মদিনা সনদ কি , মদিনা সনদের ধারা কয়টি, মদিনা সনদের তাৎপর্য ব্যাখ্যা

 মদিনা সনদ কি , মদিনা সনদের ধারা কয়টি, মদিনা সনদের তাৎপর্য ব্যাখ্যা

মদিনা সনদ কি , মদিনা সনদের ধারা কয়টি, মদিনা সনদের তাৎপর্য ব্যাখ্যা 

মদিনা সনদ কি 

মহানবি (স) তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলেন, মদিনা ও এর আশপাশে বসবাসকারী মুসলিম, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিকদের মধ্যে সদ্ভাব ও সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি করতে হবে। তা না হলে একটি সুসংহত রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব নয় । তাই তিনি মদিনায় বসবাসরত সব জাতিধর্মের মানুষকে নিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের লক্ষ্যে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে একটি সনদ প্রণয়ন করেন। ইসলামের ইতিহাসে এটি 'মদিনা সনদ' নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক এম. ওয়াট এটিকে 'মদিনার সংবিধান' (The Constitution of Medina) বলেছেন।


মদিনা সনদের ধারা কয়টি


মদিনা সনদ কি , মদিনা সনদের ধারা কয়টি, মদিনা সনদের তাৎপর্য ব্যাখ্যা

ইবনে হিশামের 'সীরাতে ইবনে হিশাম' গ্রন্থানুসারে মদিনা সনদের ধারা ছিল ৪৭ টি। ইবনে ইসহাকের (সীরাতে রাসুলুল্লাহ) বর্ণনামতে, এ সনদের ৫৩টি ধারা রয়েছে। এটির প্রধান ধারাগুলো ছিল নিম্নরূপ:

মুখবন্ধ: মুহাম্মদ নবি (স)-এর পক্ষ থেকে এটি কুরাইশ ও ইয়াসরিবের মুসলমান, যারা তাদের অনুসরণ করে ও তাদের সাথে যুক্ত এবং তাদের সাথে জিহাদ করে তাদের মধ্যে একটি লিখিত দলিল ।


১. মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী সব সম্প্রদায় একটি সাধারণ জাতি গঠন করবে এবং সবাই সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে।

২.হযরত মুহাম্মদ (স) মদিনা প্রজাতন্ত্রের সভাপতি হবেন এবং পদাধিকার বলে তিনি মদিনার সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সর্বময় কর্তা হবেন ।

৩. এ সনদে স্বাক্ষরকারী কোনো সম্প্রদায় শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে অন্যরা সমবেত শক্তি দিয়ে তা প্রতিহত করবে । 

৪. প্রত্যেকের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে। মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করবে না ।

৫. কেউ কুরাইশদের সাথে বা অন্য কোনো বহিঃশত্রুর সাথে কোনো প্রকার গোপন সন্ধি করতে পারবে না কিংবা মদিনাবাসীর বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে কুরাইশদের সাহায্য করতে পারবে না।

৬. সনদে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়গুলোর কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে । এ জন্য পুরো সম্প্রদায়কে দায়ী করা যাবে না ।

৭.মদিনা নগরী আক্রান্ত হলে এর স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রত্যেক সম্প্রদায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে এবং নিজ নিজ ব্যয়ভার বহন করবে।

৮. মদিনা নগরীকে পবিত্র বলে ঘোষণা করা হলো এবং এখানে রক্তপাত, হত্যা, বলাৎকার ও অন্যান্য অপরাধমূলক কাজ নিষিদ্ধ করা হলো ।

৯. দুর্বল ও অসহায়কে সর্বতোভাবে সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে।

১০. অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করতে হবে এবং সব পাপী, অপরাধীকে ঘৃণার চোখে দেখতে হবে ।

১১. হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অনুমতি ছাড়া মদিনাবাসী কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না ।

১২.নিজেদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে হযরত মুহাম্মদ (স) আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তা মীমাংসা করবেন ।

১৩. এই সনদের শর্ত ভঙ্গকারীর ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হবে ।

১৪. অতীতের মতো রক্তপণ বহাল থাকবে।

১৫. মুমিন ব্যক্তি কোনো কাফেরের পক্ষ নিয়ে অন্য মুমিনকে হত্যা করবে না বা তার বিপক্ষে কোনো কাফেরকে সাহায্য করবে না ।

১৬. ইহুদিদের মধ্যে যারা মুসলমানদের অনুগামী হবে তাদের জন্য সাহায্য ও মর্যাদার অধিকার থাকবে । তাদের প্রতি কোনো অবিচার অথবা তাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করা হবে না ।

১৭. যদি কেউ গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া কোনো মুমিনকে হত্যা করেছে বলে প্রমাণিত হয় তাহলে তাকে শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। তবে যদি নিহতের অভিভাবক রক্তপণের বিনিময় গ্রহণে সম্মত হয় তাহলে সে তা গ্রহণ করতে পারবে। সব মুমিনকে এ বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে এবং এটি কার্যকর করা ছাড়া তাদের জন্য অন্য কিছু বৈধ হবে না।

১৮. অবশ্যই কোনো ব্যক্তি তার মিত্রের সাথে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে না এবং মজলুমকে সবাই সাহায্য করবে।

১৯. কোনো নারীকে তার পরিবারের অনুমতি ছাড়া আশ্রয় দেওয়া যাবে না ।

২০. কুরাইশ ও তাদের সাহায্যকারীদের আশ্রয় দেওয়া যাবে না ।


মদিনা সনদের তাৎপর্য ব্যাখ্যা


মদিনা সনদ কি , মদিনা সনদের ধারা কয়টি, মদিনা সনদের তাৎপর্য ব্যাখ্যা

ইসলামের ইতিহাসে মদিনা সনদের গুরুত্ব অপরিসীম। আরবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্কার আনাম এটি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। এ সনদ মহানবি (স)-এর অতুলনীয় দূরদর্শিতার ফসল ।


প্রথম লিখিত সংবিধান: 

মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর প্রণীত মদিনা সনদ বিশ্বের ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান। তাঁর আগে কোনো প্রশাসক এরূপ সংবিধান দিতে পারেননি। হযরত মুহাম্মদ (স) এ সনদের মাধ্যমে সব জাতি-ধর্মের মানুষকে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে তাঁর

শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। আধুনিক ঐতিহাসিকেরা এটিকে 'প্রথম লিখিত সংবিধান' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তারা একে ‘আরবের ম্যাগনাকার্টা' বলেও অভিহিত করেছেন ।


রাজনৈতিক ঐক্য: 

মদিনা সনদ মদিনার মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সৃষ্টি করে। এর মাধ্যমে হিংসা-বিদ্বেষ ও কলহ ভুলে বিপদের সময় সবাই একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। এ সনদ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে। ফলে এক সুদৃঢ় রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে বিবাদে লিপ্ত মদিনার আউস ও খাযরাজ গোত্রের মিলন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ।


ইসলামি শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা: 

হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ওপর মদিনা রাষ্ট্র পরিচালনার ভার অর্পিত হলে তিনি গোত্রভিত্তিক শাসনব্যবস্থা বিলুপ্ত করে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও ইসলামি শাসনতন্ত্র কায়েম করেন। পি. কে. হিট্টি বলেন, ‘মদিনার সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে ইসলাম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে আবির্ভূত হলো।’১০. এ সনদের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, হযরত মুহাম্মদ (স) শুধু ধর্ম প্রচারকই নন; বরং তিনি বিশ্বের এক যুগান্তকারী বিপ্লবী শাসকও বটে।


মহানবি (স)-এর শ্রেষ্ঠত্ব: 

মদিনা সনদের মাধ্যমে মহানবি (স)-এর শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় মেলে। সনদে বলা হয়েছে- চুক্তিবদ্ধ সম্প্রদায়গুলো মক্কার কুরাইশ বা অন্য কোনো শত্রুর সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারবে না এবং মদিনা আক্রান্ত হলে সবাই মিলে তা প্রতিহত করবে। এর মাধ্যমে কুরাইশদের বিরুদ্ধে রাসুল (স)-এর হাত শক্তিশালী হয়েছিল । এতে তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক এ. এইচ. সিদ্দিকী বলেন, ‘এ সনদের ধারা অনুযায়ী রাসুল (স) নিজেকে বিচার বিভাগীয়, আইন প্রণয়ন, সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করেন।


জানমালের নিরাপত্তা বিধান ও যুদ্ধের প্রবণতা হ্রাস:

মদিনা সনদের মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (স) মুসলমান, ইহুদি, খ্রিষ্টানসহ প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করেন। এ সনদে যুদ্ধের ব্যাপারে সুস্পষ্ট বিধি-নিষেধ থাকায় মদিনার যুদ্ধপ্রিয় গোত্রগুলো অযৌক্তিক যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে বিরত থাকে। ফলে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি যুদ্ধের ঘটনা হ্রাস পায়।


জাতীয় ঐক্য: 

মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী সব সম্প্রদায়কে একটি উম্মাহ বা জাতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইহুদি, খ্রিষ্টানসহ সবাই সনদের ধারাগুলো মেনে চলার অঙ্গীকার করে । ফলে জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠে। 


ইসলামের প্রচার ও প্রসার:

মদিনা সনদ প্রণয়নের পর পুরো আরবে ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার হয় । বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও জয়লাভের মাধ্যমে মহানবি (স) ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন ।

মদিনা সনদ কি , মদিনা সনদের ধারা কয়টি, মদিনা সনদের তাৎপর্য ব্যাখ্যা


ম্যাগনাকার্টা কি?

ম্যাগনাকার্টা (Magna Carta) ইংল্যান্ডের একটি চুক্তি, যা ১২১৫ সালে সাক্ষরিত হয় । রাজা জন সামন্তদের (ভূ-স্বামী) চাপে পড়ে রাজার অধিকার সংক্রান্ত এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এটি ছিল প্রজাদের অধিকার সংক্রান্ত ও রাজার ক্ষমতা হ্রাসের একটি সংবিধানিক দলিল । পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও জনগণের ক্ষমতায়নে এটি পথনির্দেশক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post