স্পেনে উমাইয়া শাসনের পতনের কারণসমূহ ব্যাখ্যা
কর।
অথবা, স্পেনে উমাইয়া খিলাফতের পতনের কারণসমূহ
বিশ্লেষণ কর।
উত্তর ভূমিকা: প্রথম আব্দুর
রহমান ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে স্পেনে উমাইয়া আমিরাত প্রতিষ্ঠা করেন। তৃতীয় আব্দুর রহমানের
সময় এ আমিরাত খিলাফত রূপে রূপান্তরিত হয়। ৯২৯ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় আব্দুর রহমানের প্রতিষ্ঠিত
খিলাফত ১০৩১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সগৌরবে টিকেছিল। এর পরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশের
উত্থান হয়। তবে সর্বশেষ ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে স্পেন হতে মুসলামনরা বিতাড়িত হয়। Prof.
S. M. Imamuddin বলেন, "রাষ্ট্রটির স্থায়িত্ব অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক কারণে ধ্বংসে
নিপতিত হয় এবং এর সুনাম আর খুঁজে পাওয়া যায় না"।
স্পেনে উমাইয়া শাসনের পতনের কারণসমূহ: স্পেনে উমাইয়া
শাসনের পতনের কারণকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা। অভ্যন্তরীণ কারণ ও বৈদেশিক কারণ।
নিম্নে তা আলোচনা 'কর হলো-
১. অভ্যন্তরীণ কারণ: স্পেনে উমাইয়া
শাসন পতনের অভ্যন্তরীণ কারণগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
ক. শাসকদের দুর্বলতা: দ্বিতীয় হাকাম পর্যন্ত উমাইয়া খিলাফত ছিল সুসংহত, সুদৃঢ় ও প্রগতিশীল। পরবর্তীতে খলিফাগণ দুর্বল ও অধিবাসীগণ অধিক ক্ষমতাশালী হয়ে পড়ে।
খ. সুষ্ঠু উত্তরাধিকারী নীতির অভাব: স্পেনে আরব মুসলিম
শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই উত্তরাধিকারী নীতির অভাব পরিলক্ষিত হয়। এতে রাজপ্রাসাদের
ক্ষমতা শক্তি সামর্থ্য ও দুর্বল হয়ে পড়ে।
গ. শাসকদের বিলাসিতা: প্রথম দিকে আমির
ও খলিফাগণ ধর্মপরায়ণ ও নীতিবান থাকলেও পরবর্তীতে শাসকদের নৈতিক স্খলন ঘটে। স্বাধীন
রাজ্যের সুলতানগণ মদ্যপানে ব্যস্ত হন। তারা শাসনকার্যে সময় দিতে না পারলেও আমোদ প্রমোদে
সময় দিতেন। ঘ. সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা স্পেনে আরব মুসলিম সামরিক বাহিনীর ভিত্তি ছিল
দক্ষ ও শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর ওপর। তৃতীয় আব্দুর রহমান দক্ষ শক্তিশালী স্লাভ বাহিনী
গঠন করলেও পরবর্তীতে তাদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত থাকেনি। ১০৩১ খ্রিস্টাব্দে খিলাফতের
পতন হলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশের অধীনে সেনাবাহিনী বিভক্ত হয়ে পড়ে।
ঙ. উপজাতীয় কোন্দল: ১০৩১ খ্রিস্টাব্দের পর সমগ্র স্পেনে অসংখ্য ক্ষুদ্র বংশের প্রতিষ্ঠা পায়। এ বংশগুলো ছিল মূলত ইয়ামেনি, সিরিয়ান, সুদানীয়, হিমারীয় ও বার্বার গোত্রভুক্ত। অধিকন্তু স্পেনে মুসলিম বিদ্বেষী জাতিগোষ্ঠী লোক বসবাস করতো। ফলে তাদের মাঝে সংঘর্ষ বাধে। প্রথম দিকে কঠোর হস্তে দমন করলেও শেষের দিকে শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে প্রাদেশিক গভর্নররা স্বাধীনভাবে শাসনকার্য চালায়।
চ. অর্থনৈতিক অবস্থা: স্পেনীয় মুসিলম
শাসকদের স্বর্ণযুগে রাজকোষ পরিপূর্ণ থাকলেও দূর্বল ও বিলাসপ্রিয় শাসকদের জন্য অতিদ্রুতই
তা শূন্য হয়ে যায়। ১০০৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় হিশামের সময় সৈন্যদের বেতন ভাতা প্রদানের
মতো কোনো অর্থ ছিল না। সুলতানদের বিলাসিতা ও নিজের পারিতোষিক প্রদান ও স্থাপত্য শিল্পে
অজস্র অর্থ ব্যয়ে রাজকোষ শূন্য হয়ে পড়ে।
ছ. ভৌগোলিক প্রতিকূলতা: স্পেন তথা আইবেরীয়
উপদ্বীপ বিশাল এলাকা জুড়ে অবস্থিত ছিল। কোনো শাসক পর্বত সঙ্কুল নদীবিধৌত ও প্রতিকূল
আবহাওয়া তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি ও কর্তৃত্ব বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি। Prof. S.
M. Imamuddin বলেন, "Due to physical feature the roads were zigzag and
could not serve for the swift movement of armies and the more so where the
journey were not safe in the time of war."
২. বৈদেশিক কারণ : স্পেনে উমাইয়া শাসন পতনের বৈদেশিক কারণগুলো উল্লেখ করা হলো-
ক. স্পেনে খ্রিস্টান আধিপত্য বিস্তার
: স্পেনে ফ্রান্সের কলোনি থাকলেও ফ্রান্সে স্পেনের মুসলমানদের কোনো কলোনি
ছিল না। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে স্পেনের ক্ষুদ্র রাজবংশের কারণে খ্রিস্টানরা আধিপত্য
বিস্তারে সক্ষম হয় এবং মুসলমানদের ক্ষমতা ও কৃর্তৃত্ব ক্রমশ স্তিমিত হতে থাকে।
খ. ওমর বিন হাফসুনের জাতীয়তাবাদী
আন্দোলন: স্পেনে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে ওমর বিন হাফসুন ফাতেমি
খলিফা ওবায়দুল্লাহ আল মাহদির সঙ্গে গোপন আতাত করে। ওমর বিন হাফসুন স্পেন হতে মুসলমানদের
বিতাড়িত করে স্পেনের ধর্মপ্রথা খ্রিস্টধর্ম কৃষ্টি, সংস্কৃতির পক্ষে জোরদার আন্দোলন
গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে দুর্বল শাসকদের সময় ওমর বিন হাফসুনের আন্দোলন স্পেনে মুসলিম বিদ্বেষী
আন্দোলনে রূপ নেয়।
গ. খ্রিস্টানদের জোট ও মুসলিমদের পতন: স্পেনে মুসলিম শাসনের পতনের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল দুটি ক. খ্রিস্টান রাষ্ট্র ক্যাস্টাইল ও খ. আরাগোনার জোট। স্পেন হতে মুসলমানদের চিরতরে বিতাড়িত করার জন্য তারা এ জোট গঠন করে। ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দ ক্যাস্টাইলের রানি ইসাবেলার সাথে আরাগনের রাজা ফার্ডিনান্ডের বিবাহ ছিল স্পেনের মুসলিম শাসনের জন্য একটি অশনিসংকেত। তারা যৌথভাবে মুসলমানদের স্পেন থেকে বিতাড়নে জন্য তাদের ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়েছিল। ১৪৮২ খ্রিস্টাব্দে গ্রানাডার শাসক সুলতান আলি আবু আল হাসান ক্যাস্টাইল আক্রমণ করলে পাল্টা আক্রমণে ফার্ডিনান্ড আল হামরা নগরী দখল করেন। সুলতানের পুত্র আল 'হামর তা পুনরুদ্ধার করেন। তবে ক্যাস্টাইল আক্রমণ করতে গিয়ে তিনি পরাজিত ও বন্দি হন। এ পর্যায়ে তারা গ্রানাডা আক্রমণ করে নগরীতে পানি ও রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। পরে খ্রিস্টানদের সাথে হাত মিলিয়ে দ্বাদশ মুহম্মদকে বিতাড়িত করে ক্ষমতা দখল করেন আবু আব্দুল্লাহ। তবে তিনিও শেষ পর্যন্ত রাজা ফার্ডিনান্ডের কাছে গ্রানাডা নগরী হস্তান্তর করেন। এভাবেই মুসলিম শাসনের যবনিকাপাত ঘটে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার
পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, স্পেনে উমাইয়া শাসনামল মুসলিম শাসনের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য
অধ্যায়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অযোগ্য শাসকের শাসনের ফলে স্পেনে মুসলিমদের, শক্তি হ্রাস
পেতে থাকে এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের আবির্ভাবের ফলে স্পেনে মুসলমানদের শক্তি দুর্বল
হয়ে পড়ে। অন্যদিকে খ্রিস্টানদের শক্তি বৃদ্ধির ফলে স্পেনে মুসলমানদের পতন ঘটে। তাই
খ্রিস্টীয় পনেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শেষ দিকে স্পেন থেকে তাদের বিতাড়িত হতে হয়। ১৬১০
খ্রিস্টাব্দ নাগাদ স্পেন মুসলিম শূন্য হয়ে যায়।
আরো পড়ুন পূর্ণাঙ্গ সাজেশন ও তার উত্তর একত্রে
স্পেনের মুসলমানদের ইতিহাস (৭১০-১৪৯২)