উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।

উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।

 ফাতেমিদের পরিচয় দাও।  উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমি খিলাফত প্রতিষ্ঠার ইতিহাস আলোচনা কর।

অথবা, উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমি খিলাফত প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট আলোচনা কর।

অথবা, উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

উত্তর ভূমিকা: ৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ওবায়দুল্লাহ আল মাহদি কর্তৃক তিউনিসিয়ায় ফাতেমি বংশ প্রতিষ্ঠা ছিল মধ্যযুগে, মুসলিম ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মিসরে ফাতেমি বংশের শাসকগণ ছিলেন শিয়ামতাবলম্বী। তারা ইসমাইলীয় মতবাদের প্রচারক বেশে উত্তর আফ্রিকায় প্রবেশ করেন এবং অজ্ঞ বার্বারদের প্ররোচিত করে তাদের সাহায্যে সুদূর আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল থেকে আরম্ভ করে মিসরসহ সিরিয়া ও জেরুজালেম অবধি ভূভাগের ওপর রণকৌশল ও সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার করেন। ফাতেমিগণ ৯০৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাদের রাজত্ব পরিচালনা করেন।


ফাতেমিদের পরিচয়: শিয়াগণ প্রধানত দুটি দলে বিভক্ত। একদল সপ্তম ইমামে বিশ্বাসী, যাদেরকে 'আস সাবিয়া' 'বলে। অন্যদল দ্বাদশ ইমামে বিশ্বাসী যাদেরকে 'ইসনা আশারিয়া' বলা হয়। ইমাম জাফর আস সাদিক পর্যন্ত শিয়াদের মধ্যে কোনো বিভক্তি দেখা যায় নি। জাফর আস সাদিক মৃত্যুর পূর্বে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাইলকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। কিন্তু ইসমাইল পিতার মৃত্যুর পূর্বেই মৃত্যুবরণ করলে তিনি তার পরবর্তী পুত্র মুসা আল কাজিমকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। এ মনোনয়ন শিয়াদের অধিকাংশ মেনে নিলেও একদল ইসমাইলের অনুসারী তা মেনে নেয়নি। তারা ইসমাইলের পুত্র মুহম্মদকে, ইমাম বলে গ্রহণ করে। এদেরকেই ইসমাইলীয় বলা হয়। আর ফাতেমিগণ এ শাখারই অন্তর্ভুক্ত। উমাইয়াদের বিরুদ্ধে আব্বাসিদের খিলাফত প্রতিষ্ঠায় শিয়াদের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। কিন্তু আব্বাসিরা ক্ষমতায় এলেও শিয়াদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। তাই তারা আব্বাসিদের বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে। তখন আব্বাসিদের হাতে নির্যাতিত হয়ে ইসমাইলীয় শাখার একটি দল উত্তর আফ্রিকায় গমন করে এবং সেখানে শিয়া মতবাদ প্রচার করতে থাকে। একপর্যায়ে তারা সেখানে শক্তি সামর্থ্য অর্জন করে এবং ওবায়দুল্লাহ আল মাহদি নামক জনৈক ব্যক্তি উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়ায় ফাতেমি খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেন। ওবায়দুল্লাহ আল মাহদি নিজেকে রাসুল (সা.) এর কন্যা হযরত ফাতেমা (রা.)-এর বংশধর দাবি করে এ খিলাফত প্রতিষ্ঠা করায় একে ফাতেমি খিলাফত বলা হয়।


উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমি খিলাফত প্রতিষ্ঠার ইতিহাস: নিম্নে উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমি শাসন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-

১. ইসমাইলীয় সংগঠনের প্রেরণা: ইসমাইলীয় মতবাদের প্রধান ছিলেন আব্দুল্লাহ বিন মায়মুন। তিনি ইসমাইলীয় শিয়াদের সংগঠিত করেন। তার প্রচারকার্যের মূল উদ্দেশ্য ছিল আব্বাসি খিলাফতকে ধ্বংস করে ফাতেমিদের প্রাধান্য ও প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ইসমাইলীয় মতবাদ প্রচারকল্পে তিনি মুসলিম সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে দূত প্রেরণ করেন। তার চেস্টায় বার্বার ও কাতামা গোত্রের মধ্যে ইসমাইলীয় মতবাদ প্রচারিত হয়। কিন্তু ৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে আব্দুল্লাহ বিন মায়মুনের মৃত্যুর পর দলের প্রচারণার দায়িত্ব নেন পুত্র আহমদ। তিনি ৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইবনে হাউসাব নামক একজন দূতকে কুফা হতে ইয়ামেনে প্রেরণ করেন এবং তিনি তথায় কৃতকার্য হন। ইবনে হাউসাব আবার দুজন ব্যক্তিকে প্রচারকার্যে পাঠান। তারা কাতামা নামক বার্বার গোত্রের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন।


২. আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ি: আবু আব্দুল্লাহ নামক একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি ইবনে হাউসাবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ফাতেমি মতবাদ প্রচারণার জন্য আফ্রিকায় প্রেরিত হন। তিনিই পরবর্তীতে আশ শিয়ি নামে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী ও বিশ্বস্ত শিয়া মতবাদ প্রচারক।'

৩. ইমাম মাহদির আগমন ঘোষণা: আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ি হজ মৌসুমে মক্কায় গমন করেন এবং কাতামা গোত্রের হজযাত্রীদের সাথে শিক্ষকের ছদ্মবেশে ৯০০ খ্রিস্টাব্দে ইফ্রিকিয়ায় পৌঁছেন। তিনি গোপন প্রচারণা চালিয়ে কাতামা গোত্রকে আব্বাসি শাসনের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেন। তিনি প্রচারণা চালান যে, নির্যাতিত জনগণের মুক্তির জন্য আলজিরা উপত্যকায় ইমাম মাহদি আগমন করবেন এবং তাদের সমর্থনে স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠিত করবেন। আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ি ইমাম মাহদির নানারকম অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে কাতামা গোত্রকে ধারণা দেন। অসভ্য বার্বারগণ তার বিবরণ বিশ্বাস করলেও অনেকে তাকে বিশ্বাস করেননি। কেবল কাতামা গোত্র ও তাদের গোত্রপতি হাসান বিন হারুন তার প্রতি বিশ্বাস রাখেন। অতঃপর আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ি তাবুত শহর দখল করে সামনের দিকে অগ্রসর হলে ইব্রাহিম বিন আগলাবের পুত্রের সাথে তার সংঘর্ষ বাধে। পরর্বতীতে তিনি ঘোষণা করেন যে, ইমাম মাহদির আগমনের সময় অত্যাসন্ন।


৪. সাঈদের গ্রেপ্তার: আব্বাসি খলিফা আল মুকতাদির তার গুপ্তচরের মাধ্যমে ফাতেমিদের নেতা সাঈদের উত্তর আফ্রিকায় গমন সংবাদ জেনে যান। খলিফার নির্দেশে সিজিলমাসার শাসনকর্তা ইয়াসা সাঈদ ও তার সফরসঙ্গীদের গ্রেপ্তার করে সেখানে বন্দি করে রাখেন।

৫. সাঈদের মুক্তি ও ফাতেমি খিলাফত প্রতিষ্ঠা: আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ি সিজিলমাসায় আগমন করে তাদের মুক্ত করেন। সাঈদ অনুচরবর্গসহ আগলাবি রাজধানী রাক্কায় পৌঁছালে আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ি সেখানে তাকে স্বাগত জানান এবং মাহদি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। পরে তিনি তাকে 'ওবায়দুল্লাহ আল মাহদি' উপাধি দিয়ে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করেন। ইসমাইলীয় ফাতেমি শিয়াদের প্রতি অনুগত কাতামা গোত্রসহ উত্তর আফ্রিকার বার্বার জাতি তাকে খলিফা হিসেবে বরণ করে নেয় এবং তার প্রতি বায়াত গ্রহণ করে। এভাবে দীর্ঘ দু শতাব্দীরও অধিক সময়ের প্রচেষ্টার ফলে উত্তর আফ্রিকায় প্রথম শিয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ইতিহাসে ফাতেমি খিলাফত নামে পরিচিত।


উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ির সাংগঠনিক তৎপরতায় এবং ওবায়দুল্লাহ আল মাহদির কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বে ৯০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ফাতেমি খিলাফত। এ খিলাফতটি ৯০৯- ১১৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সুন্নি আব্বাসি এবং স্পেনের সুন্নি উমাইয়া খিলাফতের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মুসলিম বিশ্বের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শাসন করে। এ বংশে মোট খলিফা ছিলেন মোট চৌদ্দজন। ১১৭১ খ্রিস্টাব্দে আইয়ুবি বংশের উত্থানে ফাতেমি খিলাফতের চূড়ান্ত পতন ঘটে।

Post a Comment

Previous Post Next Post