সুলতান কালাউনের শাসনকাল ও বৈদেশিক নীতি
পর্যালোচনা কর।
অথবা, বৈদেশিক নীতির উল্লেখপূর্বক সুলতান
কালাউনের শাসনকাল পর্যালোচনা কর।
অথবা, সুলতান কালাউনের বৈদেশিক নীতির উল্লেখসহ
তার শাসনকাল আলোচনা কর।
উত্তর ভূমিকা: মিসর, সিরিয়া,
হেজাজ ও উত্তর আফ্রিকার ইতিহাসে মামলুক সালতানাত এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় সৃষ্টি করেছে।
মামলুক সুলতানদের মধ্যে কালাউন ছিলেন নিঃসন্দেহে অতুলনীয় এক ব্যক্তিত্ব। শ্রেষ্ঠ শাসক
রুকনুদ্দিন বাইবার্সের মৃত্যুতে মামলুক সাম্রাজ্যে যে বিশৃঙ্খলা ও শূন্যতার সৃষ্টি
হয়েছিল কালাউন তার দক্ষ ও বিচক্ষণ শাসন দ্বারা তা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরপর আমৃত্যু
তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম ও কঠোর শাসনের দ্বারা মিসরকে শৌর্যবীর্যের উচ্চ শিখরে উন্নীত
করেন।
সুলতান কালাউনের শাসনকাল ও বৈদেশিক নীতি: সুলতান কালাউনের শাসনকাল ও বৈদেশিক নীতি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো-
ক. সুলতান কালাউনের শাসনকাল: নিম্নে সুলতান কালাউনের শাসনকাল সম্পর্কে
আলোচনা করা হলো-
১. সিরিয়ার কারাশঙ্কুরের বিদ্রোহ দমন: মামলুক সুলতানদের উত্তরাধিকার নিয়োগের কোনো সুষ্ঠু নিয়ম ছিল না। তাই প্রতিবারই পূর্ববর্তী সুলতানের মৃত্যুর পর নতুন সুলতান নির্বাচন নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সূচনা হতো। কালাউনের সময়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সুলতান কালাউন যখন সিংহাসনে বসেন তখন রুকনুদ্দিন বাইবার্সের এক সেনাপতি কারাশঙ্কুর সিরিয়ায় নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। এছাড়া তিনি বুকনুদ্দিন বাইবার্সের অনেক দাস, বেদুইন এবং আইয়ুবি শাহজাদা কর্তৃক সাহায্যের আশ্বাস পেয়ে কালাউনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। এদিকে সুদক্ষ কালাউনও তার সম্মিলিত বাহিনীর মোকাবিলায় অগ্রসর হন। তিনি দামেস্কের নিকটবর্তী জেমুরার যুদ্ধে কারাশঙ্কুর বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। কিন্তু পরে কালাউন তার চারিত্রিক উদারতাবলে কারাশঙ্কুরসহ পরাজিত অন্যান্য আমিরক ক্ষমা প্রদর্শন করেন এবং তাদেরকে। নিজ দলে নিয়ে তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করেন।
২. বাহরি মামলুকদের দমন: কালাউনের সৈন্যবাহিনী
সুউচ্চ বুরুজে বসবাস করতো বলে এদেরকে বুরুজি মামলুক বলা হতো। তাদের সংখ্যা ছিল প্রায়
১২ হাজার। মূলত কালাউন ক্রুসেডার ও মোঙ্গলদের বারবার আক্রমণ, অত্যাচার ও উপদ্রব হতে
নিজ রাজ্য রক্ষার জন্য এই বিশেষ সৈন্যবাহিনী গঠন করেছিলেন। কিন্তু বুরুজি মামলুকদের
আধিপত্য দিন দিন বৃদ্ধি পেতে দেখে বাহরি মামলুকদের মর্মপীড়া দেখা দেয়। তারা সুলতান
কালাউনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। আর এই ষড়যন্ত্রে 'পূর্ববর্তী সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্সের
বহু ভক্ত, অনুরুক্ত তাদের সাথে যোগ দেয়। কিন্তু সুলতান কালাউন সৌভাগ্যবশত ব্যহরি মামলুকদের
ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে ষড়যন্ত্রকারীদের অনেককে হত্যা করেন। এদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে
সন্দেহবশত কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।
৩. হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা: সুলতান কালাউন রণক্ষেত্রে, অত্যন্ত দুর্ধর্ষ হলেও প্রজাসাধারণের প্রতি অত্যন্ত নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। একবার অসুস্থাবস্থায় দামেস্কের নূরী হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের সময় কায়রোতে তিনি একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার সংকল্প করেন। সংকল্প মোতাবেক 'আল মারিস্তান আল মনসুরি' নামে ১২৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কায়রোতে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। এর জন্য তিনি যে বিশাল ইমারত নির্মাণ করেন তা একই সাথে বিদ্যালয়, হাসপাতাল, মসজিদ ও সমাধিক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
৪. জ্ঞানবিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক: সুলতান কালাউন
জ্ঞানবিজ্ঞানেও অবদান রেখে গেছেন। ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লিকান ও আবুল হাসান তার পৃষ্ঠপোষকতা
লাভ করেন। তার বিখ্যাত 'আল মারিস্তান আল মনসুরি' হাসপাতাল সংলগ্ন একটি পাঠাগার ছিল;
যাতে চিকিৎসা, ধর্মীয় ও আইন সংক্রান্ত বহু গ্রন্থ সংগৃহীত ছিল।
হাসপাতাল সংলগ্ন মসজিদে ৫০ জন বেতনভোগী
কোরআন পাঠক আল কোরআনের সান্তির বাণী আবৃতি করতেন। :
খ. বৈদেশিক নীতি: নিম্নে সুলতান
কালউনের বৈদেশিক নীতি আলোচনা করা হলো-
১. মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ: মোঙ্গলরা ছিল মিসরের মামলুকদের চিরশত্র। বিগত মামলুক সুলতানগণ মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে সবসময়ই সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে এসেছেন। সুলতান কালাউনও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। নিম্নে সে সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়া হলো-
২. মোঙ্গল আক্রমণ: সুলতান কালাউনের
ক্ষমতা গ্রহণের পূর্ব থেকেই সীমান্তে দুর্ধর্ষ মোঙ্গলদের তৎপরতা শুরু হয়। কালাউন। কারাশঙ্কুরের
বিদ্রোহ দমন করে কায়রো গমন করলে ইলখানি মোঙ্গল শাসক আরাগা খান ইউফ্রেটিস অতিক্রম করে
আলেপ্পো দখল করে নেন। তারা অধিকৃত অঞ্চলে ব্যাপক লুণ্ঠন ও নিপীড়ন শুরু করলে লোকজন প্রাণভয়ে
কায়রোর দিকে পলায়ন করে।
৩. সুলতান কালাউনের প্রতিরোধ: এই আক্রমণে মোঙ্গলদের
সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০ হাজার। তারা মিসরের দিকে অগ্রসর হলে কালাউন মামলুক ও তুর্কি
ক্রীতদাসদের সমন্বয়ে গঠিত ৫০ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী নিয়ে মোঙ্গলদের মোকাবিলায় অগ্রসর
হন।
৪. হিমসের যুদ্ধ ও মোঙ্গলদের পরাজয়: ১২৮১ খ্রিস্টাব্দে ৩০ অক্টোবর হিমসের নিকট উভয় বাহিনী পরস্পর মুখোমুখি হলে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে প্রাথমিকভাবে মোঙ্গলরা জয়ী হয়ে মামলুকদের গনিমত সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ সুযোগে মামলুকরা পিছন থেকে অকস্মাৎ আক্রমণ করে মোঙ্গলদের বিধ্বস্ত করে দেন। মোঙ্গলদের বিরাট বাহিনী মুহূর্তেই কচুকাটা হয়ে যায়। মোঙ্গলরা এর আগেও মামলুকদের নিকট পরাজিত হয়েছিল বটে, কিন্তু এবার কালাউনের নিকট পরাজয়ে মোঙ্গলদের বিশাল বাহিনী একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়।
৫. ক্রুসেডারদের সাথে সংঘর্ষ: ক্রুসেডারদের
সাথে কালাউনের সংঘর্ষের বিবরণ নিম্নরূপ:
ক. ক্রুসেডারদের সাথে সন্ধি: সুলতান কালাউন
খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের অগ্রাভিযান রোধকল্পে ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে আনতারতুসের টেম্পলারদের
সাথে ১০ বছর মেয়াদি একটি শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন। তেমনিভাবে টায়ার ও বৈরুতের খ্রিস্টান
যুবরাজদের সাথেও তিনি পৃথক পৃথক সন্ধি করে ক্রুসেডারদের মুখ বন্ধ করে রাখেন।
খ. ত্রিপোলি ও আক্রা অভিযান: সবদিক দিয়ে ক্ষমতাকে সুসংহত করে কালাউন ক্রুসেডারদের প্রাচ্য থেকে বিতাড়নে মনোনিবেশ করেন। এ লক্ষ্যে সর্বপ্রথম ১২৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি আল মাকরাব অবরোধ করেন। দীর্ঘ দুর্গ দিন পর তিনি এ দুর্গটি হস্তগত করেন। অতঃপর তিনি ক্রুসেডারদের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি ত্রিপোলি থেকে তাদের বিতাড়িত করতে ১২৮৯ খ্রিস্টাব্দে আক্রমণ করেন। সাইপ্রাসের রাজা ক্রুসেডারদের সাহায্যার্থে বাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু তাদের মিত্রবাহিনী কালাউনের হাতে পরাজিত হয়। এরপর ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি আক্রার দুর্গ অবরোধ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের পূর্বেই কালাউন মৃত্যুবরণ করেন।
৬. অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক: কালাউন মিসরের
শাসনকার্যে একটি স্থিতিশীলতা আনয়নের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশের সাথে মিত্রতার প্রচেষ্টা
করতে থাকেন। তিনি সিসিলি, ক্যাস্টাইল, ফ্রান্স, জেনোয়া প্রভৃতি দেশের নরপতিদের সাথে
বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। এছাড়াও সিংহলের রাজার সাথে তার দূত বিনিময় হয় এবং বাণিজ্যিক
সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে তার বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নীতির দ্বারা মামলুক সালতানাতের
সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার
পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সুলতান কালাউন ছিলেন মামলুক বংশের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ শাসক।
তিনি মামলুকদের বাহরি ধারার হলেও বুরুজি নামে আরেকটি গোত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একজন
সামান্য ক্রীতদাস থেকে স্বীয় যোগ্যতা ও অনন্য প্রতিভাবলে এক সময়কার সমগ্র মুসলিম জাহানের
সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়ায় ইতিহাস তাকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। তার দূরদর্শিতাপূর্ণ
বৈদেশিক নীতির জন্য কূটনৈতিক অঙ্গনে আজও তিনি বিশেষভাবে আলোচিত হয়ে আছেন।