স্পেনে উমাইয়া আমিরাত সুদৃঢ়করণে প্রথম হিশামের কৃতিত্ব বিচার কর ।

স্পেনে উমাইয়া আমিরাত সুদৃঢ়করণে প্রথম হিশামের কৃতিত্ব বিচার কর ।

প্রথম হিশামের কৃতিত্ব ও চরিত্র আলোচনা কর।

অথবা, স্পেনে উমাইয়া আমিরাত সুদৃঢ়ীকরণে প্রথম হিশামের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর।

অথবা, স্পেনে মুসলিম শাসন সুদৃঢ়ীকরণে প্রথম হিশামের কৃতিত্ব বিচার কর।

উত্তর ভূমিকা: প্রথম আব্দুর রহমানের মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য পুত্র প্রথম হিশাম ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে ৩২ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই তাকে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বিভিন্ন গোত্র ও উপগোত্রে বিভক্ত উমাইয়া ও অন্যান্য মুসলিম স্পেনে সুযোগ পেলেই কলহ বিবাদে লিপ্ত থাকত। উপরন্তু প্রথম হিশামকে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রবাদী ভ্রাতৃগণের ওপর বিশেষ নজর রাখতে হতো। প্রথম হিশাম রাজ্যের সব সমস্যা কঠোর হস্তে দমন করে সাম্রাজ্যের উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি প্রায় ৮ বছর শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে কৃতিত্বপূর্ণ কার্যাবলির মাধ্যমে ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছেন।

প্রথম হিশামের কৃতিত্ব ও চরিত্র নিম্নে প্রথম হিশামের কৃতিত্ব ও চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-


১. প্রথম হিশামের কৃতিত্ব নিম্নে প্রথম হিশামের কৃতিত্ব :আলোচনা করা হলো-

ক. ভ্রাতৃযুদ্ধ দমন: প্রথম হিশাম ক্ষমতা লাভ করার পর তার দুই ভ্রাতা বিরুদ্ধাচরণ করেন এবং ৭৯০ খ্রিস্টাব্দে এক বিশাল বাহিনী গঠন করে টলেডোতে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ফলশ্রুতিতে প্রথম হিশাম বুলক প্রান্তরে বিদ্রোহী ভ্রাতৃদ্বয়ের মোকাবিলা করেন এবং উভয়কে পরাজিত করে স্পেন থেকে বিতাড়িত করেন।

খ. পূর্ব স্পেনের অসন্তোষ দমন: পূর্ব স্পেনে সাইদ বিন হুসাইন ইয়াহিয়া আল আনসারির বিরুদ্ধাচরণকে সমূলে উৎপাটিত করতে সৈন্য প্রেরণ করেন। বিদ্রোহী নেতা যুদ্ধে পরাজিত হলে মুদারীয় নেতা মুসা বিন ফরতুনিওর ক্ষমতা লাভ করেন কিন্তু তিনি হিমারীয় বিদ্রোহী নেতাদের সঙ্গে সংঘর্ষে পরাজিত ও নিহত হন। ফলে তারাতোসা, বার্সেলোনা, হিউসা প্রথম হিশামের হাতছাড়া হয়ে যায়। বিদ্রোহীদের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে প্রথম হিশাম ভ্যালেন্সিয়ার গভর্নর আবু ওসমান ওবায়দুল্লাহকে বিদ্রোহ দমনে প্রেরণ করেন। ৭৯১ খ্রিস্টাব্দে তিনি সারাগোসা আক্রমণ করে বিদ্রোহীদের নির্মূল করেন।


গ. ফ্রান্সে অভিযান: প্রথম হিশাম সিংহাসনে আরোহণ করার পর ফ্রান্সের নারবোন ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে খ্রিস্টানগণ লুটতরাজ ও হত্যাকাণ্ড আরম্ভ করে। এ ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধের জন্য প্রথম হিশাম ৭৯২ খ্রিস্টাব্দে আবু ওসমান ওবায়দুল্লাহর নেতৃত্বে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী ফ্রান্সে প্রেরণ করেন। সুদীর্ঘ ৩২ বছর পর নারবোনে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম বাহিনী ফ্রান্সের বিশাল এলাকা দখল করে এবং খ্রিস্টান নৃপতিগণ প্রথম হিশামের সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হয়।

ঘ. মালেকি মাজহাবের প্রবর্তক: আমির প্রথম হিশাম একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন এবং ধর্মীয় অনুশীলন মেনে চলতেন। তিনি পবিত্র মদিনা নগরীতে বসবাসকারী প্রখ্যাত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ইমাম মালেকে ধর্মপ্রচার ও বিধানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তিনি বিদ্যার্থীদের মদিনায় প্রেরণ করে মালেকি মাজহাব সম্বন্ধে দীক্ষা লাভের সুযোগ দেন। প্রথম হিশাম মালেকি মাজহাবকে স্পেনের রাষ্ট্র ধর্মীয় মতবাদের মর্যাদা দেন।

ঙ. অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়ন: আমির প্রথম হিশামের প্রধান সচিব মুহম্মদ বিন বশির আল মাদিরি বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রতি বিশেষ নজর দেন।

চ. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকরণ: ন্যায়বিচারক হিসেবে তার কৃতিত্ব অপরিসীম। তিনি কর্মদক্ষ ও সৎ রাজকর্মচারীদের নিজ পদে বহাল রাখেন এবং দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীদের পদচ্যুত করেন। তিনি শরিয়তবিরোধী কর রহিত করেন এবং জাকাত ও সদকা আদায়ের ওপর জোর দেন। তার রাজত্বকালে কর্ডোভার প্রধান বিচারক ছিলেন মুসা বিন ইমরান।

ছ. যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন: প্রথম হিশাম যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নকল্পে গোয়াদাল কুইভার নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ করেন। রাজধানীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য তিনি একটি ফোয়ারা নির্মাণ করেন।

জ. জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নতি: প্রথম হিশাম নিজে একজন স্বনামধন্য কবি ছিলেন এবং কাব্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তিনি জ্ঞানীগুণীদের সমাদর করতেন। তার শাসনামলের বিখ্যাত কবি ছিলেন আমর বিন আলি গাফফার। ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, "যৌবনে আমির হিশামের প্রাসাদ বিজ্ঞানী, কবি, ধর্মশাস্ত্রবিদদের দ্বারা পরিবৃত্ত থাকত।"

ঝ. স্থাপত্যকলায় অনুরাগ: প্রথম হিশামের পিতা প্রথম আব্দুর রহমান কর্তৃক স্থাপিত কর্ডোভা মসজিদটি তিনি সংস্কার করেন। আরব ঐতিহাসিকদের মতে, হিশাম কর্ভোডা মসজিদে একটি মিনার সংযোজন করেন। এ মিনারটির উচ্চতা ছিল ১৪০ ফুট। এছাড়া তিনি মসজিদের অন্যান্য অংশের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। Prof. S. M. Imamuddin বলেন, "সম্প্রসারণ ও সংস্কার কাজে ১,৬০,০০০ দিনার ব্যয় হয়েছিল।" প্রথম হিশাম স্পেনে কতিপয় মসজিদ নির্মাণ করে স্থাপত্যকলায় তার অনুরাগ প্রকাশ করেন।


২. প্রথম হিশামের চরিত্র নিম্নে প্রথম হিশামের চরিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলো-

ক. প্রজাবৎসল: প্রথম হিশাম প্রজাবৎসল শাসক ছিলেন। তিনি গুপ্তচর পাঠিয়ে প্রজাদের অবস্থার কথা জানতেন। তিনি আব্বাসি খলিফা হারুন অর রশিদের মতো রাতে ছদ্মবেশে শহর পরিভ্রমণ করতেন। তিনি স্বৈরাচারী শাসক ছিলেন না; বরং বয়োজ্যেষ্ঠদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন।

খ. ধর্মীয় অনুরাগী শাসক: তিনি বাল্যকাল থেকেই গোঁড়া ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি মালেকি মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। সংগীতের প্রতি অনীহা থাকার কারণে তার রাজত্বকালে সংগীত নিষিদ্ধ ছিল। এর প্রধান কারণ গোঁড়া মালেকি মতবাদের প্রভাব। গ. শিক্ষা সাহিত্যানুরাগী: তিনি শিক্ষাবিস্তারের জন্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং আরবি ভাষার শিক্ষার ওপর সুনজর দেন। তিনি একজন স্বনামধন্য কবি ছিলেন এবং কাব্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ঘ. অনাড়ম্বরপূর্ণ জীবন: প্রথম হিশাম অত্যন্ত সহজসরল জীবনযাপন করতেন। তিনি আড়ম্বরতা পছন্দ করতেন না। তিনি নিজে গরিবদুঃখীদের কুটিরে গিয়ে তাদের সাহায্য করতেন।


উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আমির হিসেবে প্রথম হিশাম ৮ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করেন এবং এসময়ে তিনি তার পিতার নবপ্রতিষ্ঠিত উমাইয়া আমিরাতকে বিদ্রোহীদের হাত থেকে রক্ষা করে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি রাজ্য বিজয়ে নয়; বরং সংহতি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে উমাইয়া আমিরাতের স্থায়িত্বকে সুনিশ্চিত করেন। ঐতিহাসিক আমির আলির ভাষায়, "তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ সদাশয় ও মহানুভব আমির।" নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তিনি পিতার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী ছিলেন এবং স্পেনে আমিরাতের স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদান রয়েছে।

আরো পড়ুন পূর্ণাঙ্গ সাজেশন ও তার উত্তর একত্রে

স্পেনের মুসলমানদের ইতিহাস (৭১০-১৪৯২)

 

Post a Comment

Previous Post Next Post