ফাতেমি খিলাফতের পতনের কারণসমূহ আলোচনা
কর।
অথবা, ফাতেমীয় খিলাফতের পতনের কারণসমূহ
পর্যালোচনা কর।
অথবা, ফাতেমি খিলাফতের পতনের কারণসমূহ
বিশ্লেষণ কর।
উত্তর ভূমিকা: ফাতেমি খিলাফত দীর্ঘ আড়াইশ বছরেরও অধিক সময় টিকে ছিল। এ বংশের অবক্ষয় ও ক্রমাবনতি শুরু হয়েছিল খলিফা আল হাকিমের পর থেকেই। আল হাকিমের পর আরও ৮ জন খলিফা ফাতেমি সিংহাসন অলংকৃত করেন তবে তারা সবাই ছিলেন নামমাত্র শাসক। এ সময়কালে বদর আল জামালি এবং তার বংশধর আর্মেনি উজিরদের কর্মকুশলতার ফলে ফাতেমিদের চূড়ান্ত পতন কিছুটা বিলম্বিত হয়। তবে ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি এড়ানো সম্ভব হয়নি। সবশেষে ১১৭১ খ্রিস্টাব্দে সালাউদ্দিন আইয়ুবি কর্তৃক এ খিলাফতের চূড়ান্ত পতন ঘটে।
ফাতেমি খিলাফতের পতনের কারণ: নিম্নে ফাতেমি
খিলাফতের পতনের কারণসমূহ আলোচনা করা হলো-
১. প্রাকৃতিক নিয়ম: ঐতিহাসিক ইবনে
খালদুনের মতে, একটি রাজবংশের স্বাভাবিক কর্মশক্তি ও গৌরব বড়জোর একশ বছর বজায় থাকে।
এরপর শুরু হয় ক্রমাবনতি এবং পরিশেষে পতন। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। ফাতেমিদের ক্ষেত্রেও
প্রকৃতির এ স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি।
২. পরবর্তী খলিফাদের দুর্বলতা: খলিফা আল হাকিমের মৃতুর পর আল জাহির (১০২১-১০৩৬ খ্রি.), আল মুসতানসির (১০৩৬-১০৯৪ খ্রি.), আল মুস্তালি (১০৯৪-১১০১ খ্রি.), আল আমির (১১০১-১১৩১ খ্রি.), আল হাফিজ (১১৩১-১১৪৯ খ্রি.), আল জাফির (১১৪৯-১১৫৪ খ্রি.), আল ফাইজ (১১৫৪-১১৬০ খ্রি.) এবং সর্বশেষ আল আদিদ (১১৬০-১১৭১ খ্রি.) পর্যায়ক্রমে ফাতেমি খিলাফতের সিংহাসন অলংকৃত করেন। তবে এ ৮ জন খলিফার কেউই যোগ্য ছিলেন না। তারা ছিলেন দুর্বল, অযোগ্য ও ব্যক্তিত্বহীন। তাদের দুর্বলতা ও অযোগ্যতার সুযোগে তাদেরকে সামনে রেখে এ সময় উজিররাই সাম্রাজ্যের প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন। দুর্ভাগ্যজনক হলো বদর আল জামালি ও তার আর্মেনি বংশোদ্ভূত কয়েকজন উজির ছাড়া বাকি সব উজিরই ছিলেন ক্ষমতালোভী ও স্বার্থপর। ফলে তাদের কর্মকান্ড এ বংশের পতনের অন্যতম কারণ।
৩. মিশ্র জাতির বসবাস: ফাতেমিগণ ছিলেন
ইসমাইলীয় শিয়া মতাবলম্বী। কিন্তু সাম্রাজ্যের জনসাধারণের বিশাল অংশ ছিল সুন্নি মতাবলম্বী।
তাছাড়া ইহুদি, খ্রিস্টান, আরব, তুর্কি এবং গ্রিকসহ বিভিন্ন জাতির লোক সাম্রাজ্যে বসবাস
করতো। দুর্বল খলিফাদের আমলে বিভিন্ন সময় ষড়যন্ত্র এবং বিদ্রোহ হলে তা দমনে খলিফারা
ব্যর্থ হয়।
৪. সৈন্য বাহিনীর জাতীয়তাবোধের
অভাব: খলিফা আল মুইজ সৈন্য বাহিনীতে বিভিন্ন জাতির লোক নিয়োগ দেন। এজন্য আল
হাকিমের সময় তুর্কি বাহিনী ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। সৈন্য বাহিনীতে বিভিন্ন জাতি-বংশের
লোক থাকায় তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধের অভাব ছিল, যা ফাতিমিদের পতনকে ত্বরান্বিত করে।
৫. অভ্যন্তরীণ গোলযোগ: তুর্কি, বার্বার ও নিগ্রোদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের কারণে সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শান্তি বিনষ্ট হয়। এ অরাজকতার সুযোগে একের পর এক প্রদেশগুলো স্বাধীন বা হস্তুচ্যুত হতে শুরু করে। ১০৪৩ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়া ও প্যালেস্টাইন ফাতেমিদের হস্তচ্যুত হয়। খলিফাদের ক্ষমতা কেবল মিসর ও ইফ্রিকায়াতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তাদের পতন ঘটে।
৬. ইসমাইলীয়দের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি: ফাতেমিগণ ছিলেন
শিয়া ইসমাইলীয় মতবাদে বিশ্বাসী। খলিফা আল মুসতানসিরের পর ইসমাইলীয় আদর্শের সমর্থক শিয়াদের
মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। ফলে তারা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। খলিফা আল আমিরের মৃত্যুর পর
তারা একটি বড় জনগোষ্ঠীর সমর্থন প্রত্যাহার করে মুজাহিদ বংশ প্রতিষ্ঠা করায় ফাতেমিগণ
আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।
৭. তুর্কি সেনাদের ঔদ্ধত্য: মাগরিবি বার্বার
সৈন্যদের অপ্রতিরোধ্য প্রভাব নিয়ন্ত্রণের জন্য খলিফা আল আজিজ তুর্কিদের দ্বারা একটি
সেনা ইউনিট গঠন করেছিলেন। এ পদক্ষেপ সাময়িক সময়ের জন্য ফাতেমি খিলাফতের জন্য কল্যাণ
বয়ে আনলেও পরে এরাই সাম্রাজ্যের জন্য নতুন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তুর্কি প্রহরী দল
এক সময় সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয় এবং তাদের চরম ঔদ্ধত্য ফাতেমি
খিলাফতে রাজনৈতিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করে।
৮. প্রাকৃতিক দুর্যোগ: পুনঃপুন দুর্ভিক্ষ ফাতেমি খিলাফতকে মাঝে মাঝেই বিপর্যন্ত করে দেয়। খলিফা আল মুসতানসিরের খিলাফত কালে ক্রমাগত সাত বছরব্যাপী দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হয়ে ফাতেমি খিলাফত প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। রাজপ্রাসাদের মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী তুর্কি সেনারা ধ্বংস করে দিয়েছিল। সে দুর্ভিক্ষ ফাতেমি খিলাফতের মূলে প্রচণ্ড আঘাত হানে।
৯. মুসলিম শাসকদের সাথে সম্পর্কের
অবনতি: ফাতেমি খলিফাগণ মুসলমান ছিলেন বটে, কিন্তু অন্য কোনো মুসলমান খলিফা
বা সুলতানদের সাথে তাদের সম্পর্ক তেমন ভাল ছিল না। খলিফা আল মুইজ ও তৃতীয় আবদুর রহমানের
মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধলে উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
১০. অর্থনৈতিক দুর্বলতা: দুর্বল অর্থনৈতিক
অবস্থা ফাতেমি খিলাফতের অবক্ষয় ও পতনের অন্যতম কারণ ছিল। আল আজিজের পর থেকে ফাতেমি
খলিফাগণ আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি। ফলে রাষ্ট্রের
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের পথে অন্যতম
অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
১১. প্রাসাদ ষড়যন্ত্র: খলিফা আল হাকিম প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হন। তার মৃত্যুর পর তার বোন রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। খলিফা আল মুসতানসিরের মাতা বালক পুত্রের অভিভাবক নিযুক্ত হন এবং রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে নিগ্রো ও তুর্কিদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দেন। তুর্কিগণ নিগ্রোদেরকে রাজধানী হতে বহিষ্কার করে সকল ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়। এটি প্রকৃতপক্ষে ফাতেমি খিলাফতের মেরুদন্ড ভেঙে দেয়।
১২. আইয়ুবিদের উত্থান: আইয়ুবি বংশের
উত্থান ফাতেমি শাসনের অবসান ঘটায়। খলিফা আল আদিদের আমলে সিরিয়ার তুর্কি সুলতান নুরুদ্দিন
জঙ্গির আদেশক্রমে শিরকুহ কায়রো অধিকার করেন ও মিসরকে ক্রুসেডারদের হাত থেকে মুক্ত করে
'মিসরে সুন্নি প্রশাসক নিযুক্ত করেন। এটা ছিল প্রকৃতপক্ষে ফাতেমি খিলাফতের পতন। শেষ
ফাতেমি খলিফা আল আদিদ প্রাসাদে অসুস্থ ও ভগ্ন অবস্থায় ১১৭১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ
করলে ফাতেমি খিলাফতের অবসান হয় এবং সালাহউদ্দিন আইয়ুবি মিসরে আইয়ুবি বংশ প্রতিষ্ঠা
করেন।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার
পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ফাতেমি খিলাফতের কয়েকজন খলিফা ছাড়া অধিকাংশ খলিফাই ভোগবিলাসে
মত্ত থাকতেন। অভিভাবক ও মন্ত্রীদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে তারা বিলাসিতায় মেতে থাকতেন।
উপরন্তু দুর্ভিক্ষের ফলে সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড পঙ্গু হয়ে যায়। এরূপ পরিস্থিতিতে
সালাহউদ্দিন আইয়ুবি ১১৭ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল আদিদের মৃত্যুর পর মিসর দখল করেন। এভাবে
ওবায়দুল্লাহ আল মাহদি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ফতেমি বংশের পতন ঘটে ও আইয়ুবি বংশের উত্থান
হয়।