আল-মুরাবিত কারা? স্পেনে তাদের শাসনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা কর ।

আল-মুরাবিত কারা? স্পেনে তাদের শাসনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা কর ।

মুরাবিতুন কারা? স্পেনে তাদের শাসনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা কর।

অথবা, মুরাবিতুন কারা? স্পেনে মুরাবিতুনদের শাসনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

উত্তর ভূমিকা: একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে স্পেনে উমাইয়া শাসকদের অযোগ্যতার ফলে উমাইয়া শাসন যখন পতনের মুখোমুখি তখন উত্তর আফ্রিকায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতাদর্শে সংঘবদ্ধ একটি আঞ্চলিক শক্তির উত্থানের মধ্য দিয়ে মুরাবিতুন বংশের প্রতিষ্ঠা হয়। পরবর্তীতে এই বংশের শাসক ইউসুফ বিন তাশফিনের শাসনামলে স্পেনে মুরাবিতুনদের শাসন শুরু হয় এবং স্পেন দীর্ঘদিন পর্যন্ত এ বংশের শাসনাধীনে থাকে। স্পেনে মুরাবিতুনদের শাসন ইসলামের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

মুরাবিতুন: আরবি শব্দ মুরাবিত অর্থ রাবাতে বা উপাসনালয়ে অবস্থানকারী ব্যক্তি, যিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারী। মুরাবিতুনগণের ধর্মীয় উপদেশ নিতে লোকজন রাবাতের আশপাশে সমবেত হতো। তারা মুলাচ্ছামিন নামেও পরিচিত ছিল। কারণ তাদের পূর্বপুরুষ সাহারার উত্তপ্ত হাওয়া থেকে বাঁচতে মুখমণ্ডল সবসময় কালো কাপড়ে আবৃত রাখত। মুরাবিহুনগণের উৎপত্তি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বিমত পাওয়া যায়। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, "মুরাবিতুনরা হিমারীয় গোত্রের লোক ছিল। তারা হযরত আবু বকর (রা.) এর খিলাফতকালে ইয়েমেন থেকে প্রথমে সিরিয়ায় এবং পরে আফ্রিকায় চলে যায়।" অন্যান্য ঐতিহাসিকের মতে, মুরাবিহুনগণ উত্তর আফ্রিকার সানহাজাহ গোত্রের শাসক ছিল। ১০০২ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের শাসক হাজিব আল মনসুরের মৃত্যুর পর স্পেনে উমাইয়াদের শাসন ও নিয়ন্ত্রণ লোপ পেতে থাকে। এরপর ১০৩৯ খ্রিস্টাব্দে উত্তর আফ্রিকার সানহাজাহ বার্বার গোত্রের ইয়াহিয়া বিন ইব্রাহিম মক্কায় হজ পালন করতে যান। তিনি কায়রোয়ানের মালেকি মাজহাবের বিখ্যাত ধর্মশাস্ত্রবিদ আবু ইমরান আল ফাসিকে অনুরোধ জানালে আব্দুল্লাহ বিন ইয়ামিনকে মরক্কোতে ধর্মপ্রচারে পাঠানো হয়। তিনি মরক্কোতে রাবাত নগরী নির্মাণ করে ধর্মপ্রচারের কাজে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তার শিষ্য ইয়াহিয়া বিন ওমরের নেতৃত্বে যুদ্ধবিদ্যা, ধর্মীয় জ্ঞান ও শৃঙ্খলাবোধের সমন্বয়ে তিনি বার্বারদের একটি শক্তিশালী বাহিনীরূপে গড়ে তোলেন। এসময় ইয়াহিয়া বিন ওমরের নেতৃত্বে বাবার বাহিনী ওয়াদিয়া ও সিজিলমাসা পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে সাহারার অনেক গভীরে প্রবেশ করে। এরপর ১০৫৯ খ্রিস্টাব্দে আবু বকর সৈন্যবাহিনীর দায়িত্ব নিয়ে ইদ্রিসি রাজ্য দখল করে নিজ নামে মুদ্রা চালু করেন। পরবর্তীতে আবু বকরকে নির্বাসিত করে ভ্রাতুষ্পুত্র ইউসুফ বিন তাশফিন ১০৬১ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতায় আসেন। তিনি ছিলেন এ বংশের শ্রেষ্ঠ নৃপতি।


স্পেনে মুরাবিতুনদের রাজত্বকাল: নিম্নে স্পেনে মুরাবিতুনদের রাজত্বকালের বর্ণনা দেওয়া হলো-

১. ইউসুফ বিন তাশফিনের রাজত্বকাল: নিম্নে ইউসুফ বিন তাশফিনের রাজত্বকাল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

ক. ইউসুফ বিন তাশফিনের ক্ষমতা গ্রহণ: ১০৬১ খ্রিস্টাব্দে মুরাবিতুন শাসক ইউসুফ বিন তাশফিনের শাসন ক্ষমতায় আসা উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনের মুসলমানদের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এসময় স্পেনের সার্বিক অবস্থা মুসলমানদের প্রতিকূলে ছিল। স্পেনে উমাইয়া বংশের শাসক হাজিব আল মনসুরের মৃত্যুর পর থেকেই রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি শুরু হয়। সেখানে মুসলিম শাসন ও মুসলমানদের উৎখাত করার জন্য সমগ্র খ্রিস্টান শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠে পড়ে লাগে। তারা ষষ্ঠ আলফান্সোর নেতৃত্বে মুসলিম রাজ্যগুলোতে ব্যাপক অভিযান, হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা ১০৮৫ খ্রিস্টাব্দে টলেডো অবরোধ করে। তারা কর্ডোভা ও সেভিলেও একই ধরনের অত্যাচার শুরু করে। এ অবস্থায় সেভিলের বনু আব্বাদ বংশের শাসক আল মুতামিদ ও অন্যান্য মুসলিম নেতৃবৃন্দ আফ্রিকার মুরাবিতুন শাসক ইউসুফ বিন তাশফিনকে স্পেনে আমন্ত্রণ জানান।


খ. স্পেনে প্রথম অভিযান: স্পেনের মুসলমানদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১০৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইউসুফ বিন তাশফিন ২০,০০০ সৈন্যসহ স্পেনে পৌছান এবং জাল্লাকার যুদ্ধে ষষ্ঠ আলফান্সোর নেতৃত্বে ৬০,০০০ খ্রিস্টান বাহিনীকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধ ছিল স্পেনের মুসলিম শাসকগণের ভাগ্য নির্ধারণকারী যুদ্ধ। এরপর আলফান্সো মাত্র ৩০০ সৈন্যসহ পলায়ন করেন। এই যুদ্ধের পর স্পেনবাসীদের কাছে ইউসুফ বিন তাশফিন গভীর শ্রদ্ধা ও আস্থা অর্জন করেন। ইউসুফ বিন তাশফিন নিজের প্রতিনিধি রেখে উত্তর আফ্রিকায় ফিরে যান।

গ. স্পেনে দ্বিতীয় অভিযান: ইউসুফ বিন তাশফিন উত্তর আফ্রিকায় ফিরে গেলে খ্রিস্টানরা পুনরায় অত্যাচার শুরু করে। তারা মুর্সিয়া, লোরসা ও আলমেরিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে। তারা মাত্র ৭০০ সৈন্য নিয়ে মুতামিদের ৩,০০০ সৈন্যকে পরাজিত করে। এসময় ইউসুফ বিন তাশফিন দ্বিতীয়বার স্পেনে আসেন এবং টলেডোতে চার মাস অবরোধ করেন। পরে গ্রানাডা দখল করে সেখানে প্রতিনিধি আবু বকরকে শাসনের দায়িত্ব দিয়ে মরক্কো ফিরে যান।


ঘ. আবু বকরের স্পেন শ্বাসন: ইউসুফ বিন তাশফিন মরক্কো প্রত্যাবর্তন করলে স্পেনের আঞ্চলিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়। সেভিলের শাসক মুতামিদসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম রাজ্যগুলো ইউসুফ বিন তাশফিনের প্রতিনিধি আবু বকরের শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তারা ইতিপূর্বে মুরাবিতুন শাসক ইউসুফ বিন তাশফিনের সাহায্যের কথা ভুলে গিয়ে ইউসুফ বিন তাশফিনের প্রতিনিধি গ্রানাডার গভর্নর আবু বকরকে। বিতাড়নের জন্য খ্রিস্টানদের সাথে ঐক্যজোট হয়ে পরিকল্পনা। প্রস্তুত করে। এসময় এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনের উলামাগণ আবু বকরকে সমর্থন জানায়। আবু বকর সেভিল অবরোধ করলে সেভিলের শাসক মুতামিদ ক্যাস্টাইলের খ্রিস্টানদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ১০৯০ খ্রিস্টাব্দে সুদক্ষ আবু বকর মুতামিদের বাহিনী ও ক্যাস্টাইলের খ্রিস্টানদের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে সেভিল অধিকার করেন। মুতামিদের পুত্র মুতাজ ও রাজি মারতোলা ও রোনডা অঞ্চল মুরাবিতুনদের শাসনাধীনে হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। বনু আব্বাদ বংশের পতনের পর ১১০২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আলমেরিয়া, মুর্বিয়া, দেনিয়া, ব্যটাভিয়া, বাদাজোজ এবং ভ্যালেন্সিয়াসহ ১৩টি ক্ষুদ্র মুসলিম রাজ্য মুরাবিতুন শাসনের করদরাজ্যে পরিণত হয়।

২. আলি বিন ইউসুফের শাসনাধীনে স্পেন: ১১০৭ খ্রিস্টাব্দে ইউসুফ বিন তাশফিনের মৃত্যুর পর পুত্র আলি বিন ইউসুফ ক্ষমতায় আসেন। তিনি পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। আলি বিন ইউসুফ স্পেনে কয়েকবার খ্রিস্টানদের পরাজিত করেন। তিনি আলভিরা, মাদ্রিদসহ অন্যান্য শহর ও দুর্গ অধিকার করেন। তিনি যোগ্য ও অভিজ্ঞদের স্পেনের গভর্নর নিযুক্ত করেন। ১১১০ খ্রিস্টাব্দে আলি বিন ইউসুফের ভাই তামিম স্পেনের সারাগোসা দখল করেন। কিন্তু তামিমের মৃত্যুর পর সারাগোসাসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো খ্রিস্টানদের অধিকারে চলে যায়। এসময় এক শক্তিশালী বাহিনীসহ আলি বিন ইউসুফ স্পেনে প্রবেশ করলেও গোলযোগের কারণে উত্তর আফ্রিকায় ফিরে যান।


৩. পরবর্তী শাসকদের শাসনকাল: ১১৪৫ খ্রিস্টাব্দে আলি বিন ইউসুফের মৃত্যুর পর স্পেনে কিছু মুরাবিতুন গভর্নর বেলারিক দ্বীপপুঞ্জসহ কিছু অঞ্চলে স্বাধীনভাবে শাসন করছিল। আলি বিন ইউসুফের পর তাশফিন, ইব্রাহিম ও ইসহাকের মতো কয়েকজন দুর্বল শাসক শাসন করলেও ততদিনে স্পেনে মুরাবিতুনদের করদরাজ্যগুলো উত্তর আফ্রিকার কেন্দ্রীয় শাসন থেকে স্বাধীন হয়ে যায়।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, স্পেনে উমাইয়া শাসনের শেষ দিকে এবং ইউরোপে ক্রুসেডময় পরিস্থিতিতে উত্তর আফ্রিকায় মুরাবিতুন বংশের উত্থান একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ইউসুফ বিন তাশফিনের মাধ্যমে এ বংশের রাজ্যসীমা উত্তর আফ্রিকা ছাড়িয়ে স্পেনের গুরুত্বপূর্ণ নগরী কর্ডোভা, মাদ্রিদ, আলভিরা এবং ১৩টি ক্ষুদ্র মুসলিম রাজ্যের সীমা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। কিন্তু পরবর্তীতে দুর্বল শাসকদের শাসনাধীনে ১১৪৬ খ্রিস্টাব্দে মুয়াহিদুনদের হাতে এ বংশের শাসনের অবসান ঘটে।

আরো পড়ুন পূর্ণাঙ্গ সাজেশন ও তার উত্তর একত্রে

স্পেনের মুসলমানদের ইতিহাস (৭১০-১৪৯২)

 

Post a Comment

Previous Post Next Post