মামলুক সুলতান আল-নাসিরের রাজত্বকাল বর্ণনা কর।

মামলুক সুলতান আল-নাসিরের রাজত্বকাল বর্ণনা কর।

মামলুক সুলতান আল নাসিরের রাজত্বকাল আলোচনা কর।

অথবা, মামলুক আল নাসিরের রাজত্বকাল বর্ণনা কর।

উত্তর ভূমিকা: সুলতান আল নাসিরের রাজত্বকাল মিসরের বাহরি মামলুকদের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। বাহরি মামলুক শাসকদের মধ্যে আল নাসিরের রাজত্বকাল সর্বাপেক্ষা দীর্ঘস্থায়ী ছিল। তিনি ছিলেন বাহরি মামলুক বংশের অন্যতম একজন শ্রেষ্ঠ শাসক। ক্ষমতাসীন আমির ওমরাদের দমন, অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা দূরীকরণ, বৈদেশিক শত্রু দমন ও জনকল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে মিসরের বাহরি মামলুকদের ইতিহাসে আল নাসির চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

মামলুক সুলতান আল নাসিরের রাজত্বকাল:নিম্নে মামলুক সুলতান আল নাসিরের রাজত্বকাল আলোচনা করা হলো-


১. অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন: নিম্নে আল নাসিরের শাসনামলের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

ক. আমিরদের দমন: সুলতান আল নাসির দুইবার সিংহাসনচ্যুত হন এবং তিনবার সিংহাসন লাভ করেন। প্রথমবার আমির কেৎবুঘা ও দ্বিতীয়বার আমির সালার ও দ্বিতীয় রুকনুদ্দিন। বাইবার্স কর্তৃক পদচ্যুত হন। ১৩০৯ খ্রিস্টাব্দে আল নাসির তৃতীয়বার মামলুকদের সিংহাসনে বসেন। প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পর আমিরদের অশুভ তৎপরতা থেকে মুক্তি লাভের জন্য বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রথমে তিনি দ্বিতীয় রুকনুদ্দিন বাইবার্সকে এবং পরে সালারকে হত্যা করেন।

খ. মারজ উস সাফার যুদ্ধ: সুলতান আল নাসিরের রাজত্বকালে মিসরের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সুযোগ নিয়ে গাজান খান মিসর আক্রমণ করেন। গাজান খান মামলুকদের পরাজিত করেন এবং সিরিয়া দখল করেন। কিন্তু একমাস পরেই মোঙ্গলরা সিরিয়া ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এরপর সিরিয়া মামলুকদের অধীনে আসে। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গলরা পুনরায় কুৎলুঘ শাহের নেতৃত্বে সিরিয়া আক্রমণ করে। কিন্তু মোঙ্গলরা এবার মারজ উস সাফার যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং গাজান খান ভগ্ন হৃদয়ে তাবরিজে চলে যান।সিরিয়া, মিসর ও উত্তর আফ্রিকায় মুসলিম শাসনের ইতিহাস (ফাতেমি, আইয়ুবি ও মামলুক বংশ)


গ. বেদুইনদের দমন: ইলখানি মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সময় করভারে অতিষ্ঠ হয়ে বেদুইনরা আল নাসিরের শাসন অস্বীকার করে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সুলতানের আমিরগণ বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ করে গাজা থেকে আফফিত অঞ্চল পর্যন্ত সব পুরুষ বেদুইনকে হত্যা করে তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ সব মালামাল লুণ্ঠন করে কায়রো প্রত্যাবর্তন করে।

ঘ. দুজ সম্প্রদায়কে দমন: দামেস্ক থেকে মামলুক বাহিনীর প্রত্যাবর্তনকালে দুজরা তাদের হেনস্তা করেছিল। আল নাসির ১২ হাজার দুজকে তাদের কৃতকর্মের জন্য সমুচিত শিক্ষা দেন।

৬. মক্কা ও মদিনার আনুগত্য লাভ: মোঙ্গল খান উলজাইতু আল নাসিরের অসুবিধার সুযোগ নিয়ে মক্কা ও মদিনার আনুগত্য লাভ এবং খুৎবায় তার নাম সংযোজন করেন। আল নাসির তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পবিত্র মক্কা ও মদিনার সর্বময় কর্তৃত্ব লাভ করেন।


চ. নুবিয়া ও আর্মেনিয়ায় কর্তৃত্ব স্থাপন: আল নাসিরের আমলে নুবিয়া ও আর্মেনিয়ার শাসনকর্তাগণ বিদ্রোহী হলে তিনি তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করেন।

২. বৈদেশিক নীতি: নিম্নে সুলতান আল নাসিরের বৈদেশিক নীতির বিবরণ দেওয়া হলো-

ক. ফিরোজশাহ তুঘলকের সাথে সুসম্পর্ক: তৎকালীন ভারতের শাসনকর্তা ফিরোজ শাহ তুঘলক তার বন্ধুত্ব কামনা করে দুইবার তার দরবারে দূত প্রেরণ করেন।

খ. বাইজান্টাইনের সাথে সম্পর্ক: সুলতান আল নাসির বাইজান্টাইন সম্রাটের বন্ধুত্ব লাভ করেছিলেন এবং তার সাথে কৌশলপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।

গ. পোপ জনের সাথে সুসম্পর্ক: পোপ জনের সাথেও আল নাসিরের পত্র বিনিময় হয়। উভয়েই পরস্পরের রাজ্যে খ্রিস্টান ও মুসলমান সংখ্যালঘুদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাবের পরিচয় দিবেন বলে অঙ্গীকারাবদ্ধ হন।


ঘ. মোঙ্গলদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন: মোঙ্গল খান আবু সাঈদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে মামলুক-মোঙ্গল সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক বিশেষ পরিবর্তন সূচিত হয়। মোঙ্গল খান আবু সাঈদ 'আল নাসিরের বন্ধুত্ব কামনা করায় উভয়ের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন প্রতিষ্ঠিত হয়।

৩. সংস্কারমূলক কার্যক্রম: সুলতান আল নাসিরের রাজত্বকালে রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত ছিল। তিনি রাজ্যের ভূমি জরিপ করার জন্য সমগ্র রাজস্বকে ২৪ ভাগে ভাগ করে তার ১০ ভাগ রাজস্ব সাধারণভাবে রাজ্যের ব্যয়ের জন্য এবং ১৪ ভাগ আমির ও সেনাবাহিনীর ব্যয়ের জন্য নির্ধারণ করেন। ১৩০৮ খ্রিস্টাব্দে মিসরে দুর্ভিক্ষ হলে তিনি সিরিয়া হতে খাদ্য আমদানি করেন। আল নাসির জনগণের সুবিধার জন্যে আলেকজান্দ্রিয়া খাল খনন করেন। আল নাসির ১৩০৪ খ্রিস্টাব্দে নাসিরিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।


৪. শিল্প ও স্থাপত্যে পৃষ্ঠপোষকতা: সুলতান আল নাসিরের রাজত্বকাল অর্থনৈতিকভাবে উন্নত থাকায় শিল্প ও স্থাপত্যের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। কায়রোর আমিরগণ নিজ তহবিল থেকে অর্থ ব্যয় করে সুবিশাল ৩০টি মসজিদ নির্মাণ করেন। এ সময় মিসরে কারকার্যখচিত সুন্দর সুন্দর গামলা, আতরদানি, ঝুড়ি, কুরসি, পানশালা, টেবিল এবং পিতল নির্মিত পাত্রসমূহ প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল। সিলভার পাত্রের ও জরির কাজ করা কাচের প্রদীপের আকৃতি ও নকশা এবং অন্যান্য ব্যবহার্য দ্রব্যের আলংকারিক মূল্য উন্নতমানের ছিল। আল নাসিরের রাজত্বকালের সুন্দর সুন্দর শিল্পকর্ম এখনও ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। তার বিখ্যাত রাজ প্রাসাদ আল কাসর আল আবলাক ও অন্যান্য বহু প্রাসাদ তার অপূর্ব স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন।


উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সুলতান আল নাসির কম বয়সে দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে সব বাধা পেরিয়ে সাম্রাজ্যকে উন্নতির উচ্চ শিখরে নিয়ে যান, যা তাকে বুকনুদ্দিন বাইবার্স ও কালাউনের সমকক্ষ হতে সাহায্য করেছিল। আল নাসির অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন ও বৈদেশিক সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে রাজ্যকে স্থায়িত্ব দান করেছিলেন, যা তাকে ৪৮ বছর রাজত্ব করতে সাহায্য করে। তবে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও নানা কারণে তার পতন ঘটে।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post