কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির হাতিয়ারগুলো বর্ণনা কর। অর্থনীতির ওপর আর্থিক নীতির প্রভাব ও আর্থিক নীতির উদ্দেশ্যাবলি আলোচনা কর।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির হাতিয়ারগুলো বর্ণনা কর।  অর্থনীতির ওপর আর্থিক নীতির প্রভাব ও আর্থিক নীতির উদ্দেশ্যাবলি আলোচনা কর।

 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির হাতিয়ারগুলো বর্ণনা কর।  অর্থনীতির ওপর আর্থিক নীতির প্রভাব ও আর্থিক নীতির উদ্দেশ্যাবলি আলোচনা কর।

 

 

সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা আর্থিক কর্তৃপক্ষ অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যেসব উপায় অবলম্বন করে বা করতে পারে তাদেরকে আর্থিক নীতির হাতিয়ার বলা হয়। অর্থাৎ আর্থিক নীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়নের জন্য সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে অর্থ ও ঋণের যোগান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির হাতিয়ার: নিম্নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির হাতিয়ারগুলো আলোচনা করা হলো:

 

১. ধাতব ও কাগজি মুদ্রার নোট নিয়ন্ত্রণ: আর্থিক নীতি বাস্তবায়নের প্রধান হাতিয়ার হলো অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণ করা। দেশে অর্থের সরবরাহের ঘাটতি দেখা দিলে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে নতুন ধাতব মুদ্রা বা অতিরিক্ত কাগজি মুদ্রা প্রচলন করতে পারে। ফলে অর্থের যোগান বৃদ্ধি পায় আবার অর্থের যোগান কমানোর জন্য পুরাতন ধাতব ও কাগজি মুদ্রা বাতিল করতে পারে। নির্দিষ্ট মানের কাগজি নোট নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তা বাজার থেকে তুলে নেয়। ফলে অর্থের যোগান হ্রাস পায় এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হয়। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক ইস্যুকৃত মুদ্রার যোগান নিয়ন্ত্রণ করে সরকার অর্থের যোগান ও চাহিদার মধ্যে সমন্বয়সাধন করে।

 


২. খোলাবাজারের নীতি: আর্থিক নীতি বাস্তবায়নের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো খোলাবাজার নীতি। যখন অর্থের যোগান বৃদ্ধির প্রয়োজন হয় তখন সরকার খোলাবাজারের মাধ্যমে। বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে ঋণপত্র, সঞ্চয়পত্র, বন্ড প্রভৃতি ক্রয় করে। এর ফলে জনসাধারণের হাতে নগদ অর্থ এবং ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণদান ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে, বাজারে যখন অর্থের যোগান হ্রাসের প্রয়োজন হয় তখন সরকার বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিকট বিভিন্ন ধরনের ঋণপত্র বিক্রয় করে থাকে। এর ফলে জনসাধারণের হাতে নগদ অর্থ কমে যায় এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণদান ক্ষমতা হ্রাস পায়। এভাবে সরকার ও সরকারের পক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক খোলাবাজারে ঋণপত্র, সঞ্চয়পত্র, বন্ড প্রভৃতি. ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে সরকার অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

 

৩. ব্যাংক হার পরিবর্তন আর্থিক নীতি: বাস্তবায়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো ব্যাংক হার পরিবর্তন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুদের হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ঋণ প্রদান করে সে হারকে ব্যাংক হার বলা হয়। একে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হারও বলা হয়। অর্থাৎ বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ কোনো কারণে তারল্য সংকটে পতিত হলে তথা নগদ অর্থের ঘাটতি দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট হতে যে সুদের হারে ঋণ গ্রহণ করে তাকে ব্যাংক হার বলা হয়। অর্থের যোগান হ্রাস করার প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার সুদের হার অর্থাৎ ব্যাংক হার বৃদ্ধি করে। এর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ গ্রহণের পরিমাণ হ্রাস পায়। পক্ষান্তরে, অর্থের যোগান বৃদ্ধি করার প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার ব্যাংক হার হ্রাস করে। এর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এভাবে ব্যাংক হার পরিবর্তনের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণদান কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

 

৪. রিজার্ভ হারের পরিবর্তন: আর্থিক নীতির অন্যতম হাতিয়ার হলো রিজার্ভ হারের পরিবর্তন। বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে তার নিকট দৈনিক জমা, পড়া নগদ অর্থের একটি অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট জমা রাখতে হয় যাকে রিজার্ভ হার বলা হয়। দেশে যখন অর্থের যোগান হ্রাস করতে হয় তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভের হার বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণযোগ্য তহবিল হ্রাস পায় এবং ঋণের যোগানও কমে যায়। অপরদিকে, দেশে যখন অর্থের যোগান বৃদ্ধি করতে হয় তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভের অনুপাত বা রিজার্ভ হার কমিয়ে দেয়। এর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণযোগ্য তহবিল বৃদ্ধি পায় এবং সেই সাথে ঋণের যোগানও বৃদ্ধি পায়। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ হার বাড়িয়ে কিংবা কমিয়ে সরকারের পক্ষে ঋণ নিয়ন্ত্রণ তথা অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

 

৫. ঋণের রেশনিং: আর্থিক নীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো ঋণের রেশনিং। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন প্রকার লগ্নিপত্রের জামিনে ঋণদানের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেয়। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের যোগান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

 

৬. ঋণের প্রয়োজনীয় মার্জিন পরিবর্তন: আর্থিক নীতির অন্যতম হাতিয়ার হলো ঋণের প্রয়োজনীয় মার্জিন পরিবর্তন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের প্রয়োজনীয় মার্জিন হ্রাস-বৃদ্ধি করে অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

 


৭. নৈতিক চাপ: আর্থিক নীতির অন্যতম হাতিয়ার হলো নৈতিক চাপ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক সময় ঋণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে বিভিন্ন ধরনের উপদেশ ও পরামর্শ প্রদান করে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের সমস্ত ব্যাংক ব্যবস্থার অভিভাবক। কাজেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো উপদেশ বা পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর নৈতিক চাপ সৃষ্টি করে।

 

৮. প্রচারণা: আর্থিক নীতির অন্যতম হাতিয়ার হলো প্রচারণা। ঋণের যোগান নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের প্রচারণা করে থাকে। যেমন- কেন্দ্রীয় ব্যাংক মাঝে মাঝে পত্রিকা, বুলেটিন প্রকাশের মাধ্যমে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট, ব্যবসায়ের অবস্থা প্রভৃতি জনগণের নিকট অবহিত করে। এ ধরনের প্রচারণা দ্বারা বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণদান কার্যক্রম যথেষ্ট প্রভাবিত হয়।

 

৯. প্রত্যক্ষ ব্যবস্থা: আর্থিক নীতির অন্যতম হাতিয়ার হলো প্রত্যক্ষ ব্যবস্থা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা বাজারের শীর্ষে অবস্থান করে। তাই ঋণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর প্রত্যক্ষ আদেশ জারি করে। এসব আদেশ বাণিজ্যিক ব্যাংক পালনে অনিয়ম করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করে থাকে।

 

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রত্যেক দেশেরই পূর্ণ নিয়োগ অর্জন, দামস্তর স্থিতিশীল রাখা, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি ইত্যাদি লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে আর্থিক নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব হাতিয়ার প্রয়োগ করে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ ও ঋণের যোগান নিয়ন্ত্রণ করে আর্থিক নীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে থাকে।

 


অর্থনীতির ওপর আর্থিক নীতির প্রভাব আলোচনা

 

সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক গৃহীত যে নীতি দেশের অর্থ বাজারকে প্রভাবিত করে অর্থাৎ অর্থের যোগানের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটায় তাকে আর্থিক নীতি বলে। অর্থের চাহিদা ও যোগান পরিবর্তনের মাধ্যমে আর্থিক নীতি অর্থ ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে।

 

অর্থনীতির ওপর আর্থিক নীতির প্রভাব আর্থিক নীতি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর কীভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে 'সে সম্পর্কে দুটি মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। যথা: ১. কেইনসীয় মতবাদ ও ২. মনিটারিস্টদের মতবাদ।

 

নিম্নে এ দুটি মতবাদ আলোচনা করা হলো:

 

১. কেইনসীয় মতবাদ: কেইনসীয় মতবাদ অনুযায়ী আর্থিক নীতি অর্থনীতিকে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে। কেইনসীয় মতের অনুসারী অর্থনীতিবিদগণ দেখিয়েছেন যে, তিনটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আর্থিক নীতি অর্থনীতির ওপর পরোক্ষ প্রভাব বিস্তার করে।

 

ক. মূলধন ব্যয় প্রতিক্রিয়া: অর্থের যোগান বৃদ্ধি পেলে মানুষ অতিরিক্ত অর্থ বন্ড ক্রয়ের জন্য ব্যয় করবে, এক্ষেত্রে বন্ডের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। ফলে তার সুদের হার হ্রাস পাবে। এ অবস্থায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি হেতু জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাবে।

 

খ. সম্পদ প্রতিক্রিয়া: কেইনসীয় অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, মুদ্রানীতির মাধ্যমে মুদ্রার পরিবর্তন অর্থনীতিতে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এটি ভোক্তাদের ভোগ আচরণ প্রভাবিত করে এবং সামগ্রিক চাহিদার পরিবর্তন ঘটায়। ধরি, অর্থের যোগান বৃদ্ধির দরুন সুদের হার হ্রাস এবং মূলধন দ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি হেতু এর মূল্য বৃদ্ধি পেল। এ অবস্থায় সম্পদের মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণকে পরোক্ষভাবে আরও সম্পদশালী করবে। ফলে তাদের ভোগ বৃদ্ধির চাহিদা, জাতীয় আয় ও নিয়োগের ওপর শুভ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। বিপরীত অবস্থায় মোট চাহিদার ওপর প্রতিক্রিয়ার দরুন জাতীয় আয় ও নিয়োগ হ্রাস পাবে।

 

গ. ঋণের রেশনিং প্রতিক্রিয়া: কেইনসীয় অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ঋণের রেশনিং পদ্ধতির মাধ্যমে আর্থিক নীতি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে পারে। ঋণের রেশনিং ব্যবস্থার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো প্রকল্প বা খাতের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মকে প্রভাবিত করতে পারে।

 


২. মনিটারিস্টদের মতবাদ: মনিটারিস্টদের মতবাদ অনুযায়ী, আর্থিক নীতি অর্থের চাহিদার পরিবর্তনের মাধ্যমে অর্থনীতিকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করতে পারে। মনিটারিস্টদের মতে, অর্থের যোগান সুদের হারকে নিম্নোক্তভাবে প্রভাবিত করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারে:

 

ক. তারল্য প্রভাব: অর্থের তারল্যের দরুন স্বল্পমেয়াদে সুদের হার হ্রাস পায়।

 

খ. উৎপাদন প্রভাব: প্রাথমিক পর্যায়ে সুদের হার হ্রাস পাওয়ার দরুন উৎপাদন ও অর্থের চাহিদা বৃদ্ধি পর্যায়ে সুদের হার বৃদ্ধি পাবে।

 

গ. মূল্য প্রত্যাশা প্রভাব: ঋণদাতারা মূল্য বৃদ্ধি প্রত্যাশা করে আর্থিক সুদের চেয়ে প্রকৃত সুদের ওপর গুরুত্বারোপ করবে। এজন্য মনিটারিস্টরা আর্থিক সুদের সাথে প্রত্যাশিত মুদ্রাস্ফীতির সমান আর্থিক প্রিমিয়াম যোগে সুদের হার বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হয়।

 

উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, আর্থিক নীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুদের হার, চাহিদা, সম্পদের মূল্য, মূল্য প্রত্যাশা প্রভৃতি চলকসমূহের পরিবর্তন ঘটিয়ে অর্থনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে।

 

আর্থিক নীতির উদ্দেশ্যাবলি আলোচনা

 

প্রতিটি দেশের আর্থিক নীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। কিন্তু সব দেশের আর্থিক নীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক নয়। কারণ একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে আর্থিক নীতি প্রণয়ন করা হয়। এজন্য বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার তারতম্য অনুসারে আর্থিক নীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও বিভিন্ন হয়ে থাকে। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশের আর্থিক নীতির কতকগুলো সাধারণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে।

 

আর্থিক নীতির উদ্দেশ্য: আর্থিক নীতির প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলো:

 


১. দামন্তরের স্থিতিশীলতা রক্ষা করা: আর্থিক নীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো দামস্তরের স্থিতিশীলতা রক্ষা করা। কারণ দামস্তরের হ্রাস-বৃদ্ধি উভয় দেশের জন্য ক্ষতিকর। দামস্তর অতিমাত্রায় উঠানামা করলে অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রাসংকোচন তথা বেকারত্ব দেখা দেয় বা মন্দা দেখা দেয়। এককথায় দামস্তরের উঠানামা অর্থনীতিতে বাণিজ্য চক্রের সৃষ্টি করে। দামস্তরের উঠানামার ফলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির লোক বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়। এতে কেউ উপকৃত হয়, আবার কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া দামস্তর বেশি বৃদ্ধি পেলে সমাজে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয় এবং দামস্তর কম হলে মুদ্রাসংকোচন ও বেকারত্ব দেখা দেয়। এর ফলে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। এ অনিশ্চয়তার হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে দামস্তরের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা একান্ত জরুরি। তাই দামস্তরের ঘন ঘন ওঠানামা নিয়ন্ত্রণ করা এবং দামস্তরের স্থিতিশীলতার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য রক্ষা করাই হলো আর্থিক নীতির প্রধান লক্ষ্য।

 

২. বাণিজ্যিক চক্র নিয়ন্ত্রণ: আর্থিক নীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য' বা উদ্দেশ্য হলো বাণিজ্য চক্র নিয়ন্ত্রণ করা। বাণিজ্য চক্রের উত্থান ও পতন উভয়ই অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। কারণ বাণিজ্য চক্রের মন্দার সময় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও সামগ্রিক চাহিদা হ্রাস পায়। এর ফলে দেশে উৎপাদন ও বিনিয়োগ কমে যায়। আবার বাণিজ্য চক্রের উঠতির সময় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় এবং দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। এর ফলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক নীতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ন্ত্রণ করে মুদ্রাস্ফীতি ও মন্দার হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারে। তাই বাণিজ্যিক চক্র নিয়ন্ত্রণ করাই হলো আর্থিক নীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।

 

৩. বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা রক্ষা: আর্থিক নীতির অন্যতম লক্ষ্য হলো বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা রক্ষা করা। বৈদেশিক মুদ্রার সাথে দেশীয় মুদ্রার হার অতিমাত্রায় উঠানামা করলে তা দেশের আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এর ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। তাই আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে বৈদেশিক মুদ্রার সাথে দেশীয় মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা জরুরি। এজন্য একটি সঠিক বিনিময় নীতি গ্রহণ করে দেশীয় মুদ্রার সাথে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার তথা অর্থের বহির্মূল্যের স্থিতিশীলতা রক্ষা করাই হলো আর্থিক নীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।

 

৪. বিনিয়োগ বৃদ্ধি: আর্থিক নীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বিনিয়োগ বৃদ্ধি। এ উদ্দেশ্যে সরকার বা আর্থিক কর্তৃপক্ষ সুলভ বা সম্প্রসারণমূলক আর্থিক নীতি অনুসরণ করতে পারে। কারণ বিনিয়োগ নির্ভর করে মূলধনের প্রান্তিক দক্ষতা ও সুদের হারের ওপর। সম্প্রসারণমূলক আর্থিক নীতির মাধ্যমে অর্থের যোগান বৃদ্ধি করে সুদের হার কমানো হলে বিনিয়োগ ও আয়স্তর বাড়ে এবং LM রেখা ডানে স্থান পরিবর্তন করলেও সুদের হার হ্রাস পায়। এর ফলে সুদের হার কমে এবং বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ে তথা বেকারত্ব ও মন্দাবস্থা দূরীভূত হয়, এতে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ঘটে। এ কারণে বিনিয়োগ বৃদ্ধিকে আর্থিক নীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

 

৫. অর্থের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা: অধ্যাপক হায়েক সহ প্রমুখ অর্থনীতিবিদদের মতে, অর্থের নিরপেক্ষতা বজায় রাখাই আর্থিক নীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাঁরা বলেন যে, দেশে অর্থনীতিতে অর্থের কোনো সক্রিয় ভূমিকা থাকা উচিত নয়। অর্থ শুধুমাত্র নিষ্ক্রিয় বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে এবং দামস্তরের ওপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকবে। অর্থের এ রিপেক্ষ ভূমিকা রক্ষা করতে হলে অর্থের কার্যকর যোগান স্থির রাখতে হবে। কিন্তু এ নিরপেক্ষ আর্থিক নীতি প্রয়োগের বাস্তব অসুদ্ধিা রয়েছে। অর্থের কার্যকর যোগান স্থির রাখতে হলে অর্থের প্রচলন গতি বা উৎপাদন অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে অথবা জনসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটলে অর্থের যোগানেরও পরিবর্তন করতে হবে। এসব পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অর্থের কার্যকর যোগান স্থির রাখা খুবই কঠিন।

 

৬. পূর্ণ কর্মসংস্থান: অর্থনীতিবিদ লর্ড কেইনসের মতে, আর্থিক নীতির মূল লক্ষ্য হলো পূর্ণ কর্মসংস্থান বা পূর্ণ নিয়োগ স্তর অর্জন করা। তাঁর মতে, সুলভ আর্থিক নীতি দ্বারা পূর্ণ কর্মসংস্থান অর্জন করা সম্ভব হয়। সুলভ আর্থিক নীতি অনুসরণ করা হলে সুদের হার হ্রাস পাবে এবং বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। কারণ ঋণের খরচ কম হলে উদ্যোক্তা বা বিনিয়োগকারীরা বেশি ঋণ গ্রহণ করবে। এর ফলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। আবার কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেলে লোকের আয় ও চাহিদা বাড়বে। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এভাবে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেতে পেতে দেশ পূর্ণ কর্মসংস্থান স্তরে উপনীত হবে। এ জন্য কেইনস দেশে বেকারত্ব থাকা পর্যন্ত সুলভ আর্থিক নীতি অনুসরণের মাধ্যমে অর্থের যোগান বৃদ্ধি করে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর পক্ষপাতী। কেইনসের মতে, পূর্ণ কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত আবর্তনশীল ও স্থায়ী এ উভয় শ্রেণির বেকারত্ব দূরীকরণের জন্য সুলভ আর্থিক নীতি অনুসরণ করা উচিত। সুতরাং কোনো দেশের আর্থিক নীতি এমনভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত যাতে নিয়োগ বৃদ্ধি পেয়ে পূর্ণ কর্মসংস্থান অর্জিত হয়।

 


৭. অর্থনৈতিক উন্নয়ন: আধুনিক কালে অধিকাংশ দেশে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশসমূহের আর্থিক নীতির প্রধান লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বর্তমান বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের প্রধান সমস্যা হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এসব দেশে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানবিক সম্পদ রয়েছে। কিন্তু এসব সম্পদের উন্নয়ন ও উৎপাদনে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি ও উৎপাদন কৌশলের অভাব আছে। কাজেই এসব দেশের আর্থিক নীতি এমন হওয়া উচিত যাতে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হয়। অধ্যাপক এস.কে. বসু মনে করেন যে, উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক নীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত অর্থ সৃষ্টি এবং সঞ্চয় ও বিনিয়োগ প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সাহায্য করা। বস্তুত বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশসমূহের অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই আর্থিক নীতির সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

 

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ আর্থিক নীতির বিভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে সব দেশের আর্থিক নীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক নয়। কোনো দেশের আর্থিক নীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিত তা নির্ভর করে মূলত সে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর। তবে সার্বিকভাবে বলা যায়, দামস্তরের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, বাণিজ্যিক চক্র নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা রক্ষা, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, পূর্ণ কর্মসংস্থান অর্জন দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন এগুলোই হলো আর্থিক নীতির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

Post a Comment

Previous Post Next Post