মারজ-ই-দাবিকের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ কর এবং পরবর্তী ইতিহাসে এর প্রভাব নির্ণয় কর।

 

মারজ-ই-দাবিকের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ কর এবং পরবর্তী ইতিহাসে এর প্রভাব নির্ণয় কর।

মারজ ই দাবিকের যুদ্ধের কারণসমূহ চিহ্নিত কর। এটি কীভাবে মামলুক ও ইসলামের পরবর্তী ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছিল?

অথবা, মারজ-ই-দাবিকের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ কর এবং পরবর্তী ইতিহাসে এর প্রভাব নির্ণয় কর।

অথবা, 'মারজ ই দাবিক' যুদ্ধের পটভূমি আলোচনা কর এবং পরবর্তী ইতিহাসে এর প্রভাব নির্ণয় কর।

উত্তর ভূমিকা: মিসরের মামলুক ও পশ্চিম এশিয়ার সালতানাতের ইতিহাসে 'মারজ ই দাবিকের' যুদ্ধ একটি যুগান্তকারী ঘটনা। অটোমান সালতানাত প্রতিষ্ঠার পর থেকে একের পর এক যোগ্য ও পরাক্রমশালী শাসকদের আর্বিভাবে উত্তরোত্তর এর সীমানা ও জৌলুশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। পশ্চিম এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ হস্তগত করার পর এবার অটোমানরা উত্তর আফ্রিকার দিকে দৃষ্টিপাত করেন। অন্যদিকে প্রায় তিন শতাব্দীব্যাপী মিসর, হেজাজ ও সিরিয়ায় মামলুক বংশীয় শাসকগণ শাসনকার্য পরিচালনা করেন। কিন্তু শেষদিকে মারজ ই দাবিকের যুদ্ধ একদিকে যেমন মামলুক বংশের পতন ঘটায় অন্যদিকে এতদঞ্চলে অটোমানদের কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করে।


মারজ ই দাবিকের যুদ্ধের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল: মারজ ই দাবিকের যুদ্ধের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল নিম্নে আলোচনা করা হলো-

ক. মারজ ই দাবিকের যুদ্ধের কারণ: নিম্নে মারজ ই দাবিকের যুদ্ধের কারণসমূহ বিশ্লেষণ করা হলো-

১. অটোমান সুলতান প্রথম সেলিমের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ: অটোমান সুলতান প্রথম সেলিম রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। সুলতান হিসেবে সমগ্র মুসলিম জাহানে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্যেশ্যেই তিনি মিসরে অভিযান পরিচালনা করেন। তদুপরি এ সময় মামলুক শাসক কানসুহ আল ঘুরির কিছু অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত এ যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে।

২. সেলিমের বিদ্রোহী ভাইকে আশ্রয় দান: অত্যন্ত প্রতাপশালী সুলতান সেলিমের ভাই আহমদ বিদ্রোহ ঘোষণা করে মিসরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। আহমদের মৃত্যুর পর কানসুহ আল ঘুরি তার পুত্রকে সিরিয়ার সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করেন। এতে সেলিম অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হন এবং কানমুহ আল ঘুরিকে উচিত শিক্ষা প্রদানের সংকল্প করেন।


৩. দুর্গ পুনরুদ্ধার: মামলুক সুলতান কানসুহ আল ঘুরি অত্যন্ত বৃদ্ধ হলেও তিনি অত্যন্ত যোগ্যতা ও ক্ষিপ্রতার অধিকারী ছিলেন। অটোমান সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদের শাসনকালের শেষ সময়ে সাম্রাজ্যে অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার সুযোগে মামলুক সুলতান এশিয়া মাইনরের তিনটি অটোমান দুর্গ দখল করে নেন। সেলিম পিতার হারানো দুর্গ পুনরুদ্ধার ও মামলুক রাজ্য জয় করার উদ্দেশ্যে মিসরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

৪. সুলতান কানসুহ আল ঘুরির অদূরদর্শিতা: ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দে ক্যালদিরান যুদ্ধে শাহ ইসমাইল পরাজিত হলে তিনি মামলুক সুলতান কানসুহ আল ঘুরির নিকট সাহায্য কামনা করেন। মামলুক সুলতান পার্শ্ববর্তী দুই রাষ্ট্রের সংঘাতে উদ্বিগ্ন হয়ে মধ্যস্থতার জন্য আব্বাসি খলিফা আল মুতাওয়াক্কিলের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সেলিমের দরবারে পাঠান। কিন্তু এদিকে কানসুহ আল ঘুরি সৈন্যবাহিনী নিয়ে আলেপ্পো পর্যন্ত অগ্রসর হন। কানসুহ আল ঘুরি শান্তির বার্তা প্রেরণ করলেও গুপ্তচর মারফত সেলিম তথ্য লাভ করেন যে, মামলুক সুলতান পারস্যের শাহকে সহযোগিতা করতে এসেছেন। এতে সেলিম ক্রোধান্বিত হন এবং মিসরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন।


৫. প্রতিনিধি দল ও দূতকে অপমান: সুলতান কানসুহ আল ঘুরি অটোমান ও সাফাভি সাম্রাজ্যের সাথে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে খলিফার নেতৃত্বে উচ্চপদস্থ বেসামরিক কর্মকর্তা ও কাজিগণের যে শান্তি মিশন প্রেরণ করেন, গুপ্তচর মারফত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সুলতান সেলিম তাদের সাথে অত্যন্ত রূঢ় ও অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। সেলিমের এই দুর্ব্যবহারে কানসুহ আল ঘুরি অত্যন্ত অপমানবোধ করেন এবং তার নিকট সেলিমের প্রেরিত দূতকেও অপমান করে বন্দি করে রাখেন। এতে সেলিম মামলুকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন।

৬. সাফাভিদের বিরুদ্ধে সেলিমকে সাহায্য না করা: অটোমান সুলতান প্রথম সেলিম যখন পারস্যের সাফাভি শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন তখন মিসরীয় শাসক অটোমানদের করদরাজ্য যুলবাদরকে প্রথম সেলিমের জন্য সাহায্য প্রেরণ করার সুযোগ দেননি। এতে সেলিম প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য মামলুক সাম্রাজ্যে অভিযান করেন।


খ. মারজ ই দাবিকের যুদ্ধের ঘটনা: উপর্যুক্ত কারণকে উপলক্ষ করে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়। সুলতান কানসুহ আল ঘুরি তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে আলেপ্পো আসেন। সুলতান প্রথম সেলিমও তার বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলে আলেপ্পোর উত্তরে 'মারজ ই দাবিকের প্রান্তরে উভয় বাহিনী মুখোমুখি হয়। ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪ আগস্টের তুমুল যুদ্ধে মামলুক গভর্নর খায়ের বি ও অন্যান্যদের বিশ্বাসঘাতকতায় তুর্কিগণ বিজয়ী হন। কানসুহ আল ঘুরি পলায়ন করতে গিয়ে প্রাণ হারান। সুলতান প্রথম সেলিম একে একে সমস্ত মামলুক অঞ্চল জয় করেন।সিরিয়া, মিসর ও উত্তর আফ্রিকায় মুসলিম শাসনে

গ. মারজ ই দাবিকের যুদ্ধের ফলাফল: নিম্নে মারজ ই দাবিকের যুদ্ধের ফলাফল আলোচনা করা হলো-

১. মামলুক বংশের পতন : ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত মারজ ই দাবিকের যুদ্ধে মামলুকদের শোচনীয় পরাজয় তাদের বংশ ও শাসনধারার পতনকে ত্বরান্বিত করে। সুলতান কানসুহ আল ঘুরির পর সর্বশেষ মামলুক শাসক তুমান বে ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ জানুয়ারি রাওদানিয়া যুদ্ধে পরাজিত হলে মিসরকেন্দ্রিক মামলুক বংশের শাসন বিলুপ্ত হয়। এরই সাথে ১২৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হওয়া মামলুক শাসন ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে শেষ হয়।


২. তুর্কি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা: ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে মারজ ই দাবিক ও ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে রাওদানিয়া যুদ্ধের বিজয়ের ফলে মিসর, সিরিয়া ও হিজাজে অটোমান বংশের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়। ইতোমধ্যে অটোমান সালতানাত পশ্চিম এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে যে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল তার সীমা উত্তর আফ্রিকা ও সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে বিস্তৃত হয়।

৩. আব্বাসি খিলাফতের অবসান: ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের পতনের পরও মামলুক সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্স আব্বাসি খিলাফতকে ১২৬১ খ্রিস্টাব্দে কায়রোতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। মারজ ই দাবিকে মামলুকদের পতনের পর সুলতান প্রথম সেলিম সর্বশেষ খলিফা আল মুতাওয়াক্কিলকে কনস্টান্টিনোপলে নিয়ে যান। প্রথম সেলিম প্রথমদিকে খলিফাকে যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদান করেছিলেন। কিন্তু একটি অভিযোগের ভিত্তিতে ১৫২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বন্দি হিসেবে জীবনযাপন করেন। প্রথম সেলিমের পর সুলতান সোলায়মান আনুষ্ঠানিকভাবে তার নিকট থেকে খিলাফতের পদমর্যাদা ও উপাধি গ্রহণ করেন। ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে খলিফার মৃত্যুতে নামসর্বস্ব আব্বাসি খিলাফতের চূড়ান্ত অবসান ঘটে। 


৪. ভূমধ্যসাগরে কর্তৃত্ব লাভ: ভূমধ্যসাগরের উত্তরাংশে অটোমানদের কর্তৃত্ব পূর্বেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সিরিয়া, প্যালেস্টাইন ও মিসরের কর্তৃত্ব লাভের ফলে সমগ্র ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে অটোমান কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সাথে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়াসহ এতদঞ্চলের অর্থনৈতিক সমুদ্র বন্দরসমূহের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে অর্পিত হয়। এতে একদিকে যেমন অটোমানদের রাজনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়, তেমনিভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও সাধিত হয়।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মারজ ই দাবিকের যুদ্ধের দ্বারা মিসর, সিরিয়া ও হেজাজ অঞ্চলে মামলুক শাসন বিলুপ্ত হয়ে অটোমান কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক P. K. Hitti এ যুদ্ধকে Turning point বলে অভিহিত করেছেন। এ যুদ্ধে জয়লাভের ফলেই অটোমানরা প্রথমে 'খাদিমুল হারামাইন শরিফাইন' ও পরবর্তীতে 'খলিফা' উপাধি লাভ করেন। তাই ইসলামের ইতিহাসে মারজ ই দাবিকের যুদ্ধ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উল্লিখিত হয়েছে।


Post a Comment

Previous Post Next Post