নিরস্ত্রীকরণ কী? বিশ্বের নিরস্ত্রীকরণের উদ্যোগ বাস্তবায়নের সমস্যাসমূহ আলোচনা করুন।

 

নিরস্ত্রীকরণ কী

আমাদের আজকের আলোচনায় নিরস্ত্রীকরণ কী এবং নিরস্ত্রীকরণ সংক্রান্ত নানান চুক্তি, এর সমস্যা ও সমাধান নিয়ে আলোচনা করব।

Table of Contents

ভূমিকা:

বিংশ শতাব্দীতে সংঘটিত দু-টি বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা মানব জাতিকে করেছে স্তম্ভিত আর মানবতাকে করেছে কলঙ্কিত। পারমাণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপকতা সম্পর্কে মানুষ প্রথম ধারণা লাভ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট। এরই ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যে ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হয় তার প্রেক্ষিতে পৃথিবী শান্তিসাম্য তথা Balance of Power নীতিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। 

একদিকে সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসমূহ, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহের জোট। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সে সময়ে পরমাণু বোমার আতঙ্ক ছিল সবচেয়ে বেশি। অস্ত্র প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির ফলে এ সময় বিভিন্ন দেশের মধ্যে সন্দেহ, ভয় ও উত্তেজনা বাড়তে থাকে। তাছাড়া অস্ত্র প্রতিযোগিতার ফলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সামরিক ব্যয় বেড়ে যায়। 

এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিশেষভাবে ব্যাহত হয়। তা ছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত পারমাণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপকতা সকলের মনে প্রচণ্ড ভীতির জন্ম দেয়। এসব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পারমাণবিক মারণাস্ত্রের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য নিরস্ত্রীকরণ অত্যাবশ্যক হয়ে দেখা দেয়।

নিরস্ত্রীকরণ কী :

সাধারণভাবে নিরস্ত্রীকরণ বলতে অস্ত্র হ্রাস বা বিলোপ করাকে বুঝায়। অর্থাৎ নিরস্ত্রীকরণ বলতে বুঝায় মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতা বন্ধ করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট ধরনের বা সকল ধরনের অস্ত্র হ্রাস করা, উৎপাদিত অস্ত্র ধ্বংস করা বা উৎপাদন বন্ধ করা। আক্ষরিক অর্থে নিরস্ত্রীকরণ হলো বলপ্রয়োগ অথবা সশস্ত্র সংঘর্ষের উদ্দেশ্যে যেসব যন্ত্রপাতি বা উপকরণ ব্যবহৃত হয় সেগুলোকে হ্রাস করা অথবা বর্জন করা।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিরস্ত্রীকরণের মূল অর্থ একটু ব্যাপক করা হয়েছে।  যেমন, কোনো রাষ্ট্র যদি স্বেচ্ছায় অস্ত্রের উৎপাদন হ্রাস করে তাকেও নিরস্ত্রীকরণ বলা যায়। দুই বা ততোধিক রাষ্ট্র নিজেদের মধ্যে স্বেচ্ছায় চুক্তি সম্পাদন করে অস্ত্রের উৎপাদন হ্রাস অথবা বর্জন করাকে নিরস্ত্রীকরণ বলে।

Prof Sharp and Kirk বলেন, "Disarmament is the reduction or elimination of certain of all armament to end armament race".

নিরস্ত্রীকরণ কী

আর নিরস্ত্রীকরণ একাধিক পর্যায়ে হতে পারে। এটা হতে পারে একপাক্ষিক বা সম্মিলিত নিরস্ত্রীকরণ। কিংবা হতে পারে স্থানীয় বা সংখ্যাগত বা প্রচলিত অস্ত্রের বা পারমাণবিক অস্ত্রের নিরস্ত্রীকরণ সাধারণ অর্থে নিরস্ত্রীকরণ বলতে, কোনো রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সংখ্যা, অস্ত্রশস্ত্রের পরিমাণ অথবা বিশেষ ধরনের অস্ত্রশস্ত্র বা এদের ব্যবহার হ্রাস, সীমাবদ্ধ নিয়ন্ত্রণ বা বিলুপ্ত করাকে বুঝায়।

নিরস্ত্রীকরণের পটভূমি:

প্রকৃতপক্ষে নিরস্ত্রীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতা বিশ্বনেতৃবৃন্দকে নিরস্ত্রীকরণ বিষয়ে উদ্যোগী হতে প্রেরণা জুগিয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে নিরস্ত্রীকরণের বিষয়টি বাস্তবতা লাভ করলেও এর সূচনা হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে উদারপন্থী মতবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে নিরস্ত্রীকরণ বিষয়ে নতুন করে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বিশ্বনেতৃবৃন্দ বুঝতে পারেন যে, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাষ্ট্রীয় বিরোধ মীমাংসার সাথে নিরস্ত্রীকরণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর তাই গত শতাব্দীতে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আলোচনা এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে নৌ-পরাশক্তিসমুহ নৌ-শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

১৯২১-২২ সময়ে অনুষ্ঠিত ওয়াশিংটন কনফারেন্স এবং ১৯৩০ সালের লন্ডন কনফারেন্স নৌ- শক্তি সীমিতকরণে যথেষ্ট সফলতা লাভ করে। তৎকালীন লিগ অব নেশনসও আন্তর্জাতিক নিরস্ত্রীকরণকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু ১৯৩০-এর দশকে জার্মান, ইতালি ও জাপানিজ সাম্রাজ্যবাদের উত্থান এবং এর থেকে পশ্চিমা উদারপন্থী গণতন্ত্রবাদীদের ভীতির ফলে এ প্রচেষ্টা সাময়িকভাবে ভেস্তে যায়।

নিরস্ত্রীকরণ কী


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আণবিক অস্ত্রের আগমন নিরস্ত্রীকরণের প্রবক্তাদের কার্যক্রমে গতি সঞ্চার করে। অনেক খ্যাতিমান লেখক
, বুদ্ধিজীবী, নীতি প্রণেতা "আণবিক বোমা" নিষিদ্ধকরণের প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানান। পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ তখন একটি নৈতিক আবশ্যকতা হয়ে দেখা দেয়। কারণ এর ফলে মানবজাতির অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন।

রেডিও, টিভি ও সিনেমায় পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের বিষয়টি বিপুল প্রচার লাভ করে। এতে নিরস্ত্রীকরণ আন্দোলন সারা বিশ্বের সমর্থন লাভ করে। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন বৃহৎ শক্তিসমূহের নেতৃবৃন্দ অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করেন। স্নায়ুযুদ্ধের অবসান তথা পরাশক্তিসমূহের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিদ্যমান টেনশন প্রশমনে নিরস্ত্রীকরণের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য বলে অনেকে মনে করেন। এ সময় সবচেয়ে বেশি নিরস্ত্রীকরণ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় ও একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

. Strategic Arms Limitation Talks-1 (১৯৭২), (SALT-1)

. Non-Proliferation Treaty (১৯৬৮), (NPT)

. Strategic Arms Reduction Treaty (START) (১৯৯১) ও

৪. Strategic Arms Reduction Treaty (START) (২০১০)

নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপসমূহঃ

নিরস্ত্রীকরণ ব্যবস্থাকে জোরদার করার লক্ষ্যে প্রথম উদ্যোগ ঊনবিংশ শতাব্দীতে শুরু হলেও তা কোনো উল্লেখযোগ্য সুফল বয়ে আনতে পারেনি। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেও একাধিক প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল নিরস্ত্রীকরণের জন্য। কিন্তু তাতেও কোনো অগ্রগতি হয়নি।  

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ গঠিত হলে এর সদস্যরাষ্ট্রসমূহের জোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫২ সালে জাতিসংঘ নিরস্ত্রীকরণ কমিশন গঠিত হয়। ১৯৭৯ সাল থেকে জেনেভাভিত্তিক কমিটি নিরস্ত্রীকরণ কমিটি নামে পরিচিতি লাভ করে। জাতিসংঘ ও সরকারসমূহের বিবিধ প্রচেষ্টার ফলে আন্তর্জাতিক অস্ত্র চুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্র নিরোধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এগুলো হলো:

ক. বহুপাক্ষিক পদক্ষেপ:

১. অ্যান্টার্কটিকা চুক্তি:

১৯৫৯ সালে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তিতে অ্যান্টার্কটিকা অঞ্চলে সকল ধরনের সামরিক মহড়া, অস্ত্র পরীক্ষা ও তেজস্ক্রিয়ার অবশেষ রাখা বা স্থানান্তর সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়।

২. পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি:

১৯৬৩ সালে স্বাক্ষরিত এ চুক্তিতে স্থল, মহাশূন্য ও পানির নিচে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে এতে ভূ-গর্ভে অস্ত্র পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণের কথা বলা হয়নি।

নিরস্ত্রীকরণ কী

৩. মহাশূন্য চুক্তি:

এটি ১৯৬৬ সালে স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তিতে চাঁদসহ পৃথিবীর কক্ষপথে ও মহাশূন্যের অন্যান্য স্থানে পারমাণবিক অস্ত্রসহ অন্যান্য ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র স্থাপন বা বিস্ফোরণ নিষিদ্ধ করা হয়। এতে মহাশূন্যকে সামরিক কাজে ব্যবহার, অথবা মহাশূন্যে পারমাণবিক অস্ত্র স্থাপন এবং মহাশূন্যে অস্ত্র ভাণ্ডার গড়ে তোলাকেও নিষিদ্ধ করা হয়।

৪. পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি:

১৯৬৮ সালে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে পারমাণবিক দেশসমূহ থেকে অপারমাণবিক দেশগুলোতে পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ করা, পারমাণবিক দেশগুলোতে নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া শুরু করা এবং বিশ্বের সকল দেশেই পারমাণবিক প্রযুক্তি শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহারের নিশ্চয়তা প্রদান করা। 

প্রাথমিক পর্যায়ে ২৫ বছরের জন্য স্বাক্ষরিত এ চুক্তিতে ৪০টি দেশ স্বাক্ষর করে। ১৯৯৫ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ১৯৯৮ সালে চুক্তিটি অনির্দিষ্টকালের জন্য নবায়ন করা হয়। এতে ১৭৮টি দেশ স্বাক্ষর করে। ভারত, পাকিস্তান, ইসরায়েলসহ বেশ কয়েকটি দেশ এতে স্বাক্ষর করেনি। এ চুক্তিকে সংক্ষেপে NPT চুক্তি বলেও অভিহিত করা হয়। NPT হচ্ছে Nuclear Non-Proliferation Treaty-এর সংক্ষিপ্ত রূপ।

৫. সমুদ্র চুক্তি:

১৯৭১ সালে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে কোনো দেশের ১২ মাইল উপকূলীয় অঞ্চলের বাইরে সমুদ্রপৃষ্ঠ বা তলদেশে পারমাণবিক ও অন্যান্য বিধ্বংসী মরণাস্ত্র মোতায়েন বা এ ধরনের অস্ত্রের জন্য সুবিধা প্রদান নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

৬. পরিবেশ চুক্তি:

১৯৭৭ সালে স্বাক্ষরিত এ চুক্তিতে যেসব সামরিক প্রযুক্তি ব্যবহারে পরিবেশের ব্যাপক, স্থায়ী ও ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে আবহাওয়া ও জলবায়ুর ধরন বদলে যাওয়াসহ ভূমিকম্প ও ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে পারে, সেসব প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত করা হয়েছে।

৭ . রাসায়নিক অস্ত্রসংক্রান্ত চুক্তি:

১৯৯৩ সালে স্বাক্ষরিত এ চুক্তিতে সব ধরনের রাসায়নিক অস্ত্রের উন্নয়ন, উৎপাদন, মজুদ নিষিদ্ধ করে এসব অস্ত্র ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে। ১৯৯২ সালে এ বিষয়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে উক্ত চুক্তি প্রণয়ন করা হয় এবং ১৯৯৩ সালে স্বাক্ষরদানের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। চুক্তিটি ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাস থেকে কার্যকর হয়।

৮. অটোয়া কনভেনশনঃ

১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত এ চুক্তির মাধ্যমে মানববিধ্বংসী স্থলমাইনের ব্যবহার, মজুদ, উৎপাদন ও হস্তান্তর নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ১২৬তম সদস্য হিসেবে এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।

৯. পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিঃ

২০১০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের ৪৭টি দেশ পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ করার জন্য একত্র হয়ে আলোচনা করে।

খ. দ্বিপাক্ষিক পদক্ষেপসমূহ

নিরস্ত্রীকরণ কী

১. SALT-1 (Strategic Arms Limitation Treaty): 

১৯৭২ সালের ২৭ মে যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশের মধ্যে স্থায়ীভাবে 'Anti-Ballistic Missile' তৈরি ও পাঁচ বছরের জন্য আক্রমণাত্মক অস্ত্র তৈরি বন্ধ করা হয়।

২. SALT-2: 

১৯৭৯ সালের ১৮ জুন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে আক্রমণাত্মক অস্ত্র ২৪০০-এর মধ্যে এবং আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের (আইবিএম) সংখ্যা ২২৫০-এর মধ্যে সীমিত রাখতে দুই পক্ষ সম্মত হয়।

৩. START-1 (Strategic Arms Reduction Treaty): 

এটিও যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির মূল বিষয় ছিল ২০০১ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয় দেশের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা ১৬০০-এর মধ্যে এবং পারমাণবিক ওয়‍্যারহেডের সংখ্যা ৬০০০-এর মধ্যে কমিয়ে আনা এবং ১৯৯১ সালে অস্ত্রের যে মজুদ ছিল তা ৩০ শতাংশ হ্রাস করা।

৪. START-2 চুক্তি: 

১৯৯৩ সালে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি মোতাবেক ২০০৩ সালের মধ্যে পারমাণবিক ওয়‍্যারহেডের সংখ্যা ৩৫০০-এ কমিয়ে আনার ব্যাপারে উভয় দেশ একমত হয়।

৫. START-3 চুক্তি: 

১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত এ চুক্তিতে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র এ মর্মে একমত হয় যে, স্টার্ট-২ চুক্তি বাস্তবায়িত হলেই উভয় দেশ পারমাণবিক অস্ত্র আরো হ্রাস করার ব্যাপারে আলোচনা শুরু করবে।

৬. START-4 চুক্তিঃ 

২০১০ সালে মে মাসে চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মধ্যে এই স্ট্যাট-৪ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যার লক্ষ্য হলো উভয় দেশের পারমাণবিক অস্ত্র উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা হয়।

নিরস্ত্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা:

নিরস্ত্রীকরণের প্রয়োজনীয়তাসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তাঃ

বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার জন্য নিরস্ত্রীকরণ অত্যাবশ্যক। অতীত ইতিহাস থেকে দেখা যায়, মারণাস্ত্রের বিপুল সম্ভারই প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ সকল বড় বড় যুদ্ধের কারণ। তাই নিরস্ত্রীকরণ তথা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে পৃথিবীতে যুদ্ধসহ গোলযোগ হ্রাস পাবে এবং বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরে আসবে।

২. অর্থনৈতিক উন্নয়ন:

বৃহৎ পরাশক্তিসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশ তাদের বাজেটের একটা বিরাট অংশ অস্ত্র তৈরি ও সংগ্রহ এবং সামরিক শক্তি বৃদ্ধির কাজে ব্যয় করছে। ফলে অনেক উন্নয়ন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে। যেমন- ভারত ও পাকিস্তান প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ সামরিক খাতে ব্যয় করার কারণে অনেক জনকল্যাণমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। আবার দেখা যায়, পরাশক্তিসমূহ সামরিক খাতে যে বিশাল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে, তার একটা নির্দিষ্ট অংশ কমিয়ে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোকে দিলে তাদের দারিদ্র্যের অনেকটা লাঘব হতো। তাই সামরিক বাজেট হ্রাস করে দরিদ্র দেশগুলোকে সাহায্য প্রদান ও তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নিরস্ত্রীকরণ প্রয়োজন।

নিরস্ত্রীকরণ কী

৩. যুদ্ধের সম্ভাবনা হ্রাস করাঃ

নতুন নতুন মরণাস্ত্রের উদ্ভাবন ও এর মজুদ গড়ে তোলার ফলে বিশ্বে সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়, যার পরিণতি হচ্ছে যুদ্ধবিগ্রহ। নিরস্ত্রীকরণ যুদ্ধের ও আন্তর্জাতিক উত্তেজনা সম্পূর্ণ প্রতিহত করতে না পারলেও এটি যুদ্ধের সম্ভাবনাকে যথেষ্ট হ্রাস করতে সক্ষম।

৪. যুদ্ধের ভয়াবহতা হ্রাস:

নিরস্ত্রীকরণের মাধ্যমে আণবিক ও পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা বিপুল পরিমাণ হ্রাস করা বা কমিয়ে আনার মাধ্যমে যুদ্ধের ভয়াবহতা হ্রাস করা যায়। কারণ কোনো পরাশক্তির কাছে যদি এসব মরণাস্ত্র না থাকে, তাহলে তাদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হলেও এসব মারাত্মক অস্ত্র ব্যবহৃত হবে না। ফলে ক্ষয়ক্ষতি বহুলাংশে হ্রাস পাবে। অন্যদিকে বর্তমান অবস্থায় যুদ্ধ শুরু হলে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারে সম্পূর্ণ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে।

৫. জনস্বাস্থ্য রক্ষা:

পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে যে তেজস্ক্রিয়া নিঃসৃত হয়, তার ফলে পরিবেশ দূষিত হওয়াসহ জনস্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন হয়। ১৯৮৬ সালের চেরনোবিল দুর্ঘটনার খেসারত আজও সে অঞ্চলের জনগণকে দিতে হচ্ছে এবং আরো কত দিন ধরে দিতে হবে, তা কেউই বলতে পারে না। হিরোশিমা ও নাগাসাকির জনগণ পারমাণবিক অস্ত্রের বিধ্বংসী ক্ষমতার জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে রয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কুফল অত্যন্ত ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী। তাই দেখা যাচ্ছে, জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্যও নিরস্ত্রীকরণ অপরিহার্য।

নিরস্ত্রীকরণ সফলতার পথে অন্তরায়:

নিরস্ত্রীকরণ কী

বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার জন্য নিরস্ত্রীকরণ অপরিহার্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। এগুলো হলো:

১. জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে বিভিন্ন দেশ অস্ত্র উৎপাদন করে থাকে। যারা শান্তির নীতিতে বিশ্বাসী তারাও দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা বোধ করে। তাই কোনো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও ন্যায্য জাতীয় স্বার্থ কার্যকর করার জন্য যদি সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য প্রতিশ্রুতি না দেয়া যায়, তবে কোনো রাষ্ট্রই নিরস্ত্রীকরণের কর্মসূচি গ্রহণে আগ্রহী হবে না।

২. বিশ্বরাজনীতিতে নিজ নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন মরণাস্ত্রের সম্ভার। তাই আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লিপ্সা নিরস্ত্রীকরণের পথে একটি বিরাট বাধা।

৩. নিরস্ত্রীকরণ কার্যকরী হলে উন্নত দেশগুলোর অনেক সামরিক শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে এবং বেকার সমস্যা বেড়ে যাবে। এটিও নিরস্ত্রীকরণের একটি সমস্যা।

৪. নিরস্ত্রীকরণ উন্নত দেশগুলোর অস্ত্র রপ্তানি বাণিজ্যের পথে অন্তরায়। ফলে তারা এর পক্ষে নয়।

৫. প্রতিটি দেশ ন্যূনতম কী পরিমাণ অস্ত্র মজুদ রাখতে পারবে তা স্থির করা এবং সে বিষয়ে ঐকমত্যে পৌছানো অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। কারণ এসব আলোচনায় পরাশক্তির প্রাধান্যই বজায় থাকে, যা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য রাষ্ট্র মেনে নিতে রাজি হয় না। ফলে নিরস্ত্রীকরণ বাধাগ্রস্ত হয়।

৬. বিভিন্ন দেশের অস্ত্রের ধরন ও প্রকৃতি, কার্যক্ষমতা, সংখ্যা প্রভৃতিতে অনেক পার্থক্য রয়েছে। তা ছাড়া সামরিক বাহিনীর আকার, প্রশিক্ষণ পদ্ধতি, দেশের সীমানা সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় সৈন্য সংখ্যা ইত্যাদিতেও পার্থক্য দেখা যায়। এমতাবস্থায় নিরস্ত্রীকরণের হার নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, যা নিরস্ত্রীকরণের পথে অন্তরায়।

৭. নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি কার্যকর করাও একটি বিরাট সমস্যা। কারণ একটি দেশ নিরস্ত্রীকরণ প্রস্তাব মেনে নেয়ার পর তা কার্যকরকরণের চেষ্টা করছে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। এ অবিশ্বাসের ফলে নিরস্ত্রীকরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

৮. আধুনিক মারণাস্ত্রের উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যা গুণগত নিরস্ত্রীকরণকে অসম্ভব করে তুলেছে। বৃহৎ শক্তিসমূহ এখন অস্ত্র মজুদ করার চেয়ে নিত্যনতুন মরণাস্ত্র তৈরির দিকেই ঝুঁকে পড়েছে। যাতে তারা প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে অধিক সুবিধা লাভ করতে পারে।  তাই এখন অস্ত্র প্রতিযোগিতা চলে পরীক্ষাগারে, মাঠে নয়। ফলে প্রকৃত নিরস্ত্রীকরণ এখন অবাস্তব কল্পনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নিরস্ত্রীকরণ কী

৯. নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষরের পরও অনেকে সেটা গোপনে লংঘন করছে। এ গোপন অস্ত্র তৈরি ও মজুদ প্রতিহত করার কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে ইন্সপেকশন ও ভেরিফিকেশন-এর আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। কিন্তু কোনো রাষ্ট্রই অন্যের তত্ত্বাবধান মেনে নিতে রাজি নয়, যা নিরস্ত্রীকরণের একটি বড় সমস্যা। 

১০. বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপস্থিতি নিরস্ত্রীকরণের পথে অন্তরায়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যত দিন থাকবে, নিরস্ত্রীকরণের পথে সমস্যাও তত দিন থেকে যাবে।

১১. নিরস্ত্রীকরণের একটি প্রধান বাধা হলো আন্তর্জাতিক বিরোধ। কারণ এতে পরাশক্তিগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে।

১২. আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের ইচ্ছাও নিরস্ত্রীকরণের পথে অন্তরায়। যেমন- দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ভারত ও পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা এতদঞ্চলে নিরস্ত্রীকরণের প্রধান অন্তরায়।

উপসংহার:

নিরস্ত্রীকরণ বিশ্বশান্তির জন্য অপরিহার্য। পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহ বিধ্বংসী ক্ষমতায় বিশ্ববাসী আজ আতংকিত। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে অন্ধ অস্ত্র প্রতিযোগিতার ফলে মানবজাতির এক বিরাট অংশ আজ মানবেতর জীবন যাপন করছে। অথচ অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয়িত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের একটা অংশ বিশ্বের ক্ষুধার্ত ও নিপীড়িত এক বিরাট জনগোষ্ঠীর মুখে জোগাতে পারে অন্ন। তাই তো বিশ্বের মানুষ আজ অনেক সচেতন। তারা এগিয়ে আসছে এ অসীম অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে।

আশার কথা, বিশ্বের পারমাণবিক শক্তির অধিকারী দেশসমূহ এখন এগিয়ে আসছে বিশ্বে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে। তবে কাগজে-কলমে এসব উদ্যোগ লক্ষ করা গেলেও বাস্তবে সে রকম উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যা হোক, বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নিরস্ত্রীকরণের জন্য আরো কার্যকর ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে কোনো দেশের হাতেই পারমাণবিক অস্ত্র না থাকে। আর সে ক্ষেত্রে বিশ্বের পাঁচটি বৃহৎ শক্তিকেই সবচেয়ে জোরালো ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post