সামাজিক প্রতিষ্ঠান বলতে কী বুঝ? বাংলাদেশের প্রধান প্রধান সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিবরণ দাও ।
পরিবার থেকে
আরম্ভ করে যেকোনো ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠানই আদর্শ নাগরিক তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন
করে থাকে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই সমাজের সদস্যদের সামাজিকীকরণ ঘটে। ব্যক্তিজীবনের
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সামাজিক প্রতিষ্ঠানই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করে।
সামাজিক প্রতিষ্ঠান :
সামাজিক প্রতিষ্ঠান বলতে সমাজবদ্ধ মানুষের মধ্যে প্রচলিত ধ্যানধারণাকে বোঝায় যা
স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠে এবং নির্ধারিত হয়ে সমাজব্যবস্থায় টিকে থাকে। অন্যকথায়
যা কিছু সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত তাই সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সমাজে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণের
উদ্দেশ্যে এসব রীতি বা প্রথাগুলোর উদ্ভব হয় এবং এগুলো ধীরে ধীরে সুসংবদ্ধ হয়ে সামাজিক
প্রতিষ্ঠানের রূপ ধারণ করে ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা :
ম্যাকাইভার ও পেজ (Maclver &
Page)
বলেন, “সামাজিক প্রতিষ্ঠান
হচ্ছে সেসব প্রচলিত কর্মপদ্ধতি যার মাধ্যমে গোষ্ঠীর কার্যকলাপ সূচিত হয়।”
রস (Ross)-এর মতে, “সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যম
হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠান ।”
হব হাউস (Hobhouse) এর মতে, “সামাজিক প্রতিষ্ঠান হলো সমাজজীবনের
একটি হাতিয়ার।”
সমাজবিজ্ঞানী সামনার (Sumner) ও কেলার (Keller) এর মতে, “সামাজিক প্রতিষ্ঠান হলো এমন একটি সক্রিয়
ব্যবস্থা,
যা সামাজিক লোকরীতি ও লোকাচারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে।”
বাংলাদেশের প্রধান প্রধান সামাজিক প্রতিষ্ঠান
বাংলাদেশে তথা সারাবিশ্বের প্রত্যেকটি সমাজে বিভিন্ন
ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নিম্নে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ
সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১. পরিবার :
বাংলাদেশে
বিদ্যমান সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হলো পরিবার
। এটি হচ্ছে সমাজের আদি, মৌল ও ক্ষুদ্র সামাজিক
প্রতিষ্ঠান । তাই পরিবারকে সমাজজীবনের মূলকেন্দ্র বলা হয়। পরিবারের মধ্যে ব্যক্তি
জন্মগ্রহণ করে এবং এর সদস্যদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। পরিবার সামাজিক
শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া
যাবে না যে পরিবারের সদস্য নয়। মানসিক যন্ত্রণার অবসান, ক্ষুধার উপশম এবং শিশুর শিক্ষা ও লালন-পালনসহ সার্বিক কার্যাবলি
পরিবার হতে সম্পাদিত হয় ।
অন্যান্য
সমাজের ন্যায় বাংলাদেশেও পরিবার গঠনের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে বিবাহ। সমাজবিজ্ঞানীগণ
বিবাহকে একটি সামাজিক প্রথা ও প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন । এটি জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ক্রমবিকাশে এবং
মানবিক পর্যায়ে ঘর বাঁধা, ভালোবাসা, জৈবিক ও ব্যক্তি চাহিদা পূরণ করে। পরিবারের ধারাবাহিকতা রক্ষা
ও অপরাপর দলবদ্ধতার অস্তিত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিবাহের অন্যবদ্য ভূমিকা রয়েছে।
বিবাহ প্রথা সমাজকে সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। তাই বাংলাদেশের সমাজে সন্তানসন্ততি
জন্মদান ও পরিবার সৃষ্টির জন্য বিবাহ অপরিহার্য বিবেচিত হয় ।
২. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান :
ধর্ম মানুষকে
করেছে নৈতিক বলে বলিয়ান ও শৃঙ্খলার অনুসারী। বাংলাদেশের সমাজে বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয়
প্রতিষ্ঠান রয়েছে । এখানে বিদ্যমান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা প্রভৃতি। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই এখানকার মানুষ
ধর্মীয় শিক্ষালাভ করে থাকে। ধর্ম একটি মৌল ও সর্বজনীন সামাজিক প্রতিষ্ঠান । ধর্মীয়
প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষ ঐক্য, সংহতি, শৃঙ্খলাসহ যাবতীয় শিক্ষাগ্রহণ করে থাকে । তাই সামাজিক প্রতিষ্ঠান
হিসেবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেরও গুরুত্ব অপরিসীম ।
৩. সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান :
বাংলাদেশের
সমাজে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে থিয়েটার, সংগীত স্কুল, নাচের স্কুল, ক্লাব অন্যতম। মানুষ
তার গতিবিধিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অনেক ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। সাংস্কৃতিক
প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষ সমাজজীবনের ঐক্য ও মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন হয়। ফলে মানুষের
মানসিক,
নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটে। মানুষকে সংস্কৃতিমনা করে গড়ে
তুলতে এসব প্রতিষ্ঠান তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এর ফলে মানুষের মধ্যে সৃজনশীলতার প্রসার ঘটে এবং মানুষ উদার হয়ে থাকে ।
৪. অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান :
সমাজের অর্থনৈতিক
কার্যপ্রণালির সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানকে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলে। মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ
চাহিদা হলো অর্থ। মানুষের জীবন ধারণের জন্য খাদ্য, বস্তু, পানীয়, আশ্রয়, নিদ্রা প্রভৃতি প্রয়োজন
পূরণে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সমাজেও বিভিন্ন ধরনের
অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান সামাজিক আচরণ বিধির সুসংহত প্রকাশ
ঘটায়। মানুষ এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দ্রব্য ও সেবা অর্জন করে থাকে। বাংলাদেশের সমাজে
বিদ্যমান অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সম্পত্তি। সম্পত্তি বলতে এমন
বিষয় বা বস্তুকে বোঝায় যার উপযোগিতা রয়েছে এবং যাতে সমাজ কর্তৃক মানুষের অধিকার
স্বীকৃত। পরিবার ও বিবাহের মতো সম্পত্তিও গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য
হয়ে থাকে। মূলত উদ্যান চাষভিত্তিক সমাজ থেকেই মানুষের মধ্যে সম্পত্তি অর্জনের প্রেরণা
জন্মলাভ করে ।
৫. শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান :
শিক্ষা মানুষের
মৌলিক অধিকার। সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান খুবই গুরুত্বপূর্ণ
ও মর্যাদাপূর্ণ। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই শিশু শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান
অর্জন করে থাকে। শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই শিশু সামাজিকীকরণসহ মানবীয় গুণাবলি
অর্জন করে থাকে। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা প্রভৃতি অন্যতম।
৬. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান :
ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, নেতৃত্ব, রাষ্ট্র, সরকার, আমলাতন্ত্র, সুশীলসমাজ ইত্যাদি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের আওতাভুক্ত। বাংলাদেশেও এ ধরনের রাজনৈতিক
প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান। রাজনৈতিক- প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হলো সমাজের সাধারণ প্রশাসন ও
জনশৃঙ্খলার প্রয়োজন পূরণ করা। এর মধ্যে বিভিন্ন উপ-প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার মধ্যে আইনগত
প্রতিষ্ঠান অন্যতম। যেমন : পুলিশ ও সামরিক ব্যবস্থা অন্যতম ।
৭. সেবামূলক প্রতিষ্ঠান :
সেবা মানুষের
জন্য অপরিহার্য মানবিক বিষয় । সেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে আমরা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত
করতে পারি। বাংলাদেশে বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান । অসুস্থ রোগীর চিকিৎসার জ৪ন্য প্রয়োজন চিকিৎসালয় এবং সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি । আর এজন্য
কিছু প্রতিষ্ঠান দরকার হয় । বাংলাদেশে অনেক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেমন : হাসপাতাল, শিশুসদন, মাতৃসদন কেন্দ্র, প্রবীণ নিবাস ইত্যাদি। উন্নত দেশে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা
অধিক। তবে বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশে বর্তমানকালে বহু সেবামূলক প্রতিষ্ঠান
গড়ে উঠছে।
৮. চিত্তবিনোদনমূলক প্রতিষ্ঠান :
মানুষের সুস্থভাবে
বেঁচে থাকার অন্যতম খোরাক হচ্ছে চিত্তবিনোদন। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই মানুষ কাজের
অবসরে আনন্দ লাভ করে থাকে। শিশুপার্ক, ক্রীড়া সংস্থা, সিনেমা হল, খেলাধুলা, রেডিও, টি.ভি, ভিডিও প্রভৃতি বাংলাদেশে
বিদ্যমান চিত্তবিনোদনমূলক প্রতিষ্ঠান, যা সুন্দর ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য
সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের
বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। নিম্নে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বৈশিষ্ট্যসমূহ বিস্তারিত
আলোচনা করা হলো-
১. শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা :
সামাজিক প্রতিষ্ঠানের
প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা নিশ্চিত করা। সমাজের শৃঙ্খলা বজায় রাখার
জন্য সব প্রতিষ্ঠানেই কিছু নিয়মকানুন থাকে। এসব নিয়মকানুন সমাজের সদস্যদের; মেনে চলতে হয়। ফলশ্রুতিতে সমাজে এক প্রকার নিরাপত্তা বজায়
থাকে ।
২. সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন :
মূলত সামাজিক
প্রতিষ্ঠান মানুষের সম্পর্কের পদ্ধতি, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছানোর মাধ্যমে সুসংঘবদ্ধ সামাজিক অভ্যাস ও দলগত কর্মের প্রতিষ্ঠিত
রূপবিশেষ। তাই এগুলোর গুরুত্ব ব্যাপক ।
৩. মানবসৃষ্ট :
সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো
মূলত সমাজের মানুষ দ্বারা সৃষ্ট এবং পরিচালিত। তাই কালের বিবর্তনে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর
উন্নয়ন ঘটে। মানুষের মননশীলতা বা সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে এসব সামাজিক প্রতিষ্ঠানের
উন্নতি হয় ।
৪. সমাজকে সচল করে :
সামাজিক প্রতিষ্ঠান
সমাজকে সচল রাখে । প্রতিষ্ঠানের ওপর ভিত্তি করে সমাজের গতি ও শৃঙ্খলা আসে এবং সমাজের
সার্বিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়। প্রতিষ্ঠান ব্যতিরেকে সমাজ হয়ে পড়ে স্থবির, অস্থিতিশীল ও বিশৃঙ্খল।
৫. মৌল চাহিদা পূরণ :
সমাজের মানুষের
মৌল চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এগুলো সর্বস্তরের
মানুষকে সাহায্য করে থাকে ।
৬ . মিথস্ক্রিয়া
:
পারস্পরিক
সম্পর্কের ভিত্তিতে মিথস্ক্রিয়া সৃষ্টি হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো মিথস্ক্রিয়া দ্বারা প্রভাবিত
হয়। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান নিত্য পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে।
৭. সামাজিক আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ :
সামাজিক প্রতিষ্ঠান সামাজিক আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। আর এক্ষেত্রে
প্রতিষ্ঠানগুলোর তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা অনস্বীকার্য।
৮. সামাজিক নিয়ন্ত্রণ :
সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো
সামাজিক নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক বিচ্যুতি
নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সামাজিক রীতিনীতি টিকিয়ে রাখে। বিভিন্ন ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার
মাধ্যমে সামাজিক গতিশীলতা বজায় রাখে।
৯. লোকাচার ও লোকরীতি কেন্দ্রিকতা :
সামাজিক প্রতিষ্ঠান
মূলত লোকাচার ও লোকরীতি কেন্দ্রিক। প্রতিটি সমাজেই কতিপয় ঐতিহ্যবাহী ও চিরায়ত আচরণবিধির
চর্চা লক্ষ করা যায়। এসব আচরণবিধি ক্রমান্বয়ে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সজ্ঞালিত
হয়। এগুলো লোকায়ত জীবনশৈলী, যা মানুষের কল্যাণে
গড়ে ওঠে।
সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলি
সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলি :সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিভিন্নমুখী কার্যাবলি বিদ্যমান। এ বিষয়ে নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো—
১. সমাজের চালিকাশক্তি :
সমাজ পরিচালনার
চালিকাশক্তি হচ্ছে সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সামাজিক প্রতিষ্ঠান সমাজের নানাবিধ কার্যসম্পাদনের
মাধ্যমে সামাজিক গতি সক্রিয় রাখে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানে ত্রুটি বা সমস্যা দেখা দিলে
সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে সুশৃঙ্খল রাখতে সমাজে বহুবিধ কার্যক্রম
লক্ষ করা যায় ।
২. পারিবারিক শান্তি আনয়ন :
পরিবার হচ্ছে
সমাজের অন্যতম অপরিহার্য অংশ। সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে
পরিবারের মাঝে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। পরিবার জীবনের সুখশান্তি ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক
বিকাশ সাধন করে ব্যক্তিকে দায়িত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল রেখে তার চেতনার সম্প্রসারণ
ঘটায়। আর পারিবারিক শান্তি সমাজে ব্যক্তির বসবাসকে উপভোগ্য করে তোলে ।
৩. প্রথার লালন :
সমাজজীবনে
প্রথার প্রভাব অত্যন্ত বেশি। প্রত্যেক সমাজে কতকগুলো বিশেষ প্রথা রয়েছে। যেমন— মুরব্বিদের
সম্মান প্রদর্শন, ছোটদের স্নেহ করা
ইত্যাদি। সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই সমাজস্থ প্রথার সুষ্ঠু লালন ও সংরক্ষণ সম্ভব
হয়।
৪. প্রথা ও লোকাচার চর্চা :
সুনির্দিষ্ট
প্রথা ও লোকাচার চর্চা প্রতিটি সমাজ ব্যবস্থায় লক্ষ করা যায়। এসব প্রথা ও লোকাচার
সামাজিক শান্তির পক্ষে কাজ করে। এসব সামাজিক প্রতিষ্ঠান অনেকটা প্রথা ও লোকাচারভিত্তিক।
প্রতিটি সমাজের মানুষই সামাজিক' প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে
এসব প্রথা ও লোকাচার পালন করে থাকে । সামাজিক সম্পর্কোন্নয়নে প্রথা ও লোকাচারের অবদান
গুরুত্বপূর্ণ ।
৫. ধর্মীয় রীতি রক্ষা :
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান
সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত। ধর্মীয় বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত হয়ে মানুষ পরমাত্মার
সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করে এবং তারা বিভিন্ন ধর্মীয় আচার আচরণ পালন করে।
সামাজিক প্রতিষ্ঠান ধর্মের ক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বাধীনতা রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন
করে।
৬. সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন :
পারস্পরিক
সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অপরিসীম। ব্যক্তি সম্পর্কের
অভাবে সমাজে দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা, অন্যায়, অত্যাচার প্রভৃতি
ঘটে। সামাজিক প্রতিষ্ঠান তাই পারস্পরিক সম্পর্ককে সুন্দর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করে।
৭. মানুষের আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ :
মানুষের আচার
আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া
সামাজিক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির ধ্বংসাত্মক কার্যাবলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এজন্যই বলা হয়
মানুষের আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত।
৮. সমাজকে সচল করা :
প্রতিষ্ঠান
সমাজকে সক্রিয় করে। প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে সমাজে গতি ও শৃঙ্খলা আসে এবং সমাজের
সার্বিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়। প্রতিষ্ঠান ব্যতিরেকে সমাজ হয়ে পড়ে স্থবির, অস্থিতিশীল ও বিশৃঙ্খল। মূলত সমাজের সার্বিক সক্রিয়তা আনয়নে
প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৯. প্রতীকের প্রকৃত অর্থ নিরূপণ :
সমাজের কতকগুলো
প্রতীকী বিষয় সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থাকে। এসব প্রতীকী বিষয় যেমন বাস্তব
হতে পারে,
তেমনি অবাস্তবও হতে পারে। সামাজিক প্রতিষ্ঠান সমাজের পরিধির
মধ্যে সমাজের প্রতীকী বিষয়ের অর্থ নিরূপণ করে ।
উপর্যুক্ত
আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সমাজজীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মৌল সংগঠন হচ্ছে সামাজিক প্রতিষ্ঠান । সমাজের বিভিন্ন
ধরনের কার্যসম্পাদনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব সামাজিক প্রতিষ্ঠানের
মাধ্যমে সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়। সমাজস্থিত মানুষের কল্যাণেই এর পথচলা।
মানবজীবনকে সার্থক ও সুন্দর করতে প্রতিনিয়ত সামাজিক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কার্যাবলি
সম্পাদন করেছে । যেগুলোর তাৎপর্য মানবজীবনে অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ ।