ভারতের পানি চুরি ও যত কূটকৌশল

 

গঙ্গা ব্রহ্মপুত্রসহ মোট ৫৪টি নদী ভারতের দিক থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আর তিনটি নদী বাংলাদেশে এসেছে মিয়ানমার থেকে। তবে একটি নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে গিয়ে আবারো ভারতে প্রবেশ করেছে। যা গঙ্গা ও তিস্তা দুই দেশের মধ্যে জল বন্টন নিয়ে সব থেকে বড় আলোচিত বিষয়। এদিকে আসামের বরাক নদীর শাখা কুশিয়ারা আর অন্যটি  ত্রিপুরার ফেনী নদীর জলবন্টনের চুক্তি সফলভাবে সম্পন্ন করেছে দুই দেশ।  

আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, পুরো অভিন্ন নদীর জলের উপর একচ্ছত্র দখল  উজান বা ভাটিতে থাকা কোন দেশেরই থাকতে পারেনা।  এইসব আন্তর্জাতিক রীতির মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো কোন প্রকল্প শুরু করার আগে তার প্রভাব খতিয়ে দেখা আর ভাটি অঞ্চলের দেশে তার কতটা প্রতিঘাত পড়বে সেটা তাদের জানিয়ে দেয়া।  আন্তর্জাতিক নীতি অনুসারে ভাটির দেশ হিসেবে এই ৫৪টি নদীতে বাংলাদেশেরও রয়েছে সমান হিস্যা।  কিন্তু কোন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই ভারত ৩০ টি নদীতে একের পর এক বাধ দিয়ে গেছে ইচ্ছেমতো।

পানি নিয়ে ভারতের রাজনীতি আর আগ্রাসন নীতি বরাবরের মতো আবারও প্রমাণ করল ভারত।  
অমানবিকভাবে হঠাৎ বাঁধ খুলে দিয়ে ভারত যে আচরণ করেছে তাতে বাংলাদেশের আপামর জনতা ক্ষোভে  ফুসে উঠেছে।  এজন্য দেশটিকে দায়ী করা হলেও মানতে নারাজ তারা।  

তাদের দাবি তাদের অঞ্চলই ডুবে মরছে আর বাঁধের গেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেছে।  কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম আর বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে ছাত্র-জনতা সহ বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্ন দানা বেধেছে। যেমন যদি ভারতবাঁধ না দিত তাহলে নদী স্বাভাবিকভাবে চলত।  এতে যত বৃষ্টি হোক না কেন তা হয়তো এতটা সর্বনাশ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতো না।

ভারত বাঁধ  দিয়েছে নিজেদের স্বার্থে।  আর যখন নিজেদের জানমাল  নিয়ে বিপদে পড়েছে তখনই গেট খুলে দিয়েছে। বাঁধের গেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে খোলার আগে অবশ্যই পানির লেভেলের একটা উচ্চতায় পৌঁছাতে হয়।  যেটা দেখে কয়েক ঘণ্টা আগে সতর্কবার্তা পাঠানো দেশটির অপরিহার্য কর্তব্য ছিল।  কিন্তু ভারত সেটি করেনি। ফলে ভাটির দেশ বাংলাদেশ রাতারাতি ডুবে যায় পানির তলে।  

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়ে ১১ জেলার অর্ধ কোটির বেশি মানুষ।  ভারতের নদী নিয়ে যে কূটনীতি তা নতুন নয়।  এর আগেও বাংলাদেশের জনগণ দেখেছে তিস্তার ইস্যুতে দেশটির রাজনীতি। সেই হিসেবে বাংলাদেশে প্রলয়ংকারী এ বন্যার জন্য  ভারতের ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই দেখছেনা জনগণ।  

আর চুক্তি নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার আর পশ্চিমবঙ্গের মমতার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের যে কারণ দেখানো হয় তাতে বাংলাদেশের মানুষ বলি হবে কেন এমন প্রশ্ন জনমনে।  এজন্য বাংলাদেশের সরকারকে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান তারা।  

ভারত যেহেতু উজানী দেশ তাই অভিন্ন নদী গুলোর জল বন্টনের ব্যাপারে ভারতের যতটা না মাথাব্যথা তার থেকে অনেক বেশি দুশ্চিন্তা বাংলাদেশের। সমস্যাটা তাদেরই ভুগতে হয় বেশি।  এজন্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভাটির দেশ বাংলাদেশের উচিত জল বন্টন নিয়ে আরো বেশি চাপ দেয়া।

তবে বাংলাদেশের চাপ তৈরি করলে যে অভিন্ন নদীর উপরেও কোন প্রকল্প থেকে ভারতকে  পিছু হাটানো সম্ভব তার  উদাহরণ হচ্ছে টিপাই মুখ।  মনিপুরে যে টিপাই মুখ প্রকল্পের কথা ভেবেছিল ভারত সেই সময় বাংলাদেশ প্রবল আপত্তি তোলে।  তাতে বরাক নদীতে বাঁধ দেওয়া হলে তা বাংলাদেশে কি ক্ষতি সাধন করতে পারে সেটা নিয়েও তারা অত্যন্ত সরব হয়েছিল।  শেষমেষ ভারত পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল।  

২০২৪ সালের বন্যায় ভারতের বাঁধ খুলে দেয়ার বিষয়টি কটাক্ষ করে নেটিজেনরা বলছেন বাঁধের বিপরীতে বাঁধ বানাতে।  কত টাকা লাগে জনগণ টাকা দেবে দরকার হলে জনগণ বিনা পয়সায় বাঁধের কাজ করবে। এমন পোস্ট এখন ফেসবুকে ট্রেন্ড।

তবে ভারত থেকে নেমে আসা ঢলের পানি বা পক্ষান্তরে বাংলাদেশের  বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া ঠেকাতে নতুন করে বাধ নির্মাণ কোন কাজে আসবে কিনা সে বিষয়ে বিশ্লেষণ ও আলোচনাও দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

যেমন মোঃ তানভীরুল অমিয় নামের এক প্রকৌশলী লিখেছেন, পরিকল্পনা ছাড়া ভারতের সব ট্রান্স বাউন্ডারি রিভারের  বাঁধের সামনে আর একটা বাঁধ নির্মাণ শুরু করলে বাংলাদেশ মরুভূমিতে পরিণত হবে।।  উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেছেন, তিস্তা নদীর উপর ভারতে যে বাধ নির্মাণ হয়েছে তার নাম গজলডোবা বাঁধ। তার একটি ডাউন স্ট্রিমে বাংলাদেশের নীলফামারীতে তিস্তা নদীর উপরে রয়েছে তিস্তা বাঁধএই তিস্তা বাঁধ উত্তরাঞ্চলে বন্যা মোকাবেলায় খুবই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখলেও এত অল্প দূরত্বে দুটি বাঁধ নদীর ডাউন স্ট্রিমকে ধুধু বালুতে পরিণত করেছে।  অমিয়র  স্ট্যাটাসটি অনেক প্রকৌশলী গবেষক পরিকল্পনা বীদ ও স্থাপতিরা শেয়ার করেছেন।

বাঁধ নির্মাণ প্রসঙ্গে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া আরো একটি স্ট্যাটাস এমন যে, ফারাক্কার ৪০ কিলোমিটার দূরে ৭৫০০ ফিট উচ্চতার দ্বিতীয় ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করতে হবেএরপর ভারত বর্ষায় বাঁধ খুলে দিলে পানি এই ৪০ কিলোমিটারের মধ্যেই থাকবে।  যদি তার বেশি পানি ছাড়ে সেই পানি তাদের দেশেই  ফেরত যাবে কারণ তাদের বাঁধের উচ্চতা থাকবে আমাদের বাঁধের চেয়ে ৭৩৫০ ফিট কম।

এ ধরনের দাবির ব্যাপারে তরুণ প্রকৌশলী তানভীরুল ইসলাম অমিয়র যুক্তি, ভারত বাঁধ খুলে দিলে আমরা আমাদের বাঁধ বন্ধ করে দিব আর বন্যার পানি আবার ভারতে চলে যাবে এটা শুনতে খুব মজার  মনে হলেও ব্যাপারটা এত সহজ না।

নদীর ধর্ম হচ্ছে আপ স্ট্রিম থেকে ডাউন স্ট্রিমে যাওয়া তাই আপনি বাংলাদেশের অংশে একটা বাঁধ নির্মাণ করে দিলেই নদীর রিভার্স দিকে প্রবাহিত হওয়া শুরু করে এমন সম্ভাবনা খুবই কম।  এক্ষেত্রে দুটি জিনিস হতে পারে নদী ব্যারেজের আশেপাশে আরেকটা  বিকল্প রুট তৈরি করে সেদিক দিয়ে পানি প্রবাহিত হতে শুরু করবে অথবা নদীর পানি বাঁধের একদম আপ স্ট্রিমে জমা হতে হতে একসময় বাঁধ ভেঙ্গে  ফেলবে বা ওভারটপ করবে। দুই সিনারিতেই কিন্তু পরিণতি একই। বাংলাদেশে আরও ভয়ানক ফ্লাস ফ্ল্যাড এবং তীব্র নদী ভাঙ্গন।

নিজেদের নদী বন্দর কৃষি আর জনপদ  বাঁচাতে ভারত সরকার ১৯৫১ সালে বাংলাদেশ সীমানার ১০ কিলোমিটার উজানে মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা নামক স্থানে বাঁধ দেওয়ার সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার প্রতিবাদ জানালেও  চুপিসারে  কাজ এগিয়ে নেয় ভারত।  পরে পরীক্ষামূলকভাবে ৪১ দিনের জন্য  বাঁধ  চালু  করার কথা বলে আজ ৫৩ বছর   পরে  এসেও সেই পরীক্ষা শেষ হয়নি।  

এই ফারাক্কা বাঁধ যে শুধু বাংলাদেশের জন্যই ক্ষতি ডেকে  এনেছে তা কিন্তু নয়।  পশ্চিমবঙ্গের মালদা ও মুর্শিদাবাদে বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের শিকার লাখো মানুষের দুর্ভোগের কারণ এই বাঁধ। উত্তর প্রদেশের বিহারের বন্যাকবলিত মানুষেরাও দুসছেন ফারাক্কা বাঁধকে। এজন্য ফারাক্কা বাঁধ ভেঙ্গে ফেলার দাবি জোরালো হচ্ছে ক্রমশ।


এই বাঁধের কাজ ছিল মৃতপ্রায় হুগলি নদীতে পলিমাটি কমিয়ে সেটাকে বাঁচিয়ে তোলা কিন্তু সেটি করতে গিয়ে বিপদ বেড়েছে সুন্দরবনের অববাহিকায় জল কমে গেছে বলে দাবি করেন তিনি।  এছাড়াও বাঁধের ফলে উজান ও ভাটিতে প্রবল ভাঙ্গন শুরু হয়েছে যার প্রভাব পড়েছে মানুষের জীবন জীবিকার উপর। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতিশ কুমার ও ধারাবাহিকভাবে প্রায় ১০ বছর ধরে ফারাক্কা বাঁধের বিরোধিতা করেছেন।

তবে কি বাতিল হচ্ছে ফারাক্কা ব্যারেজ

বিশেষত 2016 সালের পর থেকে বেশ কয়েকবার বিহারে বড় বন্যা হলে সোচ্চার হোন তিনি। 2019 সালে বাঁধ ভেঙ্গে দেয়ার দাবি তুলেছিলেন নিতিশ কুমারের পানি সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী সঞ্জয় কুমার ঝা।  তার কথা, হয় ফারাক্কা ভেঙ্গে দাও না হয় বন্যার পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে দাও।  


পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী কপিল ভট্টাচার্য পরিকল্পনার শুরুতেই বিরোধিতা করেছিলেন তিনি নানা যুক্তি তুলে ধরে বলেছিলেন ফারাক্কা বাঁধ সবার জন্যই মরণ ফাঁদ।  ভারতের স্বাধীনতার পর যখন বড় বড় বাঁধ নির্মাণ করার পরিকল্পনা চলছে তখন প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এই বড় বাঁধগুলোকে বলেছিলেন আধুনিক ভারতের মন্দির।  সেই সময় কপিল ভট্টাচার্যই  বড় বাঁধের বিপক্ষে মুখ খোলেন।  সেই সময়ে কপিল ভট্টাচার্যকে পাকিস্তানের চর  বলে আখ্যা দিয়েছিল ভারত।

বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে অভিন্ন নদীগুলোর পানি বন্টন প্রশ্নের দ্বিপাক্ষিকভাবে অগ্রগতি না হওয়ায় এখন আন্তর্জাতিক তৃতীয় কোন পক্ষের সহযোগিতা নেয়া উচিত বাঙ্গলাদেশের।

Post a Comment

Previous Post Next Post