হার ব্যবহার করতেন।
দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের ওপর সুলতানা তারুবের প্রভাব: আমির দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের আরও তিনটি মদিনাবাসী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সুলতানা তারুবের প্রভাব ছিল সীমাহীন। তিনি খোজা নসরের সঙ্গে মিলে শাহজাদা মুহম্মদের স্থলে স্বীয় পুত্র আব্দুল্লাহকে সিংহাসনে উত্তরাধিকারী মনোনয়নের জন্য ষড়যন্ত্র করেন। কিন্তু এ ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে পড়লে খোজা নসরকে আমিরের নির্দেশে নিজ হাতে তৈরি বিষ নিজেরই খেতে হয়। ফলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তখন থেকে তার প্রভাব কমতে শুরু করে। সুলতানা তারুব খুবই বিচক্ষণ, বুদ্ধিমতী ও উচ্চাভিলাষী মহিলা ছিলেন। এ বিদ্সী তার রাজকীয় স্বামীর ওপর অসামান্য প্রভাব বিস্তার করেন।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার
পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, স্পেনে উমাইয়া আমিরাতের ইতিহাসে দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের
শাসনামল একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। তার শাসনামলে উপরোল্লিখিত চার ব্যক্তি রাজকার্য পরিচালনা,
ধর্মীয় অনুশাসন প্রচলন, শিল্পকলার সম্প্রসারণ ও বিলাসব্যসনে বিশেষ অবদান রাখেন। দ্বিতীয়
আব্দুর রহমান গুণীজনদের যথেষ্ট সমাদর করতেন। তিনি ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়ার মাধ্যমে স্পেনে
মালেকি মাজহাব এবং জিরাবের মাধ্যমে সংগীত বিদ্যা বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। খোজা নসরের
অদূরদর্শী পরিকল্পনা ও সুলতানা তারুবের অযাচিত আচরণ তার পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল।
আরো পড়ুন পূর্ণাঙ্গ সাজেশন ও তার উত্তর একত্রে
স্পেনের মুসলমানদের ইতিহাস (৭১০-১৪৯২)