শাসক হিসেবে দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর ।

শাসক হিসেবে দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর ।

প্রশাসক হিসেবে দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর।

অথবা, শাসক হিসেবে দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর।

অথবা, শাসক হিসেবে দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের কৃতিত্ব বিচার কর।

উত্তর ভূমিকা: ৮২২ খ্রিস্টাব্দে আমির প্রথম হাকামের মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় আব্দুর রহমান স্পেনের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তখন তার বয়স ছিল ৩১ বছর ৩ মাস। শৌর্যবীর্য ও পাণ্ডিত্যে তার প্রতিভা ছিল অতুলনীয়। ঐতিহাসিক লেনপুলের মতে, "তার রাজত্বকালে শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজ করলেও বস্তুত * তিনি নিষ্কণ্টক ছিলেন না।" বিভিন্ন বিদ্রোহ তাকে বিব্রত করে। কিন্তু অসীম সাহসিকতা, রণনৈপুণ্যতা এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দ্বারা তিনি সাম্রাজ্যে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। বিদ্রোহ দমন করা ছাড়াও তিনি প্রশাসনিক সংস্কারেও যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন।


প্রশাসক হিসেবে দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের কৃতিত্ব: দ্বিতীয় আব্দুর রহমান অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক শত্রুর বিদ্রোহ দমনের পাশাপাশি প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। নিম্নে প্রশাসক হিসেবে দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের কৃতিত্বসমূহ আলোচনা করা হলো-

১. প্রশাসনিক বিন্যাস: আমির দ্বিতীয় আব্দুর রহমান আব্বাসি শাসনব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে শাসন পরিচালনা করেন। তিনি কেন্দ্র ও প্রদেশের শাসনব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয়সাধন করে যোগ্য ব্যক্তিদেরকে প্রদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ দেন। এ শাসনকর্তাগণ অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে প্রদেশের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন বলে সাম্রাজ্যে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছিল।

২. শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন: দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের শাসনব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখা দেয়। এ কারণে তিনি শিল্পী, জ্ঞানীগুণীদের অকাতরে উপঢৌকন দিতে পারতেন। তিনি তার নিজস্ব তহবিল থেকে প্রখ্যাত সংগীত বিশারদ জিরাবকে পুরষ্কার দেন। ইবনে সাদের মর্তে, "সুষ্ঠু রাজস্ব আদায়ের ফলে রাষ্ট্রের আয় ৬,০০,০০০ থেকে ১০,০০,০০০ দিনারে উন্নীত হয়।"

৩. অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন: দ্বিতীয় আব্দুর রহমান অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য একটি টাকশাল স্থাপন করেন এবং সেখান থেকে বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা জারি করেন। তিনি রাজকীয় সিল প্রচলন করেন যাতে ফরমান এবং সরকারি নথিপত্র জাল না হতে পারে। গ্রিক কূটনীতিবিদ তার রাজত্বকালে কর্ডোভার সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য সম্বন্ধে বিশদ বিবরণ দেন। তার ভাষায়, গোয়াদাল কুইভার নদীর তীরে সারি সারি সুন্দর অট্টালিকা শোভা পেত। কর্ডোভা নগরীর অন্যতম আকর্ষণ ছিল উদ্যানসমূহ, যা নগরীর শোভা বৃদ্ধি করে। সিয়েরামোরেনা থেকে পানি পাম্পের সাহায্যে কর্ডোভা নগরীতে আনা হতো এবং পানি সরবরাহ ছিল খুবই সন্তোষজনক।

৪. সামরিক সংস্কার সাধন: দ্বিতীয় আব্দুর রহমান সামরিক সংস্কারেও যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তিনি যুবরাজ মুহম্মদ এবং হাজিব আব্দুল করিম বিন মুগিসকে সমরাভিযানের দায়িত্ব দেন। দ্বিতীয় আব্দুর রহমান পিতার নীতি অনুসরণ করে দেহরক্ষী দল পুনর্গঠন করেন এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করেন।

৫. বিচার বিভাগের সংস্কার: আমির দ্বিতীয় আব্দুর রহমান জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবার সুবিচার নিশ্চিত করেন। প্রখ্যাত ফকিহ ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়া বিচারকার্যে আমিরকে সাহায্য করতেন। এসময় অভিযুক্তদেরকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হতো।

৬. যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন: আমির রাজ্যের যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে সর্বত্র রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্ট নির্মাণ করেন। তার সময়ে যাতায়াত ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয় এবং সমগ্র রাজ্যব্যাপী রাস্তা নির্মিত হয়। এর ফলে গুপ্তচরদের মাধ্যমে তিনি খবরাখবর পেতেন এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি বিদ্রোহ দমন করতে পারতেন।

৭. স্থাপত্যকলার উন্নতি সাধন: শিল্পকলা ও সাহিত্যের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দ্বিতীয় আব্দুর রহমান বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন। তিনি রাজ্যের বিভিন্ন শহরে প্রাসাদ, দফতর ও উদ্যান নির্মাণ করেন। রাস্তাঘাট মার্বেল পাথর দিয়ে সুসজ্জিত করেন। রাজ্যের সর্বত্র মসজিদ, মাদরাসা, সরাইখানা ও সেতু নির্মিত হয়। তিনি স্থাপত্যশিল্পের উৎকর্ষতার জন্য বহু স্থপতি ও কারিগর নিযুক্ত করেন। স্থাপত্যকলায় তার শ্রেষ্ঠ অবদান রয়েছে প্রথম আব্দুর রহমান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কর্ডোভার জামে মসজিদের সম্প্রসারণ। ক্রেসওয়েল বলেন যে, দ্বিতীয় আব্দুর রহমান ১০টি খিলান সারি এবং ১১টি আইল বিশিষ্ট লিওয়ানটি দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ কিবলার দিকে সম্প্রসারিত করেন। তিনি প্রথম হিশাম কর্তৃক স্থাপিত মিনারে একটি কিয়স্ক বা চূড়া এবং উপরে ওঠার সিড়ি নির্মাণ করেন।

৮. জ্ঞানের সম্প্রসারণ: দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় তার কর্মচারীগণ এবং সংগ্রহকারীগণ প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে মূল্যবান গ্রন্থাবলি সংগ্রহ করতো। এ সমস্ত গ্রন্থাবলি কর্ডোভার উমাইয়া গ্রন্থাগারকে সমৃদ্ধ করে।

৯. শিক্ষা ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক: Prof. S. M. Imamuddin বলেন, "No aspect of life was ignored by the Amir. Reforms were introduced in dress and the mode living." অর্থাৎ, আমির জীবনের কোনো দিকই অবজ্ঞা করতেন না। পোশাক-পরিচ্ছদ এবং জীবনযাত্রার প্রণালিতে নানা ধরনের বৈচিত্র্য আনা হয়। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে তিনি বাগদাদ থেকে ঔষধ আমদানি করতেন। তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির জন্যে গ্রিক ও পারস্য থেকে সংগ্রহ করা চিকিৎসাশাস্ত্র আরবিতে অনূদিত করার ব্যবস্থা করেন। এসব গ্রন্থাবলি শুধু চিকিৎসকদের ব্যবহারিক জ্ঞানলাভের সহায়তা করেনি; বরং শিক্ষার্থীদের চিকিৎসাবিজ্ঞানে গভীর জ্ঞান অর্জন সম্ভবপর হয়। দ্বিতীয় আব্দুর রহমান জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নয়নে যে পৃষ্ঠপোষকতা করেন তার ফলেই পরবর্তীকালে তৃতীয় আব্দুর রহমান ও দ্বিতীয় হিশামের সময় মুরদের স্বর্ণযুগের সূত্রপাত হয়।


উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে. প্রশাসক হিসেবে আমির দ্বিতীয় আব্দুর রহমান ছিলেন স্পেনে উমাইয়া আম্রিাতের একজন সুযোগ্য শাসক। সিংহাসনে আরোহণের পরপরই বহু বিদ্রোহ দমন করে তিনি সাম্রাজ্যে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন এবং সাম্রাজ্যের উন্নতি বিধানকল্পে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যকলাপ সম্পাদন করেন। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক সংস্কার, সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা প্রণয়ন করে তিনি তার যোগ্যতার প্রমাণ দেন। তাই ইসলামের ইতিহাসে প্রশাসক হিসেবে আমির দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের কৃতিত্ব চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

আরো পড়ুন পূর্ণাঙ্গ সাজেশন ও তার উত্তর একত্রে

স্পেনের মুসলমানদের ইতিহাস (৭১০-১৪৯২)

Post a Comment

Previous Post Next Post