সুদ ও মুনাফার পার্থক্য
সুদ ও মুনাফা এক বিষয় নয়, অভিন্নও নয়। বরং প্রকৃতি, পদ্ধতি, প্রতিক্রিয়া, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এবং বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বিবেচনায় সুদের সঙ্গে মুনাফার বিপুল পার্থক্য রয়েছে। জাহিলিয়া যুগে সুদের সঙ্গে মুনাফাকে মিলিয়ে ফেলা হয়েছিল। সুদকে তখন মুনাফাই মনে করা হতো। আধুনিক যুগেও এমন একটি অপচেষ্টা লক্ষ করা যায়। কেবল পরিভাষাগত পরিবর্তন সাধন করে সুদকে এখন লাভ বা মুনাফা বলে চালিয়ে দেয়া হয়।
বলা হয়, ব্যবসায় যেমন অর্থ বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জিত হয়, সুদেও তেমনি অর্থই বিনিয়োগ করা হয়। দুটোই অর্থ বিনিয়োগের ফলশ্রুতি, অতিরিক্ত অর্জন। কাজেই এতদুভয়ের মধ্যে পার্থক্য করা যায় না। কিন্তু প্রকৃত কথা হলো আদর্শ, দর্শন, বিশ্বাস ও প্রক্রিয়াগত বিবেচনায় সুদের সঙ্গে মুনাফার দূরতম সম্পর্কও নেই। সুদ ও মুনাফা সম্পূর্ণ আলাদা, বিপরীতধর্মী দুটি বিষয়। বিষয়টি বিভিন্নভবে বিশ্লেষণ করা যায় ।
১. হারাম-হালাল : সুদ হারাম। কুরআন-হাদীস
দ্বারা এর হারাম হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত এবং সর্বজনস্বীকৃত। অন্যদিকে, মুনাফা হালাল।
কুরআন-হাদীস এর হালাল হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করে। সব সাহাবী (রা.) তাবি'ঈ, তাবি তাবিঈ
এবং মুজতাহিদ মুনাফা গ্রহণ করেছেন।
২.ঝুঁকি : সুদ একটি নিশ্চিত,
নিরাপদ ও ঝুঁকিহীন আয়। কোনো কারণেই তা পাওয়া অনিশ্চিত নয়। অন্যদিকে, মুনাফা একটি
ঝুঁকিপূর্ণ, অনিশ্চিত প্রাপ্তি। এটি পাওয়া সম্ভব হতে পারে, নাও হতে পারে।
৩. লাভের পক্ষ : সুদ হলো এক পক্ষের লাভ।
কেবল ঋণদাতা সুদের টাকা পায় । ঋণগ্রহীতার এতে কোনো অংশ থাকে না। সে শুধু ঋণদাতার লাভ
নিশ্চিত করে। অন্যদিকে, মুনাফা কখনই এক পাক্ষিক নয়। ক্রেতা মুনাফা পায় পণ্যে আর বিক্রেতা
মুনাফা পায় পণ্যের বিক্রিতে। কোনো পক্ষই বঞ্চিত হয় না ।
৪. শ্রম : সুদ অর্জিত হয়
বিনাশ্রমে। এ জন্য আলাদা করে বুদ্ধি, শ্রম, দক্ষতা, বিনিয়োগ করতে হয় না। অন্যদিকে,
মুনাফার জন্য আর্থিক মূলধন ছাড়াও বুদ্ধি, শ্রম, দক্ষতা, সময় প্রভৃতি বিনিয়োগ করতে
হয়।
৫. একাধিক লাভ : একই বিনিয়োগ থেকে চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ লাভ করা যায় বারবার । ভাগ অন্যদিকে, একটি পণ্য বিক্রি করে বা একটি বিনিয়োগ থেকে সাধারণত মুনাফা আসে একবার ।
৬. হার পুনঃনির্ধারণ : সুদের হার যে
কোনো সময় পুনঃনির্ধারণ করা যায়। অন্যদিকে, কোনো একটি পণ্য বা ব্যবসায়ে একবার মুনাফা
ধার্য করে বিক্রি সম্পন্ন করার পর মুনাফা পুননির্ধারণের সুযোগ নেই ।
৭. মূলধন : সুদ গ্রহণের
পরও মূলধন অবশিষ্ট থাকে। অন্যদিকে, মুনাফা অর্জনের জন্য পণ্য ও মূল্য বিনিময় হলেই
কারবার শেষ হয়ে যায়।
৮. শোষণ: সুদ শোষণের হাতিয়ার।
অন্যদিকে, মূনাফা শোষণ প্রতিরোধ করে।
৯. দারিদ্র্য: সুদ নিঃস্বকে আরো নিঃস্ব, দরিদ্রকে
আরো দরিদ্র করে। অন্যদিকে, মুনাফা নিঃস্বকে সচ্ছল করে, দরিদ্রকে স্বাবলম্বী করে তোলে
।
১০.সামাজিক স্থিতিশীলতা: সুদ সামাজিক
স্থিতিশীলতা নষ্ট করে। অন্যদিকে, মুনাফা সমাজকে স্থিতিশীল করে।
১১. অর্থব্যয়: সুদ মানুষকে
কৃপণ বানায়। অন্যদিকে, মুনাফা মানুষকে মিতব্যয়ী ও দানশীল ব্যক্তিতে পরিণত করে।
১২. জনকল্যাণ: সুদ মানুষকে
জনকল্যাণে অর্থ ব্যয়ে নিরুৎসাহিত করে। অন্যদিকে, মুনাফা মানুষকে জনকল্যাণমূলক কাজসমূহ
করার উৎসাহ যোগায় ।
১৩. পরনির্ভরতা: সুদের পাকে-চক্রে
পড়ে সুদের ঘানি টেনে টেনে গরিব ও মধ্যবিত্তরা সর্বহারা হয়। অন্যদিকে, মুনাফা সমাজের
সব শ্রেণির লোককে স্বনির্ভরতার পথ দেখায় ।
১৪. ব্যক্তিগত শান্তি ও স্বস্তি: সুদ ঋণগ্রহীতার
শান্তি ও স্বস্তি নষ্ট করে। অন্যদিকে, মুনাফা ব্যক্তির মনে শান্তি, স্বস্তি ও নির্ভরতা
নিয়ে আসে ।
১৫. ধনী-গরিব সম্পর্ক: সুদ ধনী গরীবের
মধ্যে শত্রুতা ও ঘৃণার সম্পর্ক তৈরি করে। অন্যদিকে, মুনাফা ক্রেতা-বিক্রেতা ও অন্যান্যদের
মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
১৬. সামাজিক ভূমিকা: সুদ সামাজিক
অবক্ষয় তৈরি করে। সুদের অভিশাপ মানুষকে নানা অপকর্মে জড়িত হতে বাধ্য করে। অন্যদিকে,
মুনাফা মানুষকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করে ।
১৭. অত্যাচারে ভূমিকা: সুদ জুলুমের
বাহন। যে কোনো মূল্যে সুদ আদায়ের প্রচেষ্টা মানুষকে জালিমে পরিণত করে। অন্যদিকে, মুনাফা
ইনসাফের বাহন। পারস্পরিক সম্মতিতে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে মুনাফা ধার্য করা হয়ে থাকে
।
১৮. মানবতার দৃষ্টিভঙ্গি: সুদ মানবিকতা
বিরোধী। এর সঙ্গে জড়িত থাকে লোভ, স্বার্থপরতা প্রভৃতি। অন্যদিকে, মুনাফা মানবতার সমার্থক।
এর সঙ্গে জড়িত থাকে দায়িত্বশীলতা ও সহযোগিতা।
১৯. বিনিয়োগে ভূমিকা: সুদ বিনিয়োগে
স্থবিরতা এনে দেয়। মানুষ সুদের আশায় ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করে না। অন্যদিকে, মুনাফা
বিনিয়োগের দ্বার খুলে দেয়। মানুষ সাধ্যমত বিনিয়োগ করতে থাকে।
২০. উৎপাদনের ভূমিকা: সুদ উৎপাদনের
বিরাট বাধা। নিরাপদ ও ঝুঁকিহীন আয়ের আশায় মানুষ সুদে বিনিয়োগ করে। অন্যদিকে, মুনাফা
উৎপাদন বাড়ায়। কেননা মুনাফার জন্য মানুষকে উৎপাদন করতে হয়।
২১. মূলধনে ভূমিকা: সুদ মূলধনে স্থবিরতা সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, মূলধনে গতি নিয়ে আসে মুনাফা।
২২. দ্রব্যমূল্য নির্ধারণে ভূমিকা : সুদ দ্রব্যমূল্য বাড়ায়। কেননা উৎপাদনকারী নিজস্ব মুনাফা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দ্রব্যে সুদের হারও যোগ করে। অন্যদিকে, দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখে ।
২৩. মুদ্রাস্ফীতিতে ভূমিকা: সুদ মুদ্রাস্ফীতি ঘটায়। অন্যদিকে, মুনাফা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে।
২৪. কর্মসংস্থানে ভূমিকা : সুদ বেকারত্ব
বাড়ায়। কেননা সুদে বিনিয়োগ ও উৎপাদন হ্রাস পায়। কল-কারখানা স্থাপন কমে যায়। অন্যদিকে,
মুনাফা শিল্পায়নে গতি আনে ৷ নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়। ফলে কর্মসংস্থান হয়।
২৫. মজুরি নির্ধারণে ভূমিকা : সুদ মজুরি হ্রাস
করে। সুদে কর্মসংস্থান কমে যায় বলে চাহিদার চেয়ে শ্রমিক বেশি হয়। অন্যদিকে, মুনাফা
ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করে। কেননা মুনাফা বাড়ায় উৎপাদন, আর উৎপাদনে তৈরি হয় নতুন
নতুন কাজের সুযোগ ৷
২৬. ধার্যকরণ নীতিতে পার্থক্য : ঋণের ওপর সময়ের
ভিত্তিতে সুদ অর্জিত হয়। অন্যদিকে, ক্রয় বিক্রয় বা ব্যবসার স্বাভাবিক ফল হিসেবে
মুনাফা অর্জিত হয় ৷
২৭. লোকসানের ঝুঁকিগত পার্থক্য : সুদে লোকসানের
ঝুঁকি বহন করতে হয় না। অন্যদিকে, মুনাফা অর্জনে লোকসানের ঝুঁকি আছে।
২৮. হার নির্ধারণগত পার্থক্য : সুদ পূর্ব নির্ধারিত
ও নিশ্চিত। সুদের হার কখনো শূন্য হয় না। মুনাফা অনির্ধারিত ও অনিশ্চয়তাপূর্ণ । অন্যদিকে,
মুনাফা কম-বেশি হতে পারে বা ঋণাত্মক হতে পারে। মুনাফার হার শূন্যও হতে পারে।
২৯. পক্ষগত পার্থক্য : সুদের পক্ষ দুটো
হলো ঋণ দাতা ও ঋণগ্রহীতা। অন্যদিকে, মুনাফার পক্ষসমূহ হলো ক্রেতা বা বিক্রেতা বা উৎপাদনকারী।
৩০. পণ্যের সঙ্গে সম্পর্কগত পার্থক্য
:
সুদের সঙ্গে পণ্য বা পণ্যের মূল্য জড়িত থাকে না। অন্যদিকে, মুনাফার সঙ্গে পণ্য বা
পণ্যের মূল্য জড়িত থাকে।
৩১. বিনিময়গত পার্থক্য : সুদের কোনো বিনিময়
নেই। অন্যদিকে, মুনাফায় বিনিময় হলো মাল ।
বস্তুত সুদ ও মুনাফার মূল পার্থক্য হলো
সুদ মানবতার সম্পূর্ণ বিরোধী আর মুনাফা মানবতার সমর্থক। সুদের মাধ্যমে সমন্বিত উন্নয়ন
ও সুষম অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা অকল্পনীয় ব্যাপার আর মুনাফার মূল লক্ষ্যই হলো সামগ্রিক
উন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জন করা। মানুষের শান্তিপূর্ণ অর্থনৈতিক জীবন-যাপনের স্বার্থে তাই
সুদ নির্মূল করা কর্তব্য।