আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সীমান্ত ঘেষা রাষ্ট্র সমূহের ভৌগলিক অবস্থান বিশেষভাবে
গুরুত্বপূর্ণ। ভৌগলিক অবস্থান একদিকে যেমন কোন রাষ্ট্রের শক্তিমত্তার মূল উৎস হয়ে
উঠতে পারে, অন্যদিকে আবার কোন রাষ্ট্রের চিরন্তন
দুর্বলতার কারণ হয়েও দাঁড়াতে পারে। যেমন সম্প্রতি ভারতের দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ হয়ে
দাঁড়িয়েছে চিকেন নেক।
Table of Contents
চিকেন নেক কি?
চিকেন
নেক হলো ভারতের একটি সীমান্ত ঘেষা করিডোর যা শিলিগুড়ি করিডোর নামেও পরিচিত। বাংলাদেশের
সীমান্ত ঘেষা ভারতের এই সরু করিডোরটি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে অবস্থিত। চিকেন নেকের দৈর্ঘ্য
৬০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ২২ কিলোমিটার। কিন্তু
কোন কোন স্থানে করিডোরটির প্রস্থ আরো কম। এই অঞ্চলটি ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্য
সমূহ এবং ভারতের মূল ভূখণ্ডের মধ্যে সংযোগ
স্থাপন করে।
চিকেন নেকের মানচিত্র
চিকেন নেকের পূর্বে নেপাল,পশ্চিমে বাংলাদেশ আর মাঝখানে একটি খুব সরু ভারতীয় অংশ যা চিকেন নেক নামে পরিচিত।
এই সংকীর্ণ ভূখণ্ডটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয়রাজ্যসমূহকে(অরুণাচল,আসাম,মনিপুর,মেঘালয়,মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরা) ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত করে।
আবার এই চিকেন চেকের খুব কাছে রয়েছে
চীন ও ভুটান। মানচিত্রে এই ভূখণ্ডটি একটি চিকেনের
ঘাড়ের মত সরু ও দীর্ঘ দেখায় তাই একে চিকেন নেক বা মুরগির গলা বলা হয়।
চিকেন নেকের গুরুত্ব
বিশ্বের
বুকে এই করিডর এমনভাবে স্থাপিত যে এটি একদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ সংযোগ নিশ্চিত করে
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সীমান্তের ঘনিষ্টতা বুঝতে সহায়তা করে।
ভারত রাষ্ট্রের
ভূখণ্ডকে দুটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয় যার একটি হলো মূল ভারতীয় ভূখণ্ড এবং অন্যটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয়
ভারত। শিলিগুড়ি করিডরের মাধ্যমে ভারতের এই
দুটি অংশ পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
অর্থাৎ
যদি শিলিগুড়ি করিডোর না থাকতো সেক্ষেত্রে মূল ভারতীয় ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব
ভারতের কোন স্থল সংযোগ থাকত না। কারণ উত্তর
পূর্ব ভারত পুরোপুরি স্থল বেষ্টিত এর আশেপাশে কোথাও কোন সমুদ্র নেই। ফলে সংযোগের আর কোন পথও নেই। এই উত্তর-পূর্ব অঞ্চলেই ভারতের সেভেন সিস্টারস অবস্থিত।
যার কারণেই অবস্থানগত দিক দিয়ে সেভেন সিস্টারস
ভারতের মূল ভূখণ্ড বা রাজধানী থেকে বিচ্ছিন্ন।
উত্তর-পূর্ব
অঞ্চলের নানাবিধ রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও অন্যান্য উপাদানের কারণে সেভেন সিস্টারস প্রদেশগুলোতে
বিচ্ছিন্নতাবাদ ও নানা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজমান রয়েছে। যার ফলে অঞ্চলটির উপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা ভারতীয়
রাষ্ট্রের জন্য এমনিতে বেশ কঠিন।
আবার এই
অঞ্চলের সীমানা ও মালিকানা পুরোপুরিভাবে সুনির্দিষ্ট নয়। কারণ চীন অরুণাচল প্রদেশের
বৃহদাংশকে দক্ষিণ তিব্বত হিসেবে অভিহিত করে এবং একে চিন নিজ দেশের অন্তর্গত তিব্বত
স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের অংশ হিসেবে দাবি করে। এই করিডোর থেকে চীনের দূরত্ব খুবই কম।
কোন কারনে
শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেক দখল হলে মূল ভারত ভূখণ্ড উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন
হয়ে পড়তে পারে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের
ভৌগলিক অখন্ডতা রক্ষা ও উত্তর-পূর্ব ভারতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য নয়াদিল্লিকে
অঞ্চলটিতে শক্তিশালী সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখতে হয়।
সেই সাথে
অপেক্ষাকৃত পশ্চাদপদ উত্তর-পূর্ব ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার
কর্তৃক গৃহীত ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন করার জন্যও এই অঞ্চলে বিস্তৃত ভারতীয়
অর্থনৈতিক উপস্থিতি স্থাপন করতে হয়।
এদিকে
উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় শহর হল শিলিগুড়ি। উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে দেশের অন্য কোন অংশের যোগাযোগের
ক্ষেত্রে শিলিগুড়ি একটি জংশনের মত কাজ কর। ফলে সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতের কাছে শিলিগুড়ির
অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে।
শিলিগুড়ি
করিডরের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব যথেষ্ট। নেপাল এবং ভুটান বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য অংশের
সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য শিলিগুড়ি করিডরের উপর অনেক বেশি নির্ভর করতে হয়। অর্থাৎ শিলিগুড়ি
করিডর বা চিকেন নেক দেশের দুটি অংশের মধ্যেও সড়ক ও রেল যোগাযোগ বজায়
রাখার জন্য উত্তর পূর্ব এবং বাকি ভারতের মধ্যে
একটি ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে।
নেপাল
ও ভুটানের সাথে ভারতের দৈনন্দিন যোগাযোগ বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য এই চিকেন নেক।
যার ফলে ভারতের জন্য শিলিগুড়ি করিডরের বা
চিকেন নেক করিডর খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ ও চিকেন নেক
এখন প্রশ্ন
জাগতে পারে বাংলাদেশ যেহেতু ভারতের একদমই কোলঘেষা তাই এ অঞ্চল কখনো কোন ভাবে দখল হলে
বাংলাদেশের কোন ক্ষতি হবে কিনা?
বাংলাদেশের
জন্য ভু-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকসহ সর্বদিক থেকে চিকেন নেক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকেন নেক ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর
সাথে বাংলাদেশের সহজ ও দ্রুত সংযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা শক্তিশালী
করতে চিকেন নেকের ভূমিকা ও গুরুত্ব ব্যাপক ও বিস্তৃত।
ভারতের
এই সংকীর্ণ করিডোর চিকেন নেক যদি কোন কারণে বিঘ্নিত হয় তবে তা বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে
ক্ষতিকর হতে পারে। কারণ চিকেন নেকের মাধ্যমে
বাংলাদেশের সাথে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক
এবং কৌশলগত সংযোগ স্থাপন করা হয়।