আধুনিক রাষ্ট্রে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণগুলো আলোচনা কর।

আধুনিক রাষ্ট্রে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণগুলো আলোচনা কর।

 আধুনিক রাষ্ট্রে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণগুলো আলোচনা কর।


অধ্যাপক বার্কার এর মতে, “বিংশ শতাব্দীর অন্যতম দিক হলো শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি।” যেকোনো সরকার ব্যবস্থাই হোক না কেন সব ধরনের সরকার ব্যবস্থায় শাসন বিভাগের ক্ষমতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান যুগে পৃথিবীর প্রত্যেকটি রাষ্ট্রে আইন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে এবং শাসন বিভাগের ক্ষমতা অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে বর্তমানে বিশ্বের সবকিছু খুব ভালোভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

শাসন বিভাগ: 

শাসন বিভাগ সরকারের প্রধান কার্যকরী অঙ্গে পরিণত হয়েছে আধুনিক যুগে। শাসন বিভাগ আইন বিভাগের গৃহীত ও প্রণীত আইন বাস্তবায়ন করে দেশ পরিচালনা করে থাকে। আধুনিক যুগে শাসন বিভাগের প্রাধান্য ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে, আইন বিভাগের প্রাধান্য হ্রাস পাচ্ছে। এ সম্পর্কে K. C. Wheare বলেছেন, "Legislature have declined in certain respect and particularly in powers in relation to the executive." শাসন বিভাগের ক্ষমতা হঠাৎ করে বৃদ্ধি পায়নি। বহুদিনের শাসন ব্যবস্থার জটিলতা ও বিবর্তনের কারণে এর ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

প্রামাণ্য সংজ্ঞা:

আর. এম. ম্যাকাইভার বলেন, "শাসন বিভাগ হলো শাসনব্যবস্থার নীতি ও কার্যক্রম নির্ধারণে নিয়োজিত শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ।”

 অধ্যাপক বার্কার বলেন, "শাসন বিভাগ আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ ব্যতীত সরকারি কাজে নিযুক্ত সব কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত।” 

ডুভারজার বলেছেন, "আইনসভা ও বিচার বিভাগ ব্যতীত সরাসরি কাজে নিয়োজিত সব কর্মকর্তাই শাসন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত।” 

অধ্যাপক ফাইনার এর মতে, “শাসনসংক্রান্ত কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তির সমন্বয়ে শাসন বিভাগ গঠিত।"

 আধুনিক রাষ্ট্রে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণ: 

বর্তমানে প্রত্যেক রাষ্ট্রে শাসন বিভাগের ক্ষমতা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিম্নে এর কারণসমূহ আলোচনা করা হলো:


 ১. জাতীয় সংকট : 

আইনসভা যেকোনো আইনের মূল কাঠামো প্রস্তুত করে এবং পরিপূর্ণতা দানের বিষয়টি শাসন বিভাগের ওপর অর্পণ করে। জাতীয় জীবনের বৃহত্তর স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে আইনসভা কার্যত শাসন এ প্রাধান্যমূলক কার্যকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। কেননা জাতীয় সংকট ও জরুরি মুহূর্তে আইনসভা প্রয়োজনমতো দ্রুত ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত দিতে সক্ষম হয় না। ফলে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।


 ২. সরকারের নেতৃত্বদান : 

জনকল্যাণের জন্য সরকারকে বহুবিধ কার্য করতে হয়। এ কার্য পরিচালনার জন্য যোগ্য নেতৃত্বের সংযো প্রয়োজন। অধ্যাপক কে. সি. তুইয়ার (K. C. Wheare) বলেছেন, "Legislature have declined in certain respect and particularly in powers in relation to the executive." শাসন বিভাগের ক্ষমতা হঠাৎ করে বৃদ্ধ পায়নি। বহুদিনের শাসনব্যবস্থার জটিলতা ও বিবর্তনের কারণে এর ক্ষমতা বেড়েছে।


 ৩. আর্থনৈতিক সংকট: 

রাষ্ট্রের বন্ধুবিধ অর্থনৈতিক সংকট ও সমস্যা মোকাবিলায় শাসন বিভাগ গুরুদায়িত্ব পালন করে থাকে। অ্যালান জার, বল, বিংশ শতke সুসংবদ্ধ রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব এবং শাসন বিভাগের ক্ষমতার পরিধি ও জটিলতা বৃদ্ধির ফলে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে বলে মন্তব্য করা বর্তমানে একরূপ প্রথায় পরিণত হয়েছে।


৪. শাসন বিভাগের সার্বভৌমত্ব : 

শাসন বিভাগের কাজকর্ম সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য আইনসভার হাতে নেই। তাই আইনসভা কার্যকরভাবে শাসন বিভাগের সমালোচনা করতে পারছে না। তাছাড়া মন্ত্রিসভা আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে পারছে না। ফলে শাসন বিভাগের ক্ষমতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।


 ৫. বিবিধ কার্যাবলি: 

কেবিনেট প্রথার উদ্ভবের ফলে যদি আইনসভার কার্যবৃদ্ধি উনবিংশ শতাব্দীর বৈশিষ্ট্য হয়, তাহলে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি বিংশ শতাব্দীর বৈশিষ্ট্য।


৬. গুণগতমান: 

যোগ্য নেতৃত্বই শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে বিবেচিত। আইনসভার সদস্যদের তুলনায় শাসন বিভাগের সদস্যরা অধিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। তাই শাসন বিভাগই উপযুক্ত নেতৃত্বের অধিকারী।


 ৭. আইন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ: 

অনেক সময় আইনসভার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বেও শাসন বিভাগ আইনসভাকে ভেঙে দেয়। শাসন বিভাগের হাতে অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা ও জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা থাকায় আইন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস পায়।


 ৮. আইন বাস্তবায়ন: 

সংসদ সদস্যদের অযোগ্যতা নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। কিন্তু জনগণ কোনো কোনো সময়ে অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ সদস্যদের নির্বাচন করে থাকে। তাদের এ অদক্ষতার কারণে নির্বাহী বিভাগকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। আইনসভা কেবল রাষ্ট্রের প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন করে থাকে। কিন্তু শাসন বিভাগ আইন প্রণয়নে প্রভাব বিস্তারসহ বহুবিধ কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে।


 ৯. শাসন বিভাগ ও জনগণের বন্ধন: 

সরকার ও জনগণের মধ্যে সংলাপন বিভাগ আমাণের বশে সরকার ও জনগণের মধ্যে হামযাপ রোধেনের মাধ্যম কিসেজে নৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপের হাম পেয়েছে।


১০. জনকল্যাণ:  

সমাজকল্যাণমূলক কাজকর্মের বিপুল দায়িত্বের করতে পারে না। তাই বর্তমানে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শাসন বিভাগই ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ফলে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।


১১. জনস্বার্থ রক্ষা করা: 

বর্তমান সময়ে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ও সংগঠন জনগণের স্বার্থ ও সমস্যাবলি সম্পর্কে সরকারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এর ফলে সরকার ও জনগণের মধ্যে সংযোগ সাধনের মাধ্যম হিসেবে আইনসভার ভূমিকা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে এবং শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

 ১২. অর্থসংক্রান্ত কারণ: 

জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারের বিবিধ কাজল পাদনের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। নির্বাহী বিভাগই এ অর্থ সংগ্রহ ও ব্যয় নির্বাহ করে। শাসক প্রধানের অনুমতিতেই আইনসভায় বাজেটে উপস্থাপিত হয়। তবে কর ধার্য ও ব্যয় বরাদ্দের ব্যাপারে আইনসভার অনুমোদন আবশ্যক।


 ১৩. বিচারসংক্রান্ত: 

শাসন বিভাগ কিছু কিছু বিচারকার্য সম্পাদন করে। কর নির্ধারণ, নিয়োগ, পদোন্নতি, পদচ্যুতি প্রভৃতি বিষয়ে আপত্তির নিষ্পত্তি শাসন বিভাগ করে থাকে। শাসন বিভাগের কোনো কর্মচারীর অন্যায় আচরণ কিংবা দুর্নীতির বিচার ও শাস্তি দান, কোনো সরকারি কর্মচারী অন্যায়ভাবে পদচ্যুতি তার বিচার শাসন বিভাগ করে থাকে।


 ১৪. জনমত: 

শাসন বিভাগ জনগণের পক্ষে কাজ করে এবং সাথে সাথে জনমত সৃষ্টি করে। জাতীয় সংকট মোকাবিলা ও জরুরি প্রয়োজনে আইনসভা দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলে শাসন বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পায়।


 ১৫. সংসদ সদস্যদের স্বার্থপরতা: 

আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের জন্য সদস্যদের স্বার্থপরতা কম দায়ী নয়। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে সদস্যরা নিজের সুবিধা সংরক্ষণ ও নিজ নিজ আসন সুরক্ষার জন্যে মন্ত্রীদের মন যোগানোর কাজে অধিক মনোযোগী হন। এর ফলে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।


 ১৬. স্বাধীনতা রক্ষা: 

দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব শাসন বিভাগের ওপর ন্যস্ত। বিদেশি আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য শাসন বিভাগ সামরিক বাহিনী সংগঠন ও পরিচালনা করে। রাষ্ট্রের জনকল্যাণ সুনিশ্চিত করাই শাসন বিভাগের প্রধান কাজ। ফলে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।


১৭. আনুষ্ঠানিক কাজ: 

শাসন বিভাগকে প্রতিকারমূলক ও অনুষ্ঠানসূচক কার্য পালন করতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ও দেশের প্রধান কার্যকরী শাসক হিসেবে সব আনুষ্ঠানিক কার্য সম্পন্ন করে। এসব ক্ষেত্রে শাসন বিভাগ গুরুত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করছে। ফলে দিন দিন এর ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।


উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রগতিশীল বিশ্বে বিরাজমান আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট শাসন বিভাগের ক্ষমতাকে উত্তরোত্তর বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবে এ প্রবণতার জন্য বর্তমান বিশ্বের জটিল পরিস্থিতিই দায়ী। তাছাড়া আইন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাসও শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে গণ্য করা হয়। আর এ কারণেই হ্যান্টিংটন (Huntington) বলেছেন, "The growth of the executive is an unavoidable phenomenon modern welfare states."

Post a Comment

Previous Post Next Post