সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর।

 

সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর।

সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর।

 সংবিধান একটি রাষ্ট্র পরিচালনার পথপ্রদর্শক। সংবিধানে রাষ্ট্রি পরিচালনার মূলনীতি বর্ণিত থাকে। সংবিধান সরকার ও জনগণের মাঝে সেতুবন্ধন। সংবিধান সরকারকে স্বৈরাচারী ভূমিকা থেকে প্রতিহত করে জনগণের কল্যাণে শাসন পরিচালনার দিকে মনোনিবেশ ঘটায়। সংবিধান শুধুমাত্র একটি রাষ্ট্রের পরিচালনায় মূলনীতি নয় এবং সংবিধানের মাধ্যমে শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়।

রাষ্ট্র পরিচালনায় সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হলো:

১. ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি:

 মন্টেছু ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি জারা আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগকে পৃথক করার ব্যবস্থা করেন Checks of balance' নীতি দ্বারা ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর সব সংবিধানে এই ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ প্রতি প্রতিষ্ঠিত যা আইনের প্রাধান্য ও সুশাসন নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

২. জনকল্যাণ: 

জনকল্যাণই যে সরকারের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তা সংবিধানে বর্ণিত থাকে। ফলে সরকারের যাবতীয় কর্মকান্ডে মূল লক্ষা জনকল্যাণ ও জনগণের চাহিদা পূরণ।

৩. সংবিধানের প্রাধান্য: 

সংবিধানের প্রাধান্য


সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন বিচার বিভাগ সংবিধানের ব্যাখ্যাদাতা ও রক্ষক। সংবিধান লঙ্ঘিত হলে বিচার বিভাগ তা প্রতিহত করে সংবিধান বিরোধী কোনো কর্মকান্ডে লিন্ত থাকলে সরকার অবৈধ হয়ে পড়ে। কিন্তু সংবিধান তা প্রতিহত করে। সুতরাং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসনতন্ত্রের প্রাধান্য সর্বত্র স্বীকৃত।

৪. পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ: 

সংবিধানে পররাষ্ট্রনীতি সন্নিবেশিত থাকে। যেমন- বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত আছে, 'Friendship to all, malice to none." অর্থাৎ, সবার সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে শত্রুতা নয়। পররাষ্ট্রনীতি সাধারণত সেই দেশে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে রচিত হয়। এর ফলে গৃহীত পররাষ্ট্রনীতি সেই দেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো প্রতিফলিত করে।

৫. মৌলিক অধিকার সুরক্ষা: 

মৌলিক অধিকার সুরক্ষায় সংবিধানের গুরুত্ব অপরিহার্য। সংবিধানের নির্দিষ্ট ধারায় মৌলিক অধিকারের বর্ণনা দেওয়া থাকে। মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে আদলত 'তা প্রতিহত করে।

৬. গণতন্ত্রের বিকাশ: 

গণতন্ত্রের বিকাশ


গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখার জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সংবিধান একটি সরকারের মেয়াদকে নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে আবন্ধ করে। মেয়াদ শেষ হওয়ার সাথে সাথে সর্বজনীন ভোটের ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য। নির্বচন অনুষ্ঠিত না হলে সরকার জনবিরোধী হয়ে পড়ে। ভোটের সংস্কৃতি বজায় রাখার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ শক্তিশালী হয়, যা গণতন্ত্র বিকাশে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

৭. জাতীয়তাবাদের বিকাশ: 

সংবিধানের মূলনীতিগুলো আসে একটি দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা থেকে। যা একটি দেশের স্বকীয়তাকে ফুটিয়ে তোলে। জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভূমিকা পালন করে।

৮. সুশাসন প্রতিষ্ঠা: 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাকিয়েভেলির মতে, "মানুষ লোভী স্বার্থপর ও হিংসুক। যার জন্য রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এই বিশৃঙ্খলা দমন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সংবিধানের ভূমিকা অপরিহার্য।।

৯. জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন: 

জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন:


জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন সংবিধানে ঘটে। সংবিধান রচিত হয় একটি দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে। যাঁতে জনগণের র প্রতিফলন ঘটে। সংবিধান রাষ্ট্রীয় জীবনের মূল চাবিকাঠি।

১০. জনগণকে রাজনৈতিক শিক্ষাদান: 

একটি দেশের সংবিধান জনগণকে রাজনৈতিক শিক্ষা দান করে। জনগণকে দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত করে।

১১. দেশের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতকরণ: 

এ প্রসঙ্গে লুইস (Lewis) বলেন, "সংবিধান কোনো সমাজে সার্বভৌম ক্ষমতার বিন্যাস ও বণ্টন বা সরকারের রূপ নির্দেশ করে। সংবিধান দ্বারা সার্বভৌম ক্ষমতা উপস্থাপন করা হয়। যা একটি ভূখন্ডকে রাষ্ট্রে পরিণত করে।"

১২. সরকার পরিচালনার মূলনীতি: 

সরকার পরিচালনার মূলনীতি


রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গিলক্রাইস্ট (Gilchrist) এর মতে, লিখিত বা অখিখিত বিধিবিধান আইনের সমষ্টি যা সরকারের সংগঠন, সরকারের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যকার ক্ষমতা বণ্টন এবং উক্ত ক্ষমতা কার্যকর করার সাধারণ নীতিমালা হচ্ছে সংবিধান। সংবিধানে সরকার পরিচালনার মূলনীতি সন্নিবেশিত থাকে। যা সরকার পরিচালনার রূপরেখা। সংবিধান সরকারের কার্যবলি পরিচালনার গাইড লাইন হিসেবে কাজ করে।

১৩. অখন্ড শাসনব্যবস্থা: 

অস্বভতা ও সামগ্রিকতা নিশ্চিত করা হয় সংবিধানের মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে লর্ড ব্রাইস বলেন,"  সংবিধান হলো এমন কতকগুলো আইন ও প্রথার সমষ্টি যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালিত হয়। অথবা, এমন কতিপয় আইনের সমন্বয় ঘটে যাতে সম্প্রদায়কে সংগঠিতভাবে শাসন এবং একত্রীকরণের নীতিমালা এবং নিয়মাবলি সংযোজিত হয়েছে।"

১৪. শাসনব্যবস্থার ভিত্তি: 

অস্টিন রেণি (Austin Ranny) এর মতানুসারে, " লিখিত বা অলিখিত বিধিসম্মত বা বিধিবহির্ভূত সব মৌলিক নিয়মকানুন যা দেশের শাসনব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, তাই হলো সংবিধান। সংবিধান লঙ্ঘিত হলে জনগণ তা প্রতিহত করে। সংবিধানে শাসনব্যবস্থার খুটিনাটি লিপিবন্ধ থাকে বলে তা শাসনব্যবস্থায় পরিপূর্ণতা দান করে।"

১৫. বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ: 

বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ


অধ্যাপক হারম্যান ফাইনার (Herman Finer) সংবিধানের বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা প্রদান করেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, "The system of fundamental political institutions in the constitution." অর্থাৎ, সংবিধান কোনো সমাজের সার্বভৌম ক্ষমতার বিন্যাস ও বণ্টনে সরকারের রূপ নির্দেশ করে। আধুনিক উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে সরকার এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার বিভিন্ন উপাদানকে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপস্থাপন করছে।

১৬. বিপ্লবের সম্ভাবনা হ্রাস: 

সংবিধান বিপ্লবের সম্ভাবনা হ্রাস করে। কেননা এতে জনগণের দাবি পূরণ বা হ্রাস করা হয়। সংবিধান মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা পূরণ করায় জনরোষ থেকে সরকার রক্ষা পায়।

১৭. জাতীয় ঐতিহ্য: 

জাতীয় ঐতিহ্য রক্ষায় সংবিধানের গুরুত্ব অপরিসীম। সংবিধান সেদেশের ঐতিহ্যের ধারক বা বাহক। সংবিধান দ্বারা একটি জাতির স্বকীয়তা ও মর্যাদা প্রস্ফুটিত হয়।

১৮. রাজনৈতিক সংস্কার: 

রাজনৈতিক সংস্কার


সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় রাজনৈতিক সংস্কারের বিজি পদ্ধতি বর্ণিত থাকে। ফলে রাজনৈতিক সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে অনিশ্চয়তা দূর হয়, যা দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সংবিধান ছাড়া আধুনিক জাতি রাষ্ট্র বল্পনা করা যায় না। সংবিধান রাষ্ট্রের শাসন যন্ত্রকে সচল রাখে। সংবিধান সরকার ও জনগণের মাঝে সেতুবন্ধন। তাই সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সংবিধানের প্রতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। অতএব একটি সর্বসম্মত মৌলিক নীতিমালা তথা সংবিধান প্রণয়নের বিকল্প নেই।

Post a Comment

Previous Post Next Post