টুরসের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল বিশ্লেষণ কর।

টুরসের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল বিশ্লেষণ কর।

টুরস যুদ্ধের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল আলোচনা কর।

অথবা, টুরসের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল বিশ্লেষণ কর।

অথবা, টুরস যুদ্ধের তাৎপর্য ও ফলাফল উল্লেখ কর।

উত্তর ভূমিকা: মুসলিম স্পেনের ইতিহাসে টুরস যুদ্ধ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুসা বিন নুসাইর এবং তারিক বিন জিয়াদ কর্তৃক স্পেনে যে মুসলিম শাসনের ভিত্তি গড়ে উঠেছিল, পরবর্তীতে এ ধারা আরও প্রসারিত হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় স্পেনের গভর্নর আব্দুর রহমান আল গাফিকি (৭৩০-৭৩২ খ্রি.) ফ্রান্স বিজয়ের লক্ষ্যে ৭৩২ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স আক্রমণ করলে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা হয়। এ যুদ্ধে ফ্রান্সের খ্রিস্টানদের সমবেত আক্রমণ মুসলমানদের পরাজয় ঘটে। ইসলাম ও ইউরোপের ইতিহাসে এই যুদ্ধের ফলাফল ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।


টুরস যুদ্ধের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল: নিম্নে টুরস যুদ্ধের কারণ, 'ঘটনা ও ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

১. টুরস যুদ্ধের কারণ: ৭৩২ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত টুরস যুদ্ধের প্রেক্ষাপট হিসেবে নিম্নোক্ত কারণগুলো উল্লেখ করা যায়:

ক. আব্দুর রহমান আল গাফিকির সাম্রাজ্যবাদী নীতি: স্পেনের আমির আব্দুর রহমান আল গাফিকি অত্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী ছিলেন। Prof. S. M. Imamuddin বলেন, "আল গাফিকি ইতালি, জার্মানি ও গ্রিক সাম্রাজ্যকে ইউরোপের মুসলিম দখলকৃত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সাথে একত্রিত করার অসম্পূর্ণ কার্যকে সম্পূর্ণ করার উপযুক্ত ব্যক্তি রলে নিজেকে মনে করতেন।" এর ফলে তিনি ফ্রান্সে অভিযান প্রেরণের সিদ্ধান্ত নিলে টুরস যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

খ. বার্বার নেতা ওসমান বিন আবু নিসার বিদ্রোহ: দক্ষিণ ফ্রান্সের বার্বার নেতা ওসমান বিন আবু নিসা আকিতনের ডিউক ইউদেসের সাথে পারস্পরিক স্বার্থে একত্রিত হয়ে মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এমতাবস্থায় আব্দুর রহমান আল গাফিকি অনতিবিলম্বে একদল সৈন্যকে ফ্রান্সে প্রেরণ করেন।

গ. সম্পদ লাভ: ফ্রান্সে এ সময় সামন্তবাদী শাসন বিরাজমান ছিল। কোনো কেন্দ্রীয় শাসন না থাকায় মুসলমানরা সহজেই তাদের বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে প্রচুর সম্পদ লাভ করতে পারবে। এ উদ্দেশ্যেও তারা ফ্রান্স অভিযান করতে আগ্রহী হন।


ঘ. ইসলাম ধর্মের প্রসার: অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, সমগ্র ইউরোপে ইসলামের সুমহান বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে আব্দুর রহমান আল গাফিকি ফ্রান্সে অভিযান প্রেরণ করেন।

ঙ. মুসলমানদের পরাজয়ের: প্রতিশোধ তুলুস যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আব্দুর রহমান আল গাফিকি সৈন্য সংগ্রহ ও সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধি শুরু করলে টুরস যুদ্ধের পথ প্রশস্ত হয়।

চ. ফ্রান্সের নেতৃবৃন্দের একতা: মুসলমানদের রাজ্য সম্প্রসারণে ভীত হয়ে আকিতনের ডিউক ইউদেস তার পুরাতন শত্রু ফ্রান্সের যুবরাজ চার্লস মার্টেলের সাথে সন্ধি করেন। চার্লস মার্টেল মুসলমানদের বিরুদ্ধে অনেক সামন্তরাজা এবং সৈন্যদেরকে সংঘটিত করে তোলেন। ফ্রান্সের রাজা চার্লস মার্টেলের এসব প্রচেষ্টাও টুরস যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে।

ছ. আব্দুর রহমান আল গাফিকি কর্তৃক উত্তর ফ্রান্স আক্রমণ: আব্দুর রহমান আল গাফিকি উত্তর ফ্রান্সের আর্লেস জয় করেন। অতঃপর তিনি আকিতনের ডিউককে পরাজিত করেন; যা টুরস যুদ্ধের পথ প্রশস্ত করে।

২. টুরস যুদ্ধের ঘটনা: আব্দুর রহমান আল গাফিকি স্বীয় অবস্থান সুদৃঢ় করে উত্তরাঞ্চলে পইটিয়ার্সের দিকে প্রচন্ড বীর বিক্রমে অগ্রসর হন। মুসলিম বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য ইউদেস ও চার্লস মার্টেলের সন্ধি সম্পাদিত হয়। কিন্তু আব্দুর রহমান আল গাফিকির সামরিক গোয়েন্দা এ গোপন আঁতাতের সংবাদ দিতে ব্যর্থ হয়। ৭৩২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে খ্রিস্টান ও মুসলিম বাহিনী পইটিয়ার্স এবং টুরস মধ্যবর্তী থেকে সাড়ে ১২ মাইল দূরবর্তী লোয়াইর নদীর তীরে মুখোমুখি হন। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে উভয়পক্ষের ক্ষুদ্র বাহিনীর মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংর্ঘষ চলে এবং মুসলিম বাহিনী সাফল্য লাভ করে। কিন্তু এ সময় ফ্রান্সের পরাজয় নিশ্চিত ভেবে মুসলিম সেনারা গনিমত সংগ্রহে ব্যস্ত হলে সেনাদলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আব্দুর রহমান আল গাফিকি শৃঙ্খলা আনয়নে ব্যর্থ হন। যুদ্ধের দশম দিবসে ফরাসি বাহিনী মুসলিম শিবিরে প্রচন্ড আক্রমণ পরিচালনা করে। মুসলিম বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। আব্দুর রহমান আল গাফিকি টুরসের ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী যুদ্ধে শাহাদতবরণ করেন।

৩. টুরস যুদ্ধের ফলাফল নিম্নে টুরস যুদ্ধের ফলাফল আলোচনা করা হলো-

ক. মুসলিম বাহিনীর পরাজয়: টুরস যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটে। মুসলিম বাহিনীর মনোবল ভেঙে যায় এবং তাদের সমরাস্ত্র খ্রিস্টানদের হস্তগত হয়।

খ. মুসলিম সৈনিকদের হত্যা: আরব ঐতিহাসিকগণ টুরস যুদ্ধকে বালাতুস শুহাদা বা শাহাদতবরণকারীদের ক্ষেত্র বলে অভিহিত করেছেন। জিঘাংসার বশবর্তী হয়ে চার্লস মার্টেল মুসলিম সামরিক বাহিনীর আহত সৈন্যদের হত্যা করেন এবং হন্তা মার্টেল হিসেবে অভিহিত হন।

গ. ইউরোপের ভাগ্য নির্ধারিত হওয়া: টুরস এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইউরোপের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। এ যুদ্ধে পরাজয়ের পর মুসলিম বাহিনী পরবর্তীতে পিরেনিজের ওপারে অভিযান প্রেরণ করেননি। ফলে প্যারিস ও লন্ডনে অদ্যাবধি মসজিদের পরিবর্তে গির্জা এবং অক্সফোর্ড ও অন্যান্য শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে কোরআনের বদলে বাইবেল পঠিত হচ্ছে।

ঘ. ইউরোপে মুসলিম সাম্রাজ্য ব্যাপ্তির অন্তরায়: টুরস যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে ইউরোপের কেন্দ্রে ইসলাম প্রচার ও মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পরিসমাপ্তি ঘটে।

ঙ. আব্দুর রহমান আল গাফিকির মৃত্যু: টুরস যুদ্ধে আব্দুর রহমান আল গাফিকি পরাজিত ও নিহত হন। ফলে মুসলিম বাহিনী একজন দক্ষ প্রশাসক ও বীর সেনানায়ক হারায়।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে. ইউরোপের ইতিহাসে টুরস যুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আর এ যুদ্ধের ফলাফল অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত। কেননা, এ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের ফলে ইউরোপে মুসলিম সংস্কৃতি বিকাশের সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যায় এবং গড়ে ওঠে আধুনিক ইউরোপ। এই যুদ্ধ ছিল অনেকাংশে ইউরোপের ভাগা মীমাংসাকারী। ঐতিহাসিক আমির আলি বলেন, "There can be no question about that the battle was decisive in one respect." [A Short History of the Saracens.]

আরো পড়ুন পূর্ণাঙ্গ সাজেশন ও তার উত্তর একত্রে

স্পেনের মুসলমানদের ইতিহাস (৭১০-১৪৯২)


Post a Comment

Previous Post Next Post