১৯৭১: পাকিস্তানি কারাগারে শেখ মুজিব
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সারাদিনই শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডিতে তার ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতেই কাটিয়েছেন। ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগীদের সাথে আলোচনা করেই তার সময় কাটছিল। বাড়ির নিচ তলায় লাইব্রেরীতে বসে যাদের সাথে রাজনীতি আলাপ করছিলেন তারা হচ্ছেন তাজউদ্দীন আহমেদ, এইচ এম কামরুজ্জামান, মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, গাজী গোলাম মোস্তফা এবং ডঃ কামাল হোসেন।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি
কোন দিকে মোড় নিতে পারে এবং সম্ভাব্য পদক্ষেপ কি হতে পারে এসব নিয়েই তাদের মধ্যে আলোচনা
চলছিল। কারণ ইয়াহিয়া খানের সাথে আলোচনা এরই মধ্যে ব্যর্থ হয়েছে । ২৫ শে মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে ছিল রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আনাগোনা। শেখ
মুজিবুর রহমান সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছিলেন এবং তারা একে একে বিদায়ও নিচ্ছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের জামাতা এবং শেখ হাসিনার স্বামী ডক্টর ওয়াজেদ মিয়া তখন সে বাড়িতে
অবস্থান করছিলেন। তখনকার ঘটনা প্রবাহ ওয়াজেদ মিয়ার একটি বইতে উঠে এসেছে।
ওয়াজেদ মিয়া বলেন ২৫ শে মার্চ সন্ধ্যে ৭:০০ টার আগেই একে একে আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য অঙ্গ দলের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে তার নির্দেশ নিয়ে চলে যান। ডক্টর ওয়াজেদ মিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী ২৫ শে মার্চ রাত এগারোটায় শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তার বাসার বাসার সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে কথা হয়েছিল তৎকালীন ছাত্রলীগের তিন প্রভাবশালী নেতার সাথে, এরা ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আ স ম আব্দুর রব ও শাজাহান সিরাজ।
২৫ শে মার্চ
শেখ মুজিবুর রহমান যখন তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের সাথে আলাপ করছিলেন তখন তাদের মনে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল যে সেদিন রাতেই কিছু একটা
ঘটতে পারে,।সেজন্য রাজনৈতিক সহকর্মীদেরও নির্দেশনা দেন শেখ মুজিবুর রহমান।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক মইদুল আহসান তার মূল ধারা ৭১ বইতে লিখেছেন, ২৫ শে মার্চের সন্ধ্যায় যখন পাকিস্তানি আক্রমণ অত্যাশুন্য তখন শেখ মুজিব তাজউদ্দীনকে ঢাকার শহরতলীতে আত্মগোপন করার নির্দেশ দেন যাতে শীঘ্রই তারা পুনরায় একত্রিত হতে পারেন।
মুজিবকে নিয়ে
পাকিস্তানিদের চিন্তা -
২৫ মার্চ
বেলা ১১ টার দিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের
জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার অফিস টেলিফোন বেজে ওঠে। টেলিফোনের অপরপ্রান্তে
ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল
টিক্কা খান। টিক্কা খান টেলিফোনে খাদেম হোসেন রাজাকে বলেন খাদিম এটা আজি হবে তখন খাদেম
হোসেন রাজার পাশে বসা ছিলেন আরেক সামরিক কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক।
উইটনেস টু
সারেন্ডার বইতে সিদ্দিক সালিক লিখেছেন টিক্কা খানের টেলিফোন খাদিম হোসেন রাজার মধ্যে
কোন উত্তেজনা তৈরি করেনি তিনি হাতুড়ি পেটানোর জন্য তৈরি ছিলেন।
নিয়ম অনুযায়ী
খাদিম হোসেন রাজা সে আদেশ পৌঁছে দেন আরো নিচের দিকে। অর্থাৎ তার অধীনস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের
কাছে। মুজিবকে আটকের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। গ্রেফতারের সময় নির্ধারণ
করা হয়েছিল রাত একটা সময়। কারণ এই সময়ের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নিরাপদে
ঢাকা থেকে করাচি পৌঁছে যাবেন।
অপারেশন সার্চলাইট নামে বাঙ্গালীদের উপর গণহত্যা চালানোর পরিকল্পনাও করা হয়ে এ সময়। একদিকে গণহত্যা চালানো অন্যদিকে শেখ মুজিবকে আটকের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত পাকিস্তানি বাহিনী। শেখ মুজিবুর রহমানকে আটকের জন্য রাত ১১:৩০ এর দিকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে সৈন্যরা বেরিয়ে যায়।
কারণ রাত একটার মধ্যে মুজিবের বাড়িতে পৌঁছাতে হবে তাদের। পথে যাবার সময় কিছু
প্রতিরোধ হতে পারে এমন একটা ধারণা ছিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর। ক্যান্টনমেন্ট থেকে
বেরিয়ে ফার্মগেট আসা মাত্রই তারা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছিল। রাস্তায় কাজ পেলে সে
প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে জয় বাংলা স্লোগান দেওয়া হচ্ছিল। সেখানে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে
সৈন্যরা শেখ মুজিবের বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
শেখ মুজিবকে আটক করতে গিয়েছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তৎকালীন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জেড এ খান এবং মেজর বিল্লাল । সিদ্দিক সালিক লিখেছেন শেখ মুজিবের বাড়িতে প্রায় ৫০ জন সৈন্য প্রবেশ করেন। বাড়ির কম্পাউন্ডে ঢুকে স্টেন গানের গুলি চালিয়ে সৈন্য তাদের উপস্থিতি জানান দেয় তারা চিৎকার করে মুজিবকে বেরিয়ে আসতে বলে কিন্তু বাড়ির ভেতর থেকে কোন সারা মেলেনি।
সৈন্যরা এই সময় দরজা লক্ষ্য করে গুলি চালায় তখন মুজিব ভিতর থেকে বেরিয়ে আসেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি এটার জন্য তৈরি ছিলেন। এর কয়েক মিনিট পরেই ৫৭ ব্রিগেডের মেজের জাফর ওয়্যারলেস এ বলেন বড় পাখিটা খাঁচায় বন্দি অন্যরা তাদের বাসায় নেই।
সে বাড়ি থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কে আটক করে আর্মির গাড়িতে করে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। এ কিছুক্ষণ পর শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি আর্মি জিপে করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট আনা হয়। এ সময় মুজিবের গায়ে একটি সাদা জামা ছিল বলে উল্লেখ করেন মিস্টার সালেক সে রাতে শেখ মুজিবকে আদমজী স্কুলে বন্দী করে রাখা হয়।
এরপর
দিন তাকে নেওয়া হয় ক্যান্টনমেন্টের ফ্লাট স্টাফ হাউসে। সেখানে ছয় দিন বন্দি থাকার
পর শেখ মুজিবুর রহমানকে রাউল পিন্ডি নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে মিয়ানওয়ালি কারাগারে
বন্দী করা হয়। শেখ মুজিবকে আটকের পর তার ভাগ্যে কি ঘটেছে সে সম্পর্কে পরিবারের কোন
ধারনা ছিল না। এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে তারা জানতে পারেন যে মুজিবকে করাচি নিয়ে যাওয়া
হয়।
ডক্টর ওয়াজেদ মিয়া তার বইতে লিখেছেন, একদিন পত্রপত্রিকায় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর দুজন কর্মকর্তা প্রহরত অবস্থায় বিমানবন্দরের লাউঞ্জে তোলা বঙ্গবন্ধুর ফটো সরকারের নির্দেশনায় প্রকাশ করা হয়। এই প্রথম জানতে পাওয়া যায় যে বঙ্গবন্ধুকে পশ্চিম পাকিস্তানে নেয়া হয়েছে। শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের পদ্ধতি নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা ছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিমান যখন ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছিল তখন শেখ মুজিব তার সিনিয়র সহযোগীদের সাথে বৈঠক করছিলেন।
পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা রাও ফরমান আলী তার একটি বইতে লিখেছেন, আমরা সেখানে গিয়ে সকল সিনিয়র নেতাকে আটকের অনুমতি চেয়েছিলাম। এই পদক্ষেপ নিয়ে গেলে আন্দোলন পূর্ণশক্তি অর্জনের আগেই ধ্বংস করা যেত। তাহলে কোন রক্তপাত ঘটতো না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নিরাপত্তার কারণে আমাদেরকে সেই অনুমতি দেয়া হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমসের ভাষ্য অনুযায়ী পাকিস্তান রেডিও থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করার ঘোষণা আসে। সে ঘোষণায় বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার কয়েক ঘন্টা পরেই শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করা হয়েছে।
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান সরকারের একজন মুখপাত্র ঢাকায় প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেন যে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হয়েছে। বেশ গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে সে বিচার শুরু হয়। তাকে পাকিস্তানের কোন জায়গায় রাখা হয়েছে সেটি কাউকে জানানো হয়নি। একদিকে যুদ্ধ এগিয়ে যাচ্ছিল অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য চাপও বাড়ছিল।
অন্যদিকে গোপন সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার ও এগিয়ে যাচ্ছিল। ডিসেম্বর মাসের ৪ তারিখে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শেষ হয়। ঠিক এর একদিন আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে যায় ভারত। তখন সামরিক আদালতকে দ্রুত রায় দেবার জন্য তারা দেয় প্রেসিডেন্ট ইহা ইয়া খান। তখন যুদ্ধের তীব্রতা আরো বেড়ে যায়, কিন্তু সে রায় আর ঘোষনা করা হয়নি বলে জানায় নিউ ইয়র্ক টাইমস।
মিয়ানওয়ালি কারাগারটি ছিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে
নিয়াজের জেলায়। সে কারাগারে যারা বন্দী ছিল ছিল তাদের সবাই ছিল সে এলাকারই লোক। শেখ
মুজিবকে হত্যার জন্য ইয়াহিয়া খান নতুন আরেকটি ফন্দি আঁটেন। স্বাধীন বাংলাদেশের ফিরে
আসার পর শেখ মুজিব তার পশ্চিম পাকিস্তানের কারা জীবনের বর্ণনা দিয়েছিলেন সাংবাদিকদের
কাছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস রিপোর্ট করেছেন মিয়ানয়ালি কারাগারে বন্দীদের ক্ষুব্ধ করে তোলার জন্য ১৫ ই ডিসেম্বর তাদের বলা হয়েছিল যে বাঙালিরা একে নিয়া জিকে হত্যা করেছে। সেজন্য বন্দিদের কারাগারের ফটোল খুলে দেওয়া হবে, তারা যাতে পরদিন ভোর ছয়টার সময় গিয়ে শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে।
যাতে সরকার যুক্তি তুলে ধরতে পারে যে ক্ষুব্ধ কারাবন্দীরাই শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এই ঘটনা ঘটার দুই ঘন্টা আগে অর্থাৎ ভোর চারটার দিকে শেখ মুজিবকে রক্ষার জন্য কারাগারের সুপারিনটেনডেন্ট সেল থেকে সরিয়ে নেন।
শেখ মুজিবকে উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে কারাগার থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে সরিয়ে সুপারিন্টের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।সেখান থেকে আরেকজন পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় নেয়া হয়। যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হওয়ার পর দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট হন।
নিউ ইয়র্ক টাইমসেরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল মিস্টার ভুট্টর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী
শেখ মুজিবকে পশ্চিম পাকিস্তানে রাখা হয়। তবে
কোথায় রাখা হয়েছিল সেটা জানানো হয়নি। গৃহবন্দী অবস্থায় ১৭ দিন থাকার পর শেখ মুজিবকে
মুক্তি দেওয়া হয়। তখন তিনি পাকিস্তান থেকে লন্ডনে যান লন্ডনে একদিন অবস্থানের পর
১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের
ফিরে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান।