জাতীয় শক্তি কী? সংক্ষেপে জাতীয় শক্তির উপাদানসমূহ বর্ণনা করুন।

 

জাতীয় শক্তি কী? সংক্ষেপে জাতীয় শক্তির উপাদানসমূহ বর্ণনা করুন।

ভূমিকা:

জাতীয় শক্তি ধারণাটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এটি জাতীয় রাষ্ট্রের একটি অংশও বটে। বর্তমানে জাতীয় শক্তিকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের একটি উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ ক্ষমতা হচ্ছে এমন এক উপায়বিশেষ, যা দ্বারা কোনো রাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিকে কার্যকর করে থাকে। সব রাষ্ট্রেরই ক্ষমতা রয়েছে। তবে পরিমাণ ও প্রকারের দিক থেকে তাদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের যুগে পরাশক্তিসমূহের সামরিক শক্তি বা সামর্থ্যকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হতো। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সামরিক শক্তি অর্থনৈতিক শক্তি দ্বারা পরিবর্তিত হয়। তথাপি জাতীয় শক্তির কোনো একক উপাদান অন্যটি থেকে পৃথক নয় বরং একটির সাথে অন্যটি সম্পর্কযুক্ত।

Table of Contents

জাতীয় শক্তি:

জাতীয় শক্তির সংজ্ঞা দানের পূর্বে শক্তি সম্পর্কে কিছু জানা দরকার। সাধারণত শক্তি বলতে বোঝায়, যার সাহায্যে কোনো মানুষ অন্যের মন এবং কাজের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। অধ্যাপক প্যাডেলফোর্ড ও লিংকনের মতে, "কোন রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ এবং জাতীয় উদ্দেশ্য অর্জনের শক্তি ও সক্ষমতার সমষ্টিকে জাতীয় শক্তি বলে।"

জাতীয় শক্তির উপাদানসমূহ:

জাতীয় শক্তির নির্ধারক উপাদান হিসেবে একটি রাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় শক্তির অন্যতম প্রধান উপাদান হলো ভূগোল, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ভূ-রাজনৈতিক মতে, ভূগোল একটা জাতির ক্ষমতা স্থির করে দেয় এবং এর ফলে তার ভাগ্যও নির্ধারিত হয়। এটি বিভিন্ন দিক থেকে জাতীয় শক্তিকে প্রভাবিত করে। নিম্নে আলোচনায় জাতীয় শক্তির উপাদানসমূহ আলোচনা করা হল:

১. ভৌগোলিক অবস্থান:

কোনো দেশের ভৌগোলিক অবস্থান তার ক্ষমতা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তার ভূমিকা নির্ধারণ করে। কোনো দেশের অবস্থান যদি এমন হয় যে, সমসাময়িক বৃহৎ শক্তিগুলোর থেকে দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত, তবে সে তার নিজস্ব জাতীয় জীবন পরিচালনা করতে পারে। বিপরীতভাবে কোনো দেশের অবস্থান যদি এমন হয় যে, সমসাময়িক বৃহৎ শক্তিগুলোর স্বার্থ সেখানে জড়িত, তবে সে অবস্থান তার পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষানীতিকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করবে। দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যস্থানে অবস্থিত সংঘর্ষ নিবারক রাষ্ট্রের (buffer state) অসুবিধার জন্য দায়ী প্রধানত তার ভৌগোলিক অবস্থান। ভৌগোলিক অবস্থানের জন্যই স্থলবেষ্টিত দেশগুলো অনেক অসুবিধা ভোগ করে। অন্যদিকে উপকূলবর্তী দেশগুলো অনেক অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করে। তাছাড়া কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি সামুদ্রিক উপকূলের দ্বারা প্রভাবিত হয়।

২. দেশের আয়তন:

আরেকটি ভৌগোলিক দিক, যার উপর জাতীয় শক্তি নির্ভর করে তা হলো কোনো দেশের আয়তন, স্বভাবতই বৃহৎ আয়তনের দেশ অধিক শক্তির অধিকারী হয়ে থাকে। যেমন- সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই বিশাল ভূ-খণ্ডের মালিক। এটা তাদের জাতীয় শক্তির একটা চিরস্থায়ী সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হতো। কারণ তাদের এই বৃহৎ ব্যাপ্তি বাইরে থেকে আক্রমণ করে এ দুটি দেশকে অধিকার করার যেকোনো আকাঙ্ক্ষাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করতে সক্ষম বলে বিবেচিত হতো। নেপোলিয়ন ও হিটলার রাশিয়া দখল করতে গিয়ে সাফল্য লাভ করতে তো পারেনি বরং রাশিয়া অভিযান তাদের উভয়ের জন্যই পরাজয় ডেকে এনেছে।

৩. দেশের আকৃতি:

কোনো দেশের আয়তনের সাথে তার আকৃতির একটা সম্পর্ক রয়েছে। সাধারণত একই আয়তন বিশিষ্ট আঁটসাঁট আকৃতি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত আকৃতির চেয়ে অধিক সুবিধাজনক। যেমন: ফ্রান্সের মতো মাঝামাঝি আয়তনের দেশ যা অনেকটা গোলাকৃতিবিশিষ্ট এবং যার রাজধানী মাঝখানে অবস্থিত, তাই হলো জাতীয় শক্তি বৃদ্ধির জন্য আদর্শ রাষ্ট্রের উদাহরণ।

৪. ভূ-প্রকৃতি:

ভূ-প্রকৃতিও ভৌগোলিক উপাদানের মধ্যে অন্যতম। কারণ বন্ধুর অর্থাৎ উঁচু-নিচু ভূপ্রকৃতি কোনো দেশের যাতায়াত ব্যবস্থায় বিঘ্নের সৃষ্টি করে। কিন্তু যে দেশ বিশাল বিস্তৃত সমভূমির অধিকারী, সে দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধার জন্য অতি সহজেই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য গড়ে ওঠে, যা জাতীয় শক্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৫. জলবায়ু:

কোনো দেশের জলবায়ু তার জাতীয় শক্তিকে কিছুটা প্রভাবিত করে। কোনো দেশের জলবায়ুর উপর সে দেশের জনসাধারণের স্বাস্থ্য, শক্তি ও কর্মক্ষমতা নির্ভর করে। এ জন্যই দেখা যায়, কোনো কোনো দেশের লোকজন অধিক কর্মক্ষম, আবার অনেক দেশের লোকজন অলস ও কর্মবিমুখ। সাধারণত নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুই জনগণের মধ্যে অধিক কর্মক্ষমতা জুগিয়ে তার জাতীয় উন্নতিতে সহায়তা করে থাকে। অপরদিকে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিবার্তা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প ইত্যাদি অনেক দেশের জাতীয় উন্নতিকে ব্যাহত করে।

৬. জনসংখ্যা:

জাতীয় শক্তিতে জনসংখ্যার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিদ্যমান। অধ্যাপক মরগ্যানথু বলেন, জাতীয় শক্তির যতগুলো উপাদান থাকা দরকার সব উপাদান যদি থাকে কিন্তু জনসংখ্যার যদি ঘাটতি থাকে তবে সে দেশের শক্তি বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা কম। কেবল জনসংখ্যা নয়, জনগণের আর্থিক মান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আধুনিক প্রযুক্তিগত দক্ষতা, উৎপাদন ক্ষমতা, অধ্যবসায়, শৃঙ্খলা ও অপেক্ষাকৃত তরুণ জনসমষ্টি জাতীয় শক্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করে। তাই বলা যায়, কাম্য জনসংখ্যার সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক জাতীয় শক্তির পূর্বশর্ত।

৭. প্রাকৃতিক সম্পদ:

কোনো দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে দুর্বল হলে সে দেশের পক্ষে বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়। জাতীয় শক্তির উপাদান হিসেবে প্রাকৃতিক সম্পদকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা: খাদ্য ও কাঁচামাল। মূলত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় এমন দেশের আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটা দুর্বলতা থেকেই যায়। খাদ্য আমদানি করতে গিয়ে অনেক সময় বাধ্য হয়ে সরকারকে দেশের অনুকূল নয় এমন নীতিও গ্রহণ করতে হয়, যা শক্তি ক্ষুণ্ণ করে। অপরপক্ষে সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণের জন্য যা দরকার তার জন্য কেবল উন্নতমানের ইস্পাত ছাড়াও ইউরেনিয়াম, রাবার, খনিজ তেল, অ্যালুমিনিয়াম, প্লুটোনিয়াম প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়।

৮. শিল্পের উন্নতি:

উন্নত শিল্প কাঠামো বা অর্থনৈতিক বিকাশ একটি দেশের জাতীয় শক্তি বৃদ্ধির প্রধান উপকরণ। প্রাকৃতিক সম্পদ ও কাঁচামাল ব্যবহার করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য প্রয়োজন পুঁজি, কারিগরি দক্ষতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পর্কে আধুনিক জ্ঞান। মূলত অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যতীত কোনো দেশের পক্ষেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি প্রধান শক্তিতে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়। যেমন- জাতীয় শক্তির বিবেচনায় বর্তমানে ইউএসএর যে মর্যাদা রয়েছে সে দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও শিল্পের উন্নতির মাধ্যমেই কেবল এই মর্যাদা অর্জিত হয়েছে।

৯. সামরিক শক্তি:

যেকোনো দেশের সামরিক ক্ষমতাকে সে দেশের জাতীয় শক্তির অন্যতম উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এই সামরিক বাহিনীর দ্বারা বিদেশী আক্রমণ মোকাবিলা করা সম্ভব। এ ছাড়া সশস্ত্র বাহিনীর মোট জনসংখ্যার উপর সামরিক বাহিনী সরাসরি নির্ভরশীল বলে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আর সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য সামরিক বাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং সামরিক বাহিনীর সুদক্ষ ও সুযোগ্য নেতৃত্বও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ যুদ্ধ পরিচালনায় কলাকৌশলের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী একটি জাতিকে জয়ী করতে পারে। তাই সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা সুযোগ্য নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল।

উপরিউক্ত উপাদান ছাড়াও জাতীয় শক্তির আরও কতকগুলো উপাদান রয়েছে, যা নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. রাজনৈতিক কাঠামো: 

জাতীয় শক্তির ক্ষেত্রে অন্যতম উপাদান হলো রাজনৈতিক কাঠামো। মরগ্যানথু বলেন, একটি সুষ্ঠু বা উৎকৃষ্ট ধরনের সরকার ব্যতীত পররাষ্ট্রনীতি প্রয়োগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। গণতান্ত্রিক সরকার জনসমর্থন নিয়ে একটি দেশের নীতি নির্ধারণ করে। জনগণের অসম্মতিতে কোনো নীতি গ্রহণ করলে সরকারের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে, যা জাতীয় শক্তিকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করে দেয়।

২. কূটনীতির মান:

জাতীয় শক্তির অন্য উপকরণগুলোকে কূটনীতির মাধ্যমেই একত্রীভূত করে সঠিকভাবে পরিচালনা করা হয়। পণ্ডিতগণ মনে করেন কূটনীতি হলো জাতীয় ক্ষমতার মস্তিষ্কের মতো। আর আত্মবিশ্বাস হলো তার আত্মা। মূলত কূটনীতি পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য এবং মাধ্যমের সমন্বয় সাধনে সাহায্য করে।

৩. জাতীয় চরিত্র ও আত্মবিশ্বাস:  

জাতীয় চরিত্র ও মনোবলের উপর মূলত জাতীয় শক্তি নির্ভর করে। যেমন- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের প্রবল বিমান আক্রমণ সত্ত্বেও ইংরেজরা জাতীয় মনোবল ও আত্মবিশ্বাসের দ্বারা টিকে থাকে। অন্যদিকে ফরাসিদের দৃঢ় মনোবলের অভাবে ম্যাজিনো লাইনের মতো প্রায় দুর্ভেদ্য ব্যূহ থাকা সত্ত্বেও তারা হিটলারের বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল।

৪. আন্তর্জাতিক মর্যাদা:

মূলত একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি, সামরিক শক্তি, অর্থনৈতিক সামর্থ্য, অন্য দেশকে সাহায্য দেবার ক্ষমতা, জাতীয় সংস্কৃতি, রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রভৃতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদা বৃদ্ধি করে। এতে জাতীয় শক্তি বৃদ্ধি পায়।

৫. অর্থনৈতিক শক্তি:

রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শক্তির উপর জাতীয় শক্তি প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। যে রাষ্ট্র অর্থনীতিতে শক্তিশালী সে দেশের অন্য উপাদানগুলো শক্তিশালী। ফলে এ ধরনের রাষ্ট্রের জাতীয় শক্তি হয় মজবুত।

৬. শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি:  

শিক্ষা, তথ্য ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি জাতীয় শক্তির পরিমাপক হিসেবে কাজ করে। শিক্ষা, তথ্য ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি দেশের সার্বিক উন্নয়নে সহায়তা করে। তাই যে রাষ্ট্র শিক্ষা, তথ্য ও প্রযুক্তিবিদ্যায় যত অগ্রগামী সে রাষ্ট্র তত বেশি শক্তিশালী এবং তার জাতীয় শক্তিও তত দৃঢ় মনোবলসম্পন্ন।

৭. আন্তর্জাতিক অবস্থান:

বিশ্বরাজনীতিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাষ্ট্রের অবস্থান ও তার শক্তি নির্ধারণে সাহায্য করে থাকে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং অন্যান্য দেশ ও বিভিন্ন জোটের সাথে কী সম্পর্ক তার উপরও একটি দেশের শক্তি বহুলাংশে নির্ভর করে। বৈদেশিক কোনো শক্তির সামরিক সাহায্য পেয়ে অনেক সময় অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রও খুব বেশি আকারের শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। যেমন- কোরিয়া, ইসরাইল।

মূলত জাতীয় শক্তির সামাজিক উপাদান, সংস্কৃতি ও আদর্শ অন্যতম উপাদান হিসেবে পরিলক্ষিত হয়। সামাজিক উপাদান রাজনৈতিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ কোনো দেশের জনগণ যদি একই বর্ণ বা ধর্মভুক্ত হয় তাহলে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে খুব সহজেই জাতীয় লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। আবার সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে জাতি যত বেশি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক সে জাতি তত বেশি শক্তিশালী। তা ছাড়া সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও আদর্শ ব্যতীত কোনো রাষ্ট্রই জাতীয় শক্তিতে বলীয়ান হতে পারে না। এ জন্যই আদর্শকে জাতীয় শক্তির উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়।

জাতীয় শক্তি কী? সংক্ষেপে জাতীয় শক্তির উপাদানসমূহ বর্ণনা করুন।

আন্তর্জাতিক রাজনীতির নির্ধারক হিসেবে শক্তি ও আদর্শের ভূমিকা:

আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে শক্তি ও আদর্শ উপাদান দুটি বিশেষভাবে প্রভাবিত করে থাকে। অধ্যাপক ফ্রিডম্যানের দৃষ্টিতে রাজনীতিতে অধিকাংশ আন্তর্জাতিক বিবাদ-বিসম্বাদ শক্তির রাজনীতি এবং আদর্শ এই দুইয়ের সংমিশ্রণের ফলে ঘটে থাকে।

শক্তির ভূমিকা:

নিম্নে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নির্ধারক হিসেবে শক্তির ভূমিকা আলোচনা করা হলো:

১. সম্পদের প্রাচুর্য: মূলত আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো রাষ্ট্রের সম্পদের প্রাচুর্যকে কেন্দ্র করে যে শক্তি গড়ে ওঠে তা একটু আলাদা হয়ে থাকে। যেমন- বিভিন্ন দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদ, খনিজ তেল, কয়লা প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে শক্তির প্রকাশ ঘটে। তাই সম্পদের প্রাচুর্যকে কেন্দ্র করে যে শক্তি অর্জিত হয় তা আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে থাকে।

২. জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রভাব পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র ও জনসমষ্টির জাতীয়তাবাদী শক্তি সুপ্রাচীনকাল থেকেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যেমন- জার্মানরা জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে মনে করত যে, তারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। পৃথিবীর অপরাপর জাতির উপর প্রভুত্ব করার অধিকার তাদের আছে। এই জাতীয়তাবোধ জাতীয় শক্তির নামান্তর।

৩. ক্ষমতার প্রভাব: মূলত ব্যক্তিগত ক্ষমতা বা শক্তিও আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ইতিহাসের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, মধ্যযুগে ইউরোপের পোপ ও সম্রাটদের মধ্যে যে বিবাদ ছিল তা ব্যক্তিগত শক্তিরই বহিঃপ্রকাশ। তা ছাড়াও নেপোলিয়নের স্বৈরাচারী একক প্রাধান্য, মুসোলিনি ও হিটলারের একক প্রভুত্ব ব্যক্তিগত ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।

৪. কূটনৈতিক শক্তির প্রভাব আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কূটনৈতিক কলাকৌশলকেও শক্তির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ বিভিন্ন কূটনৈতিক কলাকৌশলের মাধ্যমে অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বা পররাষ্ট্র বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে নিয়ন্ত্রণ করার যে ক্ষমতা কোনো রাষ্ট্র লাভ করে তাকেও এক ধরনের শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শক্তির আত্মপ্রকাশ বিভিন্নভাবে ঘটে থাকে। আর এ আত্মপ্রকাশের মাধ্যমেই শক্তি আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে নির্ধারণ করার সুযোগ পায়।

৫. জনশক্তি ও অস্ত্রশস্ত্রের প্রাচুর্য কোনো জাতি যখন জনশক্তি বা অস্ত্রশস্ত্রের প্রাচুর্যে শক্তিশালী হয়ে ওঠে তখন অপরাপর শক্তিগুলোর মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। এ ভীতি সৃষ্টি করে যে ক্ষমতা অর্জন করা যায় তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তির অন্তর্ভুক্ত। আবার নিজের দেশের এবং অন্যান্য দেশের জনগণকে একটি শক্তি নিজের ইচ্ছানুযায়ী বা সুবিধানুযায়ী নির্দিষ্ট পথে যদি পরিচালিত করার প্রয়াস চালায় এবং সার্থক হয় তাহলে তাকেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তির অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

আদর্শের প্রভাব:

আন্তর্জাতিক রাজনীতি কেবল শক্তি বা ক্ষমতার দ্বারা প্রভাবিত হয় না। কারণ বর্তমান যুগে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো বিবাদ-বিসম্বাদ বা সমস্যাকে কেবল শক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায় না। বর্তমানে শক্তির সাথে সাথে তাই একটি উপাদান কাজ করে, আর সেটা হচ্ছে আদর্শ। প্রকৃতপক্ষে একটা জাতির শক্তি হলো নিজস্ব রাষ্ট্রীয় আদর্শকে বাস্তবে কার্যকর করার প্রচেষ্টা। নিম্নে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নির্ধারক হিসেবে আদর্শবাদের প্রভাব আলোচনা করা হলো-

১. স্নায়ুযুদ্ধে আদর্শবাদের প্রভাব ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে বলশেভিকদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভ সমগ্র বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে এক নতুন শক্তি ও প্রেরণার সঞ্চার করে। সোভিয়েত রাশিয়া বিশ্বব্যাপী মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদী আদর্শের প্রসার ঘটাতে উদ্যোগী হয়। এর প্রতিক্রিয়া পাশ্চাত্যের ধনতান্ত্রিক ও উপনিবেশবাদী দেশগুলোতে দ্রুত অনুভূত হয়। এসব দেশ গণতান্ত্রিক আদর্শের নামে সোভিয়েত নীতির মোকাবিলায় অগ্রসর হয়। এরা সোভিয়েত আদর্শকে একনায়কতান্ত্রিক হিসেবে বর্ণনা করে এবং গণতন্ত্র রক্ষার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর হয়। এভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক সমাজতন্ত্র এবং পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের মধ্যকার সংঘাত জটিলতর রূপ ধারণ করে। উভয় শিবিরের মধ্যকার এই সংঘাত বা স্নায়ুযুদ্ধ বহুলাংশে আদর্শবাদকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়।

২. গণতন্ত্র ও সাম্যবাদী আদর্শের প্রভাব আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের পতন হলে এদের স্থান দখল করে গণতন্ত্র ও সাম্যবাদ। গণতন্ত্র ও সাম্যবাদই আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে দেখা দেয়। বিগত ঠাণ্ডা লড়াইয়ের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে পূর্ব ও পশ্চিম ব্লকের মধ্যে সংঘর্ষ মূলত আদর্শের সংঘর্ষ। এ সংঘর্ষ ধনতন্ত্র ও সাম্যবাদের সংঘর্ষ। শ্রেণিবৈষম্যহীন এক সাম্যবাদী সমাজ স্থাপন করাই সাম্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর আদর্শ। অপরদিকে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো গণতান্ত্রিক, ধনতান্ত্রিক বা উদার ধনতন্ত্র স্থাপন করতে চায়। এ উভয় আদর্শকে কেন্দ্র করেই বিশ্বে দেখা দেয় আন্দোলন, বিপ্লব, বিদ্রোহ ও যুদ্ধবিগ্রহ। আধুনিক জগতে পূর্ব ব্লকের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র এবং পশ্চিম ব্লকের গণতন্ত্রভিত্তিক ধনতন্ত্র বিভিন্ন রাষ্ট্রের আদর্শেরই প্রকাশ।

৩. আদর্শের ঐতিহ্যিক প্রভাব আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, এমনকি আধুনিক যুগেও বিভিন্ন দ্বন্দ্বের পশ্চাতে আদর্শের ভূমিকা স্পষ্ট। মধ্যযুগে ক্রুসেড যুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের হাত থেকে যিশুখ্রিস্টের সমাধিস্থল উদ্ধার এবং সেই সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের প্রাধান্য স্থাপন। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপের বিভিন্ন রাজন্যবর্গের একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন ও অন্যান্য দেশের উপর রাজনৈতিক প্রাধান্য স্থাপনের পশ্চাতে আদর্শই কাজ করেছিল। তা ছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ইতালির ফ্যাসিবাদ ও জার্মানির নাৎসিবাদ একক প্রাধান্যের আদর্শের উপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক নিরঙ্কুশ প্রাধান্য অর্জনের জন্য যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকার নীতি অনুসরণ করেছিল।

৪. সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনধারা নিয়ন্ত্রণে আদর্শবাদ সুদূর অতীতকালে আদর্শবাদ মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনধারা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আর বর্তমান শতাব্দীতে জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও আদর্শবাদ অতীতের তুলনায় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। জোসেফ রুসেকের মতে, নতুন ভাবধারা যে আমাদের যুগে প্রথমবারের মতো সৃষ্টি লাভ করেছে বা আমাদের যুগেই যে আদর্শগত দ্বন্দ্ব বিরোধ প্রথমবারের মতো প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে এমন নয়। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর ধর্মযুদ্ধকালীন সময় ব্যতীত কোনো যুগেই এত বহুমুখী মতবাদ প্রসার লাভ করেনি। কোনো যুগেই আদর্শবাদের সংঘাত এত গভীরতা লাভ করেনি এবং এত জটিল রূপ পরিগ্রহ করেনি।

৫. স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রেরণা দান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আদর্শবাদের প্রভাব কেবল ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; উপরন্তু তা এশিয়া ও আফ্রিকার ভূখণ্ডেও বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। জাতীয়তাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আদর্শ এশিয়া ও আফ্রিকার ঔপনিবেশিক দেশগুলোর জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রভূত পরিমাণে উৎসাহ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। এরূপ সংগ্রামের ফলস্বরূপ গোটা বিশ্বে অনেক নতুন নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আদর্শবাদের ভালো-মন্দ উভয় দিকই রয়েছে। মানবজাতির যথার্থ কল্যাণ সাধনের জন্য আদর্শবাদকে ব্যবহার করা যেতে পারে; আবার তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সংঘাত তথা যুদ্ধ ঘটানোর কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে। রাষ্ট্রনায়কগণের সদিচ্ছা ও দূরদর্শিতার উপরই আদর্শবাদের সার্থক প্রয়োগ নির্ভর করে।

উপসংহার: 

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের দশকগুলোতে বিশ্বরাজনীতি উত্তেজনাপ্রবণ হয়ে উঠেছিল এবং এর প্রধান কারণ ছিল জাতীয় শক্তি বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় একাধিক রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ। বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রের জাতীয় শক্তি সম্প্রসারণকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি দিনের পর দিন উত্তেজনাময় হয়ে পড়েছিল। অর্থাৎ বিশ্বের আন্তর্জাতিক সংঘর্ষগুলো শক্তি ও আদর্শের মিশ্রণেই সৃষ্টি হয়েছিল। সুতরাং আন্তর্জাতিক রাজনীতির নিয়ামক হিসেবে শক্তি ও আদর্শের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Post a Comment

Previous Post Next Post