ভূমিকা:
বিশ্বরাজনীতির প্রধান নিয়ামক হলো ক্ষমতা। অন্য রাষ্ট্র বা ব্যক্তির উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হলো ক্ষমতা। আর এই ক্ষমতা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। তবে বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অর্থনীতিই মূল ক্ষমতা বা নিয়ামক হিসেবে কাজ করে, আর এই অর্থনীতিই নির্ধারণ করে বিভিন্ন রাষ্ট্র বা সমাজের মধ্যে পার্থক্য। বিশ্বরাজনীতির দিকে তাকালে দেখা যায়, সর্বত্রই শক্তির দ্বন্দ্ব। আর এই শক্তির মূল চালিকাশক্তি হলো অর্থনীতি। অতএব অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহ অনুধাবন ছাড়া আন্তর্জাতিক ক্ষমতার ধারণা লাভ সম্ভব নয়।
Table of Contents
শক্তি বা ক্ষমতা কি :
সাধারণ অর্থে ক্ষমতা বলতে শারীরিক বা সামরিক সামর্থ্যকে বোঝায়। আর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতা বলতে বোঝায় কোনো জাতির সার্বিক সামর্থ্য, যার দ্বারা ঐ জাতির উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়।
Palmar and Perkins-এর মতে, শক্তি বলতে এমন এক উপায়কে বোঝায়, যার দ্বারা কোনো কোনো রাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক নীতিকে কার্যে প্রয়োগ করে।
Morgantheau-এর মতে, কোনো ব্যক্তি যদি অন্য ব্যক্তির কাজকর্ম ও মনের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে তাহলে বলা যাবে সেই ব্যক্তির শক্তি বা ক্ষমতা আছে।
সুতরাং ক্ষমতা হলো একটি মানসিক বা বিশ্বাসের ব্যাপার। এটি এমন একটি উপাদান, যার সাহায্যে কোনো ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের কার্যক্রমের উপর প্রভাব বিস্তার করা যায়।
নয়া আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতা হিসেবে অর্থনীতি:
অর্থনীতি এমন এক শক্তি, যা সুদূর অতীত থেকেই সমাজ ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। বর্তমান যুগেও অর্থনৈতিক সামর্থ্যই কোনো সমাজের বা রাষ্ট্রের মর্যাদা নির্ধারণ করে। বর্তমানে মানুষ আরো বেশি বাস্তবমুখী। পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শক্তি হিসেবে অর্থনীতি পেয়েছে বহুমাত্রিকতা। নিচে নয়া আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা হিসেবে অর্থনীতির ভূমিকা আলোচনা করা হলো-
১. উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ:
বর্তমান
নয়া আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় উন্নত বিশ্ব কর্তৃক তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ নিয়ন্ত্রণে
তাদের অর্থনৈতিক অস্ত্রই ব্যবহার করছে। তৃতীয় বিশ্বের অনগ্রসর এসব দেশ তাদের
প্রয়োজনের তাগিদে উন্নত বিশ্বের সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। অর্থনীতিতে শক্তিশালী
উন্নত বিশ্ব এই সুযোগে তৃতীয় বিশ্বকে কঠিন শর্তে ঋণদান করে। ফলে তৃতীয় বিশ্বের
দেশগুলো বাধ্য হয় তাদের ক্ষমতা বলয়ে থাকতে। উন্নয়নশীল বিশ্ব উন্নত বিশ্বের নিকট
থেকে প্রতিনিয়তই বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করে তাদের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে।
২. উন্নতি ও প্রগতির মাধ্যম:
ব্যক্তিজীবনের
ন্যায় আন্তর্জাতিক ও জাতীয় জীবনেও সাফল্য লাভের জন্য অর্থনৈতিক ক্ষমতার গুরুত্ব
অপরিসীম। অনেকেই বলে থাকেন, বৈদেশিক সাহায্য
হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলোর জন্য অক্সিজেনস্বরূপ। অর্থাৎ, অক্সিজেন ছাড়া যেমন মানুষ বাঁচতে পারে না, তেমনি বৈদেশিক সাহায্য ছাড়াও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর
অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। বহুবিধ সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, উন্নত বিশ্বের আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা ব্যতীত দেশগুলোর
সার্বিক উন্নতি-অগ্রগতি ব্যাহত হতে বাধ্য।
৩. জাতীয় শক্তির উপাদান:
নয়া
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জাতীয় শক্তির উপাদান হিসেবে অর্থনীতির অবস্থান
সবার শীর্ষে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কেবল জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান ও কল্যাণ সাধনের
সঙ্গে জড়িত থাকে না বরং পররাষ্ট্রনীতির সাফল্যের জন্যও অর্থনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োজন
অর্থাৎ,
জাতীয় শক্তিকে দৃঢ় করতে চাইলে অর্থনৈতিক সামর্থ্য ছাড়া তা
সম্ভব নয়। বর্তমান উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় শক্তির দুর্বলতার মূল কারণ
অর্থনৈতিক।
৪. নয়া ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ:
দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের
প্রভাবে সাবেক ঔপনিবেশিক দেশগুলো স্বাধীন হয়। ফলে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো কিছুটা
বিপাকে পড়ে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য তারা তৃতীয় বিশ্বের নব্য স্বাধীন এসব
দেশকে পরোক্ষভাবে শাসন-শোষণের জন্য নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসে। অর্থনীতিই
এক্ষেত্রে তাদের শক্তিশালী হাতিয়ার। বিভিন্ন উপায়ে এসব দেশের অর্থনৈতিক অঙ্গনকে
নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তারা গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হচ্ছে।
ফলে সুগম হয়েছে নব্য ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের পথ।
৫. মার্কিন পরাশক্তির কারণ:
নব্বইয়ের দশকে স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পর বিশ্বে বর্তমানে একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। স্নায়ুযুদ্ধকালে পুঁজিবাদী বিশ্বের নেতার ন্যায় বর্তমানে তারা গোটা বিশ্বেরই নেতৃত্ব লাভ করেছে অর্থনৈতিক ক্ষমতা দ্বারা। বিশ্বের বিভিন্ন জনসমাজে অর্থনৈতিক সাহায্যদান প্রসঙ্গে ইউএসএর সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি মন্তব্য করেন, “বৈদেশিক সাহায্য হচ্ছে এমন একটি উপায়, যার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বজায় রাখতে এবং অনেক দেশকে ফিরিয়ে রাখতে পারবে, যারা নিশ্চিতভাবে কমিউনিজম ব্লকে চলে যেত। "
অর্থনীতির
দৃঢ়তার কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে সাহায্য দিতে পারছে এবং
নিজেদের পরাশক্তির আসনটি ধরে রাখতে পারছে।
৬. সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে অর্থনীতির প্রভাব:
১৯১৭
সালে রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের প্রথম
সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। পরে প্রায় গোটা বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী
দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সূচিত হয় স্নায়ুযুদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে
পাল্লা দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নও উত্তরোত্তর সাফল্য অর্জন করতে থাকে। কিন্তু ১৯৯০ সালে
সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতনের ফলে সাবেক সোভিয়েত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। বিশ্লেষকদের
মতে,
সমাজতন্ত্রের অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কারণে প্রতিযোগিতামূলক
বিশ্বব্যবস্থায় সোভিয়েত ইউনিয়ন তার সমস্যাবলি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এর মূলেই রয়েছে
তাদের অর্থনৈতিক বিপর্যয়।
৭. জাপানের উত্থান:
দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান ব্যাপক ও অবর্ণনীয় ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কিন্তু কৌশলী ও
পরিশ্রমী জাপানিরা অতি অল্পদিনেই তাদের অবস্থান আমূল পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে।
সামরিক দিক থেকে না হলেও অর্থনীতিতে জাপান বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি। বিশ্ব
শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় ব্যাপক অর্থনৈতিক সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে
জাপান বিশ্বে তার সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষমতায় বলীয়ান
জাপান বর্তমানে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী আসন লাভে তৎপর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও আয়তনে বিশাল না হয়েও জাপান তার অর্থনৈতিক
সামর্থ্যের কারণেই আজ বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি।
৮. শান্তি রক্ষায় অর্থনৈতিক অবরোধ:
বিশ্ব
শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় আগ্রাসী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ
খুবই ফলপ্রসূ। জাতিসংঘ সনদের স্বীকৃত শান্তি রক্ষায় এটিই প্রাথমিক পদক্ষেপ।
জাতিসংঘ যদি মনে করে যে, কোনো শক্তি বা
জোটের কর্মকাণ্ড বিশ্ব স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ, তবে জাতিসংঘ সেক্ষেত্রে উক্ত অপশক্তিকে দুর্বল করার জন্য
শাস্তিস্বরূপ অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। ১৯৯১ সালে উদ্ভূত উপসাগরীয় সংকটে জাতিসংঘ
আগ্রাসী ইরাকের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ ক্ষমতা ব্যবহার করেছিল। জাতিসংঘ কর্তৃক আরোপিত
অর্থনৈতিক অবরোধের ভয়েই অনেক অপশক্তি তাদের দূরভিসন্ধি থেকে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
ফলে বিশ্বে শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা রক্ষা পায়।
৯. বহু মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার উদ্ভব:
আপাতদৃষ্টিতে
অনেকের কাছে মনে হতে পারে যে,সোভিয়েত
পরাশক্তির পতনের পর বিশ্বে সূচিত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন
এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা। কিন্তু বিশ্ব বাস্তবতায় এটাই পরিদৃষ্ট হচ্ছে যে, গোটা বিশ্বে মার্কিনদের নিরঙ্কুশ প্রভাব থাকা সত্ত্বেও
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে জোটের উদ্ভব হচ্ছে। এসব জোটের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও আঞ্চলিক
স্বার্থ সংরক্ষণ করা। EU, ECO, G-8, ASEAN প্রভৃতি জোট তারই ইঙ্গিতবহ। এসব জোট অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির
মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারে এগিয়ে আসছে। ফলে বিশ্বব্যাপী
একক মার্কিন কর্তৃত্ব হয়ে পড়েছে হুমকিগ্রস্ত।
উপসংহার:
প্রাচীনকাল
থেকে মানব ও সমাজ জীবনে অর্থনৈতিক ক্ষমতার গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান যুগ ও এর
ব্যতিক্রম নয়। বিশ্বের ক্ষমতার মূলেই রয়েছে অর্থনীতি। বর্তমান পরিবর্তিত
বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে অর্থনৈতিক ক্ষমতার রয়েছে বহুমাত্রিক গুরুত্ব। ব্যক্তি ও
জাতীয় জীবনের ন্যায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও কোনো রাষ্ট্রের মর্যাদার মাপকাঠি
অর্থনৈতিক শক্তি। অর্থনৈতিক ক্ষমতাহীনতার কারণেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো যেমন
বিশ্বরাজনীতিতে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না, তেমনি অর্থনৈতিক ক্ষমতাই উন্নত বিশ্বকে গোটা বিশ্বরাজনীতি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ
প্রদান করেছে। বিশ্বের রাজনৈতিক কাঠামোর দিকে লক্ষ্য করলে প্রতীয়মান হয় যে, অর্থনীতিই বর্তমান বিশ্বরাজনীতির নিয়ন্ত্রক।