ফাতেমি খলিফা আল আজিজের কৃতিত্ব আলোচনা
কর।
অথবা, ফাতেমীয় খিলাফতের বিজ্ঞ ও জনকল্যাণকামী
শাসক হিসেবে খলিফা আল-আজিজের অবদান মূল্যায়ন কর।
অথবা, আল আজিজকে সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞ ও দয়ালু
শাসক বলা হয় কেন?
উত্তর ভূমিকা: খলিফা আল আজিজের ক্ষমতালাভ ফাতেমি বংশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে। তিনি ছিলেন একাধারে জ্ঞানী, দানশীল, প্রজারঞ্জক ও শিল্প সাহিত্যানুরাগী শাসক। তার রাজত্বকালে মুসলিম অমুসলিম সকলেই সুখ ও সমৃদ্ধিতে দিনাতিপাত করতো এবং সকল শ্রেণি ও সম্প্রদায় থেকে কর্মচারী নিয়োগ করা হতো। ঐতিহাসক P. K. Hitti বলেন, "সমস্ত ফাতেমি খলিফাদের মধ্যে আল আজিজ ছিলেন সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও পরোপকারী। তার রাজ্যের সীমানা আটলান্টিক মহাসাগর হতে লোহিত সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।"
ফাতেমি খিলাফতের বিজ্ঞ ও জনকল্যাণকামী
শাসক হিসেবে আল আজিজের কৃতিত্ব: আল আজিজ ছিলেন ফাতেমি খিলাফতের পঞ্চম
খলিফা এবং খলিফা আল মুইজের যোগ্য উত্তরসূরি। নিম্নে ফাতেমি খিলাফতের বিজ্ঞ ও জনকল্যাণকামী
শাসক হিসেবে আল আজিজের কৃতিত্ব মূল্যায়ন করা হলো-
১. সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি: আল আজিজের রাজত্বকালে
সমগ্র সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়ার কিছু অংশে ফাতেমি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। হিজাজ, ইয়ামেনের
পর মসুল, আলেপ্পোসহ অন্যান্য স্থানেও তার নামে খুতবা পঠিত হয়। এসময় আল আজিজের সাম্রাজ্য
ফোরাত নদীর সীমা হতে আটলান্টিকের তীর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে এবং আরব ভূমির অধিকাংশ
অঞ্চল তার সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। তার প্রভাব ও প্রতিপত্তি এতই বৃদ্ধি পায় যে, ফাতেমি বংশ
বাগদাদের আব্বাসি আর কর্ডোভার উমাইয়া বংশের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে এবং ভূমধ্যসাগরীয়
অঞ্চলে একমাত্র শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
২. শাসননীতি: আল আজিজ একজন সুদক্ষ শাসক হিসেবে ইতিহাসবিদদের প্রশংসা অর্জন করেছেন। রাজকার্য পরিচালনায় তিনি দক্ষ জনবল নিয়োগকে প্রাধান্য দেন। এক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনে তিনি জাতিধর্মবর্ণের মধ্যে কোনো প্রভেদ করতেন না। তার সময়ে শাসন কাজে নিযুক্তির প্রধান মানদণ্ড ছিল যোগ্যতা। এর ফলে ইসা বিন নেষুরিয়াস নামে একজন খ্রিস্টান তার উজির এবং মানসাহ নামে একজন ইহুদি খলিফার প্রধান খতিব পদে নিয়োগ পান। এছাড়াও খলিফার একজন রাশিয়ান স্ত্রী এবং ইহুদি ও খ্রিস্টান মন্ত্রী যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। অন্যায়ভাবে খলিফা কাউকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত একটিও খুঁজে পাওয়া যায় না।
৩. রাজস্বব্যবস্থা: রাজস্বব্যবস্থার
সংস্কার সাধনেও আল আজিজ বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এক্ষেত্রে তার রাজস্বমন্ত্রী ইয়াকুব
বিন কিল্লিস তাকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেন। রাজকর্মচারীদের উৎকোচ ও উপহার গ্রহণ সম্পূর্ণরূপে
নিষিদ্ধ) করা হয়। ঐতিহাসিক ও'লিয়ারির মতে, "খলিফা অত্যন্ত কঠোর হস্তে দুর্নীতি
নির্মূল করেন।" তিনি বহু কর্মচারী এমনকি গৃহভৃত্যদেরকেও বেতন ভাতা প্রদানের রেওয়াজ
প্রবর্তন করেন।
৪. কর ব্যবস্থা: খলিফা আল আজিজ
কর ব্যবস্থারও পুনর্বিন্যাস করেন। বিনা রসিদে প্রজাসাধারণের কাছ থেকে কর আদায়ে নিষেধাজ্ঞা
আরোপ করা হয়। তার এ ব্যবস্থার ফলে একদিকে যেমন প্রজাসাধারণ রাজস্বকর্মচারীদের হয়রানি
থেকে মুক্তিপান, অন্যদিকে কর আদায়ের পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজকোষের সমৃদ্ধি
অর্জিত হয়।
৫. সেনাবাহিনী সংস্কার: খলিফা আল আজিজ সামরিক বাহিনীর সংস্কার সাধন করেছিলেন। তার সময়ে সাম্রাজ্যে কাতামা ও বার্বারগণ প্রবল প্রতিপত্তি বিস্তার করে। তাদের দৌরাত্ম্য রোধ এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে তিনি তুর্কি ও নিগ্রোদের সমন্বয়ে একটি নতুন সেনা ইউনিট গঠন করেন। নতুন পোতাশ্রয় নির্মাণ ও যুদ্ধজাহাজ যুক্ত করে নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করা হয়। ইসা বিন নেস্কুরিয়াস নামে একজন নৌ অধ্যক্ষ এ কাজে খলিফাকে বিশেষভাবে সহায়তা করেন।
৬. বিচারব্যবস্থা: খলিফা আল আজিজ
তার পিতার মতোই একজন ন্যায়বিচারক ছিলেন। বিচারকাজের সুবিধার্থে শরিয়াহ ও ধর্মীয় আইনকানুন
সংস্থারও উন্নয়ন সাধন করেন। দেশের ধর্মীয় ও বিচারসংক্রান্ত কাজ পরিচালনার জন্য তিনি
তার পিতার সময়কার প্রধান কাজি নোমান পরিবারের ওপর দায়িত্বভার প্রদান করেন। তার সময়ে
প্রথমে আলি বিন নোমান এবং পরে মুহম্মদ বিন নোমান প্রধান কাজি হিসেবে বিচারকার্য পরিচালনা
করেন।
৭. জনহিতকর কার্যাবলি: জনদরদি, ধার্মিক, শিল্প ও সাহিত্যানুরাগী খলিফা আল আজিজ নিরবচ্ছিন্ন সুখশান্তিতে শাসনকাল পরিচালনা করেন। তিনি বিলাসব্যসন পছন্দ করতেন। কায়রো এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তিনি অসংখ্য মাদ্রাসা, মসজিদ, প্রাসাদ ও সেতু নির্মাণ করেন। তিনি কৃষিকাজের সুবন্দোবস্তের জন্য খাল খনন করেন। ফাতেমি স্থাপত্য শিল্প তার পৃষ্ঠপোষকতায় চরম উৎকর্ষ লাভ করে। তার নির্মিত কারাফা মসজিদ ফাতেমি স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন।
৮. জ্ঞানবিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা: খ্রিস্টান ও
ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রতি আল আজিজের সদয় ব্যবহার দেখে তার ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রমাণ
পাওয়া যায়। তিনি একজন খ্রিস্টান মহিলাকে বিবাহ করেন এবং তার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইসলামে
নবদীক্ষিত ইয়াকুব বিন কিল্লিস নামক একজন ইহুদি। ইয়াকুব বিন কিল্লিসের মৃত্যুর পর ইসা
বিন নেস্তুরিয়াস নামক একজন খ্রিস্টান মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় আল মুইজের
সেনাপতি জাওহার আল সিকিলি কর্তৃক নির্মিত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ
শিক্ষানিকেতনরূপে স্বীকৃতি লাভ করে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার
পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ফাতেমি পঞ্চম খলিফা আল আজিজ একজন বিজ্ঞ ও জনকল্যাণকামী শাসক
হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নিজে একজন নিষ্ঠাবান শিয়া ছিলেন। তিনি পরমতসহিষ্ণু ছিলেন। ফলে
তার আমলে জনগণ নিরবচ্ছিন্ন সুখশান্তিতে বসবাস করে। তার আমলে ফাতেমি প্রতিপত্তি ও গৌরব
চরম শিখরে উঠেছিল। ঐতিহাসিক P. K. Hitti যথার্থই বলেন, "সমস্ত ফাতেমি খলিফার মধ্যে
সম্ভবত আল আজিজ সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী ও পরোপকারী ছিলেন।"