বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে কী বুঝ? বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায়সমূহ আলোচনা কর।

 

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে কী বুঝ? বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায়সমূহ আলোচনা কর।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে কী বুঝ? বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায়সমূহ আলোচনা কর।

 

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার মাধ্যমে জনগণকে শাসন বিভাগের স্বৈরাচার থেকে রক্ষা করা যায়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্রের সুষ্ঠু প্রয়োগ কল্পনাও করা যায় না।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায়: নিম্নে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায় আলোচনা করা হলো:

 

১. শাসন বিভাগের স্বৈরাচারিতা রোধ: 

রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করার ফলে অনেক সময় স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। আর শাসন বিভাগ যদি স্বৈরাচারী হয় তাহলে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই শাসন বিভাগের স্বৈরাচারিতা রোধ করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করা যায়।


২. স্থায়িত্ব: 

বিচারকদের কার্যকলাপের স্থায়িত্বের ওপর ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিশেষভাবে নির্ভরশীল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচারকরা অক্ষম হয়ে না পড়লে ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত পদে বহাল।


৩. নিরপেক্ষতা: 

বিচারপতিদের কাজের সমালোচনার ওপর বাধানিষেধ আরোপ করা দরকার। বিচারপতিদের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠলে নির্ভিকভাবে দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। "কোনো দেশের সরকারের কৃতিত্ব পরিমাপ করার সর্বোত্তম মাপকাঠি হচ্ছে বিচার বিভাগের দক্ষতা ও যোগ্যতা। নানাবিধ উপায়ে বিচার বিভাগের এই স্বাধীনতা রক্ষা করা যায়।


৪. বিচারকদের পদচ্যুতি: 

বিচারকদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিচার সাধারণত আইসভায় সম্পাদিত করা যায় না। এ ব্যাপারে বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিশংসন পদ্ধতিতে বিচারকের পদচ্যুত করা যায়। মার্কিন কংগ্রেসের জনপ্রতিনিধি সভা অভিযোগ উত্থাপন করে এবং সিনেট অভিযোগের বিচার করে। ব্রিটেনে রাজা বা রানি পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের যৌথ আবেদনের ভিত্তিতে বিচারককে পদচ্যুত করতে পারে।

 

৫. উপযুক্ত বিচারপতি নিয়োগ: 

সুষ্ঠুভাবে বিচারকার্য সম্পাদনের জন্য উপযুক্ত বিচারপতি একান্তভাবে দরকার। অযোগ্য ব্যক্তি রাজনৈতিক কারণে বিচারক হিসেবে নিযুক্ত হলে ন্যায়বিচার পদদলিত হতে বাধ্য। তেমনি বিচারপতিদেরও কোনে। রাজনৈতিক পদে নিযুক্ত করা অনুচিত।


৬. নিয়োগ পদ্ধতি: 

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিচারকদের নিয়োগ পদ্ধতির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বিচারপতিদের সাধারণ তিনটি পদ্ধতিতে নিয়োগ করা যায়-

ক. জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নিবার্চন

খ. আইনসভা কর্তৃক মনোয়ন এবং

গ. শাসন বিভাগ কর্তৃক নিয়োগ। আইনসভার দ্বারাও বিচারপতি নিয়োগ করা যায়। বর্তমানে প্রধান নির্বাহী কর্তৃক বিচারক নিয়োগের পদ্ধতি অনুসৃত হয়ে থাকে। যোগ্যতম বিচারক নিয়োগের এটাই উত্তম পন্থা।


৭. পদোন্নতি: 

যথাসময়ের পদোন্নতি না পেয়ে মানুষ হতাশার শিকার হয় এবং দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রদর্শন করে। বিচারকদের বেলায়ও এটি প্রযোজ্য। সাধারণত জ্যেষ্ঠনীতির ভিত্তিতে পদোন্নতি হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে কর্মদক্ষতা এবং মেধাও পদোন্নতির ভিত্তি হতে পারে।


৮. বেতন কাঠামো : 

স্বল্প, বেতনভোগী বিচারকদের দুর্নীতিপরায়ণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শ্রেষ্ঠ যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে বিচারক পদে আকৃষ্ট করার জন্য বিচারকের বেতন ও ভাতা পর্যান্ত হওয়া প্রয়োজন।


৯. সামাজিক অবস্থান: 

বিচারক নিয়োগের পূর্বে তার পারিবারিক অবস্থান, মর্যাদা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক অবস্থা প্রভৃতি বিষয়েও অবগত হওয়া প্রয়োজন। সামাজিক অবস্থাজনিত কারণের জন্য বিচারপতিদের মূল্যবোধ, মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত হয়ে থাকে।


১০. নাগরিক অধিকার:

 সংরক্ষণ সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই বিচার বিভাগ নাগরিকদের উপযুক্ত অধিকারসমূহ সংরক্ষণ করতে গিয়ে কয়েকটি বিশেষ পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করে। এ পদ্ধতিসমূহ হলো: 

ক. হেবিয়াস কর্পাস (Habeas corpus), 

খ. ম্যানডেমাস (Mandamus), 

গ. সার্টিওয়ারি (Certiorari) এবং 

ঘ. কোয়ারেন্টো (Quowarranto)। 

হেনরি সিজউইক (Henry Sidgwick) এর মতে, "বিচার বিভাগ হলো সেই বিভাগ, যা আইনের ব্যাখ্যা করে এবং আইনের প্রয়োগ করে।"


 ১১. বিচারকদের নিরাপত্তা: 

আলফ্রেড ডেনিং (Alfred Denning) এর মতে, "সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো বিচার বিভাগ, যা জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করে সে উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রকার রিট জারি করে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য বিচারকদের পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অনেক সময় বিচারকগণ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অনেকাংশে কমিয়ে ফেলে।"


১২. লিখিত সংবিধান: 

অধ্যাপক গার্নার (Prof.Garnner) এর মতে, "বিচার বিভাগের অস্তিত্ব ব্যতিরেকে সভ্য রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না।” সংবিধান হলো দেশের সর্বোচ্চ আইন, যার মাধ্যমে দেশের শাসনকার্য পরিচালিত হয়। যদি বিচারকরা লিখিত সংবিধানের ধারা অনুযায়ী রায় দেয় তাহলে জনগণের মধ্যে রায় সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি থাকবে না। তাই লিখিত সংবিধান বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করে।


১৩.বিচারক নির্বাচন পদ্ধতি: 

জনগণের দ্বারা বিচারক নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে বিচারকগণ জনসমর্থন লাভের আশায় সতত জনসাধারণের সন্তুষ্টি বিধানে আত্মনিয়োগ করবেন। বিচারপতি পদে উপযুক্ত ব্যক্তিকে বাছাই করার জন্য প্রয়োজনীয় বিচারবুদ্ধি বা যোগ্যতা জনসাধারণের থাকে না। এই কারণে জনগণের দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগ পদ্ধতি অধ্যাপক লাঙ্কি (Laski) এর মতানুসারে একটি নিকৃষ্ট পদ্ধতি।


উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বিচার বিভাগ আইনকে যেভাবে ব্যাখ্যা করবে, আইন সেভাবেই পরিচালিত হবে এবং প্রয়োগ করা হবে। আইনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বিচারপতিগণের বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে। যাতে আইনের অপব্যবহার রোধ করে সুষ্ঠু প্রয়োগ করা যায়। তবে বিচার বিভাগ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ হওয়ায় একে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করে এর সুষ্ঠু প্রয়োগ ঘটানো সম্ভব নয়। তাই অধ্যাপক লাঙ্কি বলেন, "বিচার ব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা নিরপেক্ষ হতে পারে না।"


Post a Comment

Previous Post Next Post