উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমী খিলাফত প্রতিষ্ঠায় আবূ আব্দুল্লাহ আল-শিয়ীর ভূমিকা মূল্যায়ন কর।

উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমী খিলাফত প্রতিষ্ঠায় আবূ আব্দুল্লাহ আল-শিয়ীর ভূমিকা মূল্যায়ন কর।

উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমি খিলাফত প্রতিষ্ঠায় আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ির অবদান মূল্যায়ন কর।

অথবা, উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমি খিলাফত প্রতিষ্ঠায় আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ির ভূমিকা মূল্যায়ন কর।

উত্তর ভূমিকা: হযরত আলি (রা.)-এর জীবদ্দশাতেই শিয়া সম্প্রদায়ের উত্থান ঘটে। তবে কারবালা প্রান্তরে হযরত আলি (রা.)-এর পুত্র ইমাম হোসেনের নৃশংস হত্যাকান্ডের পর শিয়া আন্দোলন ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করে। শিয়ারা রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী না হলেও আধ্যাত্মিকভাবে সমাজে বেশ প্রভাব সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে শিয়া আন্দোলন একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক রূপ লাভ করে উত্তর আফ্রিকায় খিলাফত প্রতিষ্ঠা করে যার মূলে ছিলেন আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ি। তার চমৎকার প্রচারণা ও দৃঢ় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের গুণে ফাতেমি খিলাফত প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়।


উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমি খিলাফত প্রতিষ্ঠায় আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ির অবদান: নিম্নে উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমি খিলাফত প্রতিষ্ঠায় আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ির অবদান আলোচনা করা হলো-

১. ফাতেমি আন্দোলনে যোগদান: নবম শতাব্দীতে ফাতেমি আন্দোলন নতুন গতিবেগ পায়। এ সময় আব্দুল্লাহ বিন মায়মুন নামে পারস্যদেশীয় একজন প্রচারক ও সংগঠন পারস্যের আহোয়াজ ও সিরিয়ার সালামিয়া এবং আব্বাসি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে দাঈ বা শিয়া মতাদর্শ প্রচারক প্রেরণ করেন। এ প্রচারক বাহিনীর সবচেয়ে উদ্যমী, প্রতিভাধর ও অক্লান্ত পরিশ্রমী ব্যক্তিত্ব ছিলেন আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ি। এককালে তিনি বসরার মুহতাসিব ছিলেন। পরে তিনি আশ শিয়ি বা সর্বোত্তম শিয়া খ্যাতি অর্জন করেন। লোকজনকে শিয়া মতবাদে দীক্ষা দিতেন বলে তাকে মোয়াস্তিও বলা হয়। ইয়েমেনের সানার অধিবাসী আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ি পারস্যের আব্দুল্লাহ বিন। মায়মুনের নিকট তার প্রচার কৌশল রপ্ত করেন। প্রচারক বাহিনীর প্রচেষ্টায় নয়া মতবাদ দ্রুত ইয়েমেন, ইয়ামামা, বাহরাইন, মিসর ও উত্তর আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে।


২. উত্তর আফ্রিকায় গমন: অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ি ছিলেন একজন বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ সংগঠক, প্রচারক ও সেনানায়ক। অনলবর্ষী এ নেতার মধ্যে মানুষকে মুগ্ধ ও সম্মোহিত করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। তিনি ৯০১ খ্রিস্টাব্দে একটি হজ কাফেলার সাথে উত্তর আফ্রিকায় গমন করেন। তিনি তার ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক মাহাত্ম্য দ্বারা সেখানকার কাতামা গোত্রের ওপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। তার সুযোগ্য পরিচালনা ও সুদক্ষ প্রচারকাজে মুগ্ধ হয়ে কাতামা গোত্রের বার্বারগণ ইসমাইলীয় মতবাদের প্রতি দারুণভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এভাবে অল্প সময়ের মধ্যে উত্তর আফ্রিকাতে ফাতেমিদের শক্ত ভীত প্রতিষ্ঠিত হয়।

৩. উত্তর আফ্রিকায় নিজের প্রভাব বিস্তার: এ সময় উত্তর আফ্রিকা আগলাবি শাসনাধীনে ছিল। আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ি এ বংশের শাসক জিয়াদাতুল্লাহর (৯০৩-৯০৯ খ্রি.) কুশাসনে তার প্রতি অসন্তুষ্ট বার্বারদের মধ্যে নিজের প্রভাব বিস্তারে নানাভাবে চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে তিনি জনতার কাছে ইমাম মাহদির আগমনের প্রচারণা শুরু করেন।


৪. ইমাম মাহদির অগ্রদূত: আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ি যখন 'জনতার নিকট ইমাম মাহদির আগমনের প্রচারণা শুরু করেন তখন তিনি নিজেকে ইমাম মাহদির অগ্রদূত বলেও প্রচার করেন। উল্লেখ্য যে, নিষ্ঠাবান মুসলমানগণ বিশ্বাস করেন যে, পৃথিবী যখন পাপাচার ও অরাজকতায় পরিপূর্ণ হয়ে যাবে তখন পথভ্রষ্ট মানুষকে সৎপথ প্রদর্শন এবং অত্যাচার অবিচারের হাত থেকে রক্ষার জন্য ইমাম মাহদির আগমন ঘটবে। দুর্দশাগ্রস্ত ইফ্রিকিয়ার মানুষদের কাছে ইমাম মাহদির আগমন তত্ত্ব প্রচার করে আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ি তাদের মুগ্ধ করে ফেলেন। কাতামা গোত্রপতি হাসান বিন হারুন আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ির প্রধান অনুচরে পরিণত হন।

৫. সাঈদকে আমন্ত্রণ ও মুক্তকরণ: প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র প্রস্তুত করার পর আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ি তার ভাই আবুল আব্বাসের মাধ্যমে রাজক্ষমতা গ্রহণের জন্য তদানীন্তন ফাতেমি ইমাম সাঈদকে উত্তর আফ্রিকায় গমনের জন্য সংবাদ প্রদান করেন। সালামিয়ায় অবস্থানরত সাঈদ স্বীয়পুত্র আবুল কাসিম ও আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ির ভাই আবুল আব্বাস কয়েকজন অনুচরসহ অতি সঙ্গোপনে বণিকের ছদ্মবেশে উত্তর আফ্রিকার উদ্দেশ্য রওয়ানা হন। আব্বাসি 'খলিফা আল মুকতাদির তার গুপ্তচরের মাধ্যমে সাঈদের উত্তর আফ্রিকায় গমনের সংবাদ, জেনে যান এবং খলিফার নির্দেশে সিজিলমাসার শাসনকর্তা সাঈদ ও তার সব সঙ্গীদের গ্রেপ্তার করে সেখানে বন্দি করে রাখেন। আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ি সিজিলমাসায় আক্রমণ করে বন্দিদশা থেকে তাদের মুক্ত করেন।


৬. আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ি কর্তৃক সাঈদকে মাহদি হিসেবে পরিচয়: ইমাম সাঈদ অনুচরবর্গসহ আগলাবির রাজধানী রাক্কায় পৌছান। আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ি সাঈদকে সেখানে স্বাগত জানান এবং লোকসমাজে তাকে মাহদি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। পরে তাকে ওবায়দুল্লাহ আল মাহদি উপাধি দিয়ে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করেন। ওবায়দুল্লাহ আল মাহদি খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করে ফাতেমি খিলাফতের শুভ সূচনা করেন।

৭. মূল্যায়ন ও শেষ পরিণতি: উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমি খিলাফত প্রতিষ্ঠায় আব্দুল্লাহ আশ শিয়ির অসামান্য অবদান রয়েছে। ফাতেমি খিলাফত প্রতিষ্ঠায় তিনি যথার্থ কৃতিত্বের দাবিদার। বলা হয়ে থাকে আব্বাসি খিলাফত প্রতিষ্ঠায় আবু মুসলিম খোরাসানির যে অবদান তেমনি ফাতেমি খিলাফত প্রতিষ্ঠায় আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ির অবদান। উল্লেখ্য যে, ওবায়দুল্লাহ আল মাহদি ক্ষমতা গ্রহণের পর তার মধ্যে কোনো অলৌকিক ক্ষমতা দেখতে না পেয়ে লোকজন তার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। অনেকে মনে করেন আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ির মধ্যেও একটি দুরভিসন্ধি ছিল। তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন। যে, ওবায়দুল্লাহ আল মাহদিকে সামনে রেখে তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করবেন। দূরদর্শী খলিফা তা বুঝতে পেরে নিজের ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করার জন্য তার একসময়ের মিত্র ও সুহৃদ আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ি ও তার ভাই আবুল আব্বাসকে দরবারে ডেকে আনেন এবং তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। এভাবেই একজন অসাধারণ প্রতিভাধর নেতার জীবনাবসান ঘটে।


উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ৯০৯ খ্রিস্টাব্দে উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমি খিলাফত প্রতিষ্ঠায় যে কজন ব্যক্তির অসামান্য অবদান রয়েছে তন্মধ্যে আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ির অবদান কিংবদন্তীতুল্য। তার সুযোগ্য নেতৃত্ব গুণেই ফাতেমি খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ওবায়দুল্লাহ আল মাহদি আবু আব্দুল্লাহ আশ শিয়ি ও তার ভাইয়ের একচ্ছত্র আধিপত্য মেনে নিতে না পেরে তাদেরকে হত্যা করেন, যা ফাতেমি খিলাফতের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post