খায়বারের যুদ্ধ কেন শুরু হয়?খাইবার যুদ্ধের ঘটনা ও ফলাফল।


খায়বারের যুদ্ধ কেন শুরু হয়?খাইবার যুদ্ধের ঘটনা ও ফলাফল।

খাইবার যুদ্ধের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল আলোচনা কর ।


ভূমিকা:

মহানবি (সা.) মদিনার ইহুদিদেরকে ষড়যন্ত্রের অপরাধে খাইবারে নির্বাসিত করেন। ইহুদিরা খাইবারে নির্বাসিত হয়ে সেখানকার বেদুইনদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানাভাবে প্ররোচিত করে তোলে। খাইবার অঞ্চলের বেদুইনরা ইহুদিদের প্ররোচনায় মুসলমানদের সম্পদ ও জীবন বিনষ্ট করলে মহানবি (সা.) খাইবার অবরোধ করেন। ফলে ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে খাইবার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। খাইবার যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হলে ইহুদিদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায়। তারা আর কখনও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সাহস করেনি ।



খাইবার যুদ্ধের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল:


খাইবার যুদ্ধের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল সম্পর্কে নিম্নে দেওয়া হলো:


খায়বারের যুদ্ধ কেন শুরু হয়?

৬২৮ খ্রিস্টাব্দে মুসলমান ও খাইবারে নির্বাসিত ইহুদিদের মাঝে সংঘটিত খায়বারের যুদ্ধ কেন শুরু হয় তার কারণসমূহ নিম্নে বর্ণিত হলো:


১. মদিনার ইহুদিদের নির্বাসন:

মহানবি (সা.) মদিনার ইহুদিদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্য মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন। কিন্তু মদিনার ইহুদিরা মদিনা সনদ ভঙ্গ করে মক্কার কুরাইশদের সাথে গোপনে আঁতাত করে । মদিনার ইহুদিদের গোপন ষড়যন্ত্র ফাঁস হলে মহানবি (সা.) ইহুদিদের বনু নাজির, বনু কাইনুকা ও বনু কুরাইজা গোত্রকে খাইবারে নির্বাসিত করেন । ইহুদিরা খাইবারে নির্বাসিত হয়ে গোপনে মদিনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ফলে মহানবি (সা.) তাদের দমন করার জন্য খাইবার অভিযানে বের হয়।

 

২. বিশ্বাসঘাতকতা:

মহানবি (সা.) ও ইসলামের উন্নতি মদিনার মারহাব ইহুদিরা কখনও ভালো চোখে দেখেনি। তারা সর্বদা ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকত। তারা ইসলাম ও মদিনা রাষ্ট্রের দিন অ বিরুদ্ধে বার বার মক্কার কুরাইশদের সাথে আঁতাত করে। মহানবি (সা.) ইসলামের অগ্রযাত্রাকে কলুষমুক্ত করার জন্য খাইবার খাইবা অভিযান পরিচালনা করে ইহুদিদের ধ্বংস করার ইচ্ছা পোষণ করেন । 

 

৩. আবু রাফে সালামকে হত্যা:

খন্দক যুদ্ধে ইহুদি নেতা হুয়াই শাহাদ বিন আখতার নিহত হলে ইহুদি নেতা আবু রাফে সালাম তার স্থলাভিষিক্ত হন। আবু রাফে সালাম মুসলমানদের কর্তৃত্ব ধ্বংস করে নেতৃত্ব গ্রহণের ইচ্ছা পোষণ করে । তিনি সর্বদা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকেন। আবু রাফে সালাম ষড়যন্ত্র করে ইসলামের বিরুদ্ধে প্ররোচনা চালিয়ে খাইবারের বনু গাতফান ও পার্শ্ববর্তী সকল গোত্রকে ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর চেষ্টা ইহুদি করে। তাকে কৌশলে হত্যা করার পর ইহুদিদের আরেক নেতা আমির প্রকাশ্যে মুসলমানদের সাথে যুদ্ধের ঘোষণা দেয় । 

 

৪. মুসলমানদের বাণিজ্যপথ মুক্তকরণ:

ইহুদিদের মদিনা থেকে খাইবারে নির্বাসিত করা হয় । আর খাইবারের অবস্থান ছিল সিরিয়া গমনের পথে । মুসলমানরা খাইবার হয়ে সিরিয়ায় বাণিজ্য করতো। কিন্তু ইহুদিরা খাইবারে নির্বাসিত হওয়ার পর মুসলমানদের বাণিজ্যপথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতো। তারা মুসলমানদের বাণিজ্য কাফেলার ওপর আক্রমণ চালাত। বাণিজ্যপথকে শত্রুমুক্ত করার জন্য মহানবি (সা.) খাইবার অভিযান চালান ।

 

৫. মহানবি (সা.)-এর চারণভূমি লুণ্ঠন:

মদিনার ইহুদিরা খাইবারে নির্বাসিত হয়ে সেখানকার বেদুইনদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা প্রকার প্ররোচনা প্রদান করতো। ইহুদিদের প্ররোচনায় খাইবারের বনু গাতফান ও বনু ফাজারার মহানবি (সা.)-এর চারণভূমি জী কারাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় । তারা জী কারাদের ওপর হামলা চালিয়ে ২০টি উট লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। এই ঘটনার পর তাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য মহানবি (সা.) খাইবার অভিযান চালান ।

 

৬. মহানবি (সা.)-কে হত্যার চেষ্টা:

ইহুদিরা মহানবি (সা.)-কে নিবৃত্ত করতে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করে । তারা মহানবি (সা.)-কে হত্যার জন্য আমর বিন জাহাসের দেওয়াল থেকে পাথর নিক্ষেপ করে। তাই ইহুদিদের চরম শিক্ষা দেওয়ার জন্য মহানবি (সা.) খাইবার অভিযান প্রেরণ করেন ।

 

খাইবার যুদ্ধের ঘটনা:


খাইবারে ইহুদিদের মোট আটটি দুর্গ ছিল। এর মধ্যে সবচেয় বড় দুর্গ ছিল 'আল কামুস'। মহানবি (সা.) খাইবারের ৮টি দুর্গ ধ্বংস করার জন্য ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ১৪০০ পদাতিক ও ২০০ অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে একটি বাহিনী গঠন করেন। মহানবি (সা.) প্রথমে খাইবারবাসীর প্রতি সন্ধির প্রস্তাব দেন। কিন্তু তারা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। যুদ্ধের প্রথমে আন নাতান দুর্গের অধিপতি  মারহাব মল্লযুদ্ধে মাসলামা (রা.) কর্তৃক নিহত হন। এরপর তার ভাই ইয়াসিরকে জুবায়ের (রা.) হত্যা করেন। যুদ্ধের প্রথম দিন আৰু বকর (রা.), দ্বিতীয় দিন হযরত ওমর (রা.) ও তৃতীয় দিন হযরত আলি (রা.) মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করেন। খাইবারের সকল দুর্গ দখল করতে মুসলমানদের প্রায় তিন সপ্তাহ সময় লাগে। এ যুদ্ধে মুসলমানদের ১৯ বা ২০ জন সাহাবি শাহাদত বরণ করেন। আর কুরাইশদের ৯২/৯৩ জন নিহত হয়। সর্বশেষ ইহুদিরা নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে।

 

খাইবার যুদ্ধের ফলাফল

খাইবার যুদ্ধে ইহুদিরা পরাজিত হওয়ার মাধ্যমে তারা আর কখনও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার সাহস পায়নি। খাইবার যুদ্ধের ফলাফল নিম্নে প্রদত্ত হলো:

 

১. ইহুদিদের ক্ষমতা খর্ব:

এই যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার ফলে ইহুদিরা আর কখনও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সাহস করেনি। খাইবারে পরাজিত হওয়ার মাধ্যমে মূলত ইহুদিদের সব ক্ষমতা ধ্বংস হয়ে যায়।


২. হযরত আলি (রা.)-এর মর্যাদা বৃদ্ধি:

খাইবার যুদ্ধের তৃতীয় দিন হযরত আলি (রা.) মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করেন। আলি (রা.) খাইবার অসাধারন বীরত্ব প্রদর্শন করেন। আলি (রা.)- এর বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মহানবি (সা.) তাঁকে আসাদুল্লাহ বা আল্লাহর সিংহ উপাধি দেন। মহানবি (সা.) আলি (রা.)-কে উপহারস্বরূপ ইতিহাস খ্যাত 'জুলফিকার' তরবারিটি উপহার দেন ।

 

৩. সাফিয়াকে বিবাহ:

খাইবারের ৮টি দুর্গের মধ্যে সর্ববৃহৎ ছিল আল কামুস দুর্গ। যুদ্ধে পরাজিত হলে আল কামুস দুর্গের অধিপতিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তার স্ত্রী সাফিয়াকে বন্দি করে আনা হয়। মহানবি (সা.) উদারতার পরিচয় দিয়ে সাফিয়াকে বিবাহ করেন।


৪. খারাজ ব্যবস্থা চালু:

খাইবার বিজয়ের আগে খারাজ ব্যবস্থা চালু ছিল না। মহানবি (সা.) খাইবার জয় করে ইহুদিদের সেখানে বসবাসের অনুমতি দিয়ে খারাজ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।

 

৫. মুসলমানদের বাণিজ্যপথের নিরাপত্তা লাভ:

 ইহুদিদের প্ররোচনায় খাইবারে বসবাসরত বিভিন্ন গোত্র মুসলমানদের সিরিয়ার বাণিজ্যপথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতো। মহানবি (সা.) ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে খাইবার জয় করে মুসলমানদের বাণিজ্য পথকে শত্রুমুক্ত করেন। ফলে মুসলমানদের বাণিজ্য প্রসার লাভ করে। 


উপসংহার:

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, খাইবার যুদ্ধ ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম আক্রমণাত্মক যুদ্ধ। এ যুদ্ধে মুসলমানরা প্রথম মদিনার বাইরে এসে আক্রমণাত্মক যুদ্ধ পরিচালনা করেন। খাইবার যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হওয়ার ফলে ইহুদিরা আর কখনও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সাহস করেনি। অন্যদিকে, এ যুদ্ধে বিজয়ের ফলে ইসলাম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দ্রুত প্রসার লাভ করে। থাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দ্রুত ইসলাম প্রসারের মাইলফলক বলা হয়।

 

অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নঃ

  • খাইবার যুদ্ধের সেনাপতি কে? উত্তর:  মুসলমান ও ইহুদিদের মাঝে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ  খাইবার যুদ্ধে মুসলমানসেনাপতি ছিলেন হযরত মুহম্মদ (স)। তিনি পর্যায়ক্রমে হযরত আৰু বকর (রা.), হযরত ওমর (রা.) ও হযরত আলি (রা.) কে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। খাইবার যুদ্ধের ইহুদিদের সেনাপতি ছিলেন মারহাব।
  •  খাইবার যুদ্ধ ৬২৮ হিজরীতে সংঘটিত হয়।
  • মুসলমান ও ইহুদিদের মাঝে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ খাইবার যুদ্ধের।
  • খায়বারের বিখ্যাত দুর্গের নাম কি?উত্তর:  খায়বারের বিখ্যাত দুর্গের নাম কামুস দুর্গ।
  • কামুস দুর্গ কোথায় অবস্থিত? উত্তর: কামুস দুর্গ মদিনার খায়বারে অবস্থিত।
  • আরবের বিখ্যাত যোদ্ধা মারহাব মদিনার খায়বারে থাকতো।
  • খায়বার যুদ্ধের সময় রাসূল (স) এর খাবারে বিষ মিশিয়ে দেন কে?উত্তর: খায়বার যুদ্ধের সময় একজন মহিলা বকরির মাংসের মধ্যে রাসূল (স)কে হত্যা করার জন্য বিষ মিশিয়ে দেন।


ü 

ü 

ü  

ü  

ü  

Post a Comment

Previous Post Next Post