একজন বিজেতা হিসেবে গাজী সালাউদ্দীন আইয়ূবীর কৃতিত্ব বিশ্লেষণ কর।

একজন বিজেতা হিসেবে গাজী সালাউদ্দীন আইয়ূবীর কৃতিত্ব বিশ্লেষণ কর।

বিজেতা ও মানুষ হিসেবে সালাহউদ্দিন আইয়ুবির কৃতিত্ব আলোচনা কর।

অথবা, একজন বিজেতা হিসেবে গাজি সালাউদ্দিন আইয়ুবির কৃতিত্ব বিশ্লেষণ কর।

অথবা, মানুষ ও বিজেতা হিসেবে সালাহউদ্দিন আইয়ুবির মূল্যায়ন কর।

উত্তর ভূমিকা: মিসরের কায়রোতে ফাতেমি বংশের ধ্বংসস্তূপের ওপর আইয়ুবি বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্রুসেডারদের আক্রমণের ফলে পশ্চিম এশিয়া থেকে মুসলমানদের চিহ্ন যখন নিশ্চিহ্ন হতে থাকে তখন আশীর্বাদ স্বরূপ প্রেরিত হয়েছিলেন সালাহউদ্দিন আইয়ুবি। সালাহউদ্দিন আইয়ুবির অসাধারণ প্রতিভা ও দূরদর্শিতায় ইসলামের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক শক্তি অক্ষুণ্ণ থাকে। তিনি অসাধারণ বীরত্ব ও সাহসিকতার দ্বারা ক্রুসেডারদের জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত করেন। ফলে তার প্রতিষ্ঠিত আইয়ুবি বংশ ইসলামকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে।


বিজেতা ও মানুষ হিসেবে সালাহউদ্দিন আইয়ুবির কৃতিত্ব: নিম্নে বিজেতা ও মানুষ হিসেবে সালাহউদ্দিন আইয়ুবির কৃতিত্ব আলোচনা করা হলো-

বিজেতা হিসেবে সালাহউদ্দিন আইয়ুবির কৃতিত্ব: নিম্নে বিজেতা হিসেবে সালাহউদ্দিন আইয়ুবির কৃতিত্ব আলোচনা করা হলো-

১. ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি: সালাহউদ্দিন আইয়ুবি ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। আশেপাশের মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে মিলিতভাবে তিনি ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। তারা সালাহউদ্দিন আইয়ুবির সাথে মিলিতভাবে ক্রুসেড অভিযানের প্রস্তুতি নেন। আর এভাবে সালাহউদ্দিন আইয়ুবির ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে আক্রমণের যুগ আরম্ভ হয়।


২. প্যালেস্টাইন অভিযান: প্যালেস্টাইনে উপনিবেশকারী খ্রিস্টানরা কয়েক বছর ধরে সালাহউদ্দিন আইয়ুবিকে রাগান্বিত করে আসছিল। হজযাত্রীদের হত্যা ও মালামাল লুণ্ঠন করে তারা অরাজকতা সৃষ্টি করতো। ১১৮৩ খ্রিস্টাব্দে রেজিনান্ড পবিত্র কাবা ও হযরতের রওজা মুবারক ধ্বংস করতে আক্রমণ করে। এভাবে নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হতে থাকলে অবশেষে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি প্যালেস্টাইন অভিযান করেন।

৩. হিট্রিনের যুদ্ধ: মুসলমানদের যখন নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চলছিল তখন হিট্রিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। সালাহউদ্দিন আইয়ুবি অবাধে প্যালেস্টাইন অবরোধ করেন। ১১৮৭- খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হিট্রিনের যুদ্ধে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি ফ্রাঙ্ক ও ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের চরমভাবে পরাজিত করে। যারা সন্ধি ভঙ্গ করেছিল তাদেরকে প্রথমে বন্দি ও পরে হত্যা করা হয়। এভাবে হিট্টিনের চূড়ান্ত যুদ্ধে মুসলমানরা জয়ী হয়।

৪. জেরুজালেম পুনরুদ্ধার: ক্রুসেডারদের হাত থেকে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি, জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন। জেরুজালেমের খ্রিস্টান নেতা 'রেজিনান্ড বরাবর সন্ধি ভঙ্গ করে মানুষদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। ফলে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি জেরুজালেম আক্রমণ করেন এবং শেষ পর্যায়ে সাফল্যের সাথে জেরুজালেম পুনরুদ্ধারে সক্ষম হন।


৫. তৃতীয় ক্রুসেডের সাফল্য: হিট্রিনের যুদ্ধে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি খ্রিস্টানদের পরাজিত করলে খ্রিস্টান জগৎ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। যার ফলে তৃতীয় ক্রুসেড অনিবার্য হয়ে পড়ে এবং পোপ মুসলমানদের বিরুদ্ধে আবার ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা দেয় যা তৃতীয় ক্রুসেড নামে পরিচিত। ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি ক্রুসেডারদের ওপর আক্রমণ করেন এবং সাফল্যের সঙ্গে জয় লাভ করে তৃতীয় ক্রুসেডের সমাপ্তি ঘটায়।

৬. জাফফা অবরোধ: কাউন্ট হেনরির নেতৃত্বে আক্রায় এসে হানা দেয় ফ্রাঙ্ক ক্রুসেডাররা। কিন্তু সালাহউদ্দিন আইয়ুবির তিন পুত্র ও ভ্রাতার নেতৃত্বে গঠিত বাহিনীর কাছে তারা পালাতে বাধ্য হয়। কিন্তু ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের রাজারা বহুসংখ্যক সৈন্যসহ ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে আক্রা দখল করে জনগণের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এমতাবস্থায় সালাহউদ্দিন আইয়ুবি আক্রমণ চালিয়ে জাফফা অবরোধ করলে রিচার্ডসহ পুরো ক্রুসেড বাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলে।


৭. রামাল্লার সন্ধি: ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড জেরুজালেমের ওপর আক্রমণ চালায় এবং ব্যর্থ হয়। এতে নিরাশ হয়ে তিনি আক্রাতে প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় সালাহউদ্দিন আইয়ুবি জাফফা অবরোধ করলে রিচার্ড নাজেহাল হন। এমতাবস্থায় দুই পক্ষ ক্লান্ত হয়ে পড়লে ইংল্যান্ডের রাজা সালাহউদ্দিন আইয়ুবির ভাই মালিক আল আদিলের সঙ্গে তার ভগ্নিকে বিয়ে দিয়ে জেরুজালেম যৌতুক দেওয়ার প্রস্তাব করেন। আর এভাবে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে রামল্লাতে দুটি সাধারণ নীতিতে সন্ধি সম্পাদিত হয়।

মানুষ হিসেবে সালাহউদ্দিন আইয়ুবির কৃতিত্ব: সালাহউদ্দিন আইয়ুবি ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ধর্মকর্মের ব্যাপারে অত্যন্ত নিয়মনীতি মেনে চলতেন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থানরত অবস্থায় নামাজ আদায় করতেন। তিনি সমসময় নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলতেন। সালাহউদ্দিন আইয়ুবি জ্ঞানবিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। জ্ঞানী গুণী ও ধার্মিক লোকদের তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। বহু পণ্ডিত গুণীজনদের তাদের কৃতকর্মের জন্য পুরষ্কৃত করতেন। জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতি ছিল তার অগাধ শ্রদ্ধা। সালাহউদ্দিন আইয়ুবি বহু সামাজিক ও জনহিতকর কার্যাবলি সম্পাদন করেন। তিনি বহু স্কুল, কলেজ, মসজিদ নির্মাণ করে গেছেন। তার রাজ্যে জ্ঞানী গুণীদের যাতায়াত ছিল'। স্থাপত্য শিল্পেও তার অবদান রয়েছে। নিজের উদারতা ও মহানুভবতার পরিচয় দিতে তিনি আইয়ুবি বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ। তার ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সালাহউদ্দিন আইয়ুবি ইসলামের ইতিহাসে ত্রাণকর্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তার অসামান্য কৃতিত্বের জন্য ইসলাম ধর্ম আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়।


উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবি ছিলেন একজন দক্ষ শাসক ও একজন দক্ষ যোদ্ধা। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি ক্রুসেডারদের নিকট ছিলেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক। তিনি বীরত্ব ও দক্ষতার সাথে ক্রুসেডারদের দমন করে সাম্রাজ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনেন। ইসলাম ধর্ম তথা মুসলমানদের নিশ্চিহ্নের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সালাহউদ্দিন আইয়ুবির নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post