পরিবার বলতে কী বুঝ? পরিবারের প্রকারভে আলোচনা কর। পরিবারের উৎপত্তি সংক্রান্ত মর্গানের তত্ত্বটির বর্ণনা কর।

 

পরিবার বলতে কী বুঝ

পরিবার বলতে কী বুঝ? পরিবারের প্রকারভে আলোচনা কর।  পরিবারের উৎপত্তি সংক্রান্ত মর্গানের তত্ত্বটির বর্ণনা কর।

পরিবার হলো ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে এমন একটি গোষ্ঠী যার সদস্যরা বিবাহবন্ধন, রক্তের সম্পর্ক বা দত্তকসূত্রে সংঘবদ্ধ হয় এবং পারস্পরিক ক্রিয়া ও আন্তঃযোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে একত্রে বসবাস করে। পরিবার যে ব্যবস্থায় গড়ে উঠুক না কেন তা যেন মানুষের বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে তার জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে সেটাই মুখ্য বিষয়। কোনো পরিবারে পিতা প্রধান আর কোনো পরিবারে মাতা প্রধান; আবার কোনোটাতে পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেশি বা কম । কিন্তু পরিবার ব্যবস্থার গুরুত্বে বিন্দুমাত্র কমতি নেই।

পরিবার : 

সমাজের মৌলিক ও ক্ষুদ্রতম একক হচ্ছে পরিবার। যেসব সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে মানুষের নিবিড় ও অকৃত্রিম সম্পর্ক রয়েছে তার মধ্যে পরিবার অন্যতম। পরিবার হলো একটি ক্ষুদ্র সামাজিক সংগঠন যেখানে বৈবাহিক ও রক্তের সম্পর্কে স্বামী- স্ত্রী ও তাদের সন্তানসন্ততি বাস করে।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা :জিসবার্ট (Gisbert) এর মতে, “পরিবার হচ্ছে একটি জৈব একক, যার সদস্যরা একটি সাধারণ বাসস্থানে একত্রে বাস করে।”নিমকক্ষের (Nimkoff) মতে, “পরিবার হচ্ছে মোটামুটি স্থায়ী এমন একটি সংঘ যেখানে সন্তানাদিসহ বা সন্তানবিহীনভাবে স্বামী-স্ত্রী একত্রে বাস করে।

ইয়ং ও ম্যাক (Young & Mack) এর মতে, “পরিবার হচ্ছে দুই বা ততোধিক মানুষের একটি বর্গ যারা রক্ত, বিবাহ বা পোষ্য গ্রহণের সম্পর্কে সংযুক্ত এবং একত্রে বাস করে।

ম্যাকাইভার ও পেজ (MacIver & Page) এর মতে, “সুনির্দিষ্ট যৌন সম্পর্কের ভিত্তিতে এবং সন্তানসন্ততি জন্মদান ও তাদের লালনপালনের জন্য যথার্থ ও স্থায়ী গোষ্ঠীই হলো পরিবার।' এলিয়ট ও মেরিল (Eliot & Merill) বলেন, “পরিবার হলো স্বামী, স্ত্রী এবং সন্তানসন্ততি দ্বারা গঠিত একটি জৈবিক সামাজিক একক।” ডেভিড পোপেনো (David Popenoe) এর মতে, “পরিবার হলো জ্ঞাতিভিত্তিক গোষ্ঠী, যারা একসাথে বসবাস করে এবং অর্থনৈতিক বা অন্যান্য উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সহযোগিতামূলক একক হিসেবে কাজ করে।”ই. ডব্লিউ, বারজেস ও এইচ. জে. লক (E. W. Burgess & H. J. Locke ) বলেন, “পরিবার হলো ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে এমন একটি গোষ্ঠী যার সদস্যরা বিবাহবন্ধন, রক্তের সম্পর্ক বা দত্তকসূত্রে সংঘবদ্ধ হয় এবং পারস্পরিক ক্রিয়া ও আন্তঃযোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে একত্রে বসবাস করে। "

লুসি মেয়ার (Lucy Maire)-এর মতে, “পরিবার হচ্ছে এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা একটি সমাজের সংস্কৃতির ধারা পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছে দেয়।”

পরিবারের প্রকারভেদ : পরিবারের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে যা প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। পরিবারের প্রকারভেদ নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো—

পরিবারের প্রকারভেদ :


১. ক্ষমতার ভিত্তিতে : ক্ষমতার মাত্রার ভিত্তিতে পরিবার দুই প্রকার। যেমন-

ক. পিতৃপ্রধান পরিবার : 

যে পরিবারের দায়িত্ব একজন পুরুষের ওপর ন্যস্ত থাকে এবং যিনি পরিবারের সব ক্ষমতার মালিক সে ধরনের পরিবারকে পিতৃপ্রধান পরিবার বলে। এ ধরনের পরিবারে কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব পিতা, স্বামী, বয়স্ক পুরুষের ওপর থাকে । এ ধরনের পরিবারের বংশ পরিচয় পুরুষসূত্র দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে ।

 খ. মাতৃপ্রধান পরিবার : 

যে পরিবারের দায়িত্ব একজন নারীর ওপর ন্যস্ত থাকে এবং তিনি পরিবারের সব ক্ষমতার মালিক, সে ধরনের পরিবারকে মাতৃপ্রধান পরিবার বলে ।

২. আকারের ভিত্তিতে : 

পরিবারের আকারের ওপর ভিত্তি করে তিন ধরনের পরিবার দেখা যায় । যথা :

ক. অণুপরিবার : 

স্বামী-স্ত্রী এবং তাদের অবিবাহিত সন্তানসন্ততি নিয়ে গঠিত পরিবারকে অণু পরিবার বলে । অণু পরিবারের লোকসংখ্যা কম থাকে। পশ্চিমা শিল্পোন্নত দেশে সাধারণত অণু পরিবার দেখা যায় । তবে বাংলাদেশে এ ধরনের পরিবারের আধিক্য সাম্প্রতিক কালে দেখা যাচ্ছে।

খ. বর্ধিত পরিবার : 

তিন পুরুষের পরিবারই বর্ধিত পরিবার। এখানে স্বামী-স্ত্রী, সন্তানসন্ততি ও নাতি-নাতনি একত্রে বসবাস করে। এটি মূলত অণু পরিবারের বর্ধিত রূপ।

গ. যৌথ পরিবার : 

যখন কোনো পরিবারের কর্তার সাথে তার বাবা- মা, এক বা একাধিক ভাইবোন ও তাদের সন্তানসন্ততি বা নিকট আত্মীয়স্বজন একত্রে বসবাস করে তখন তাকে যৌথ পরিবার বলে । বর্তমানে যৌথ পরিবারের সংখ্যা ক্রমেই লোপ পেতে বসেছে। সাধারণত গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক সমাজে যৌথ পরিবার অধিক লক্ষ করা যায়।

৩. স্বামী-স্ত্রীর সংখ্যার ভিত্তিতে : 

স্বামী-স্ত্রীর সংখ্যার ভিত্তিতে চার ধরনের পরিবার লক্ষ করা যায়। যথা :

ক. একপত্নী বা একক বিবাহভিত্তিক পরিবার : 

একজন পুরুষের একজন স্ত্রীলোকের সাথে বিবাহের মাধ্যমে যে পরিবার গড়ে ওঠে, তাকে একক বিবাহভিত্তিক পরিবার বা একপত্নী বিবাহভিত্তিক পরিবার বলে ।

 খ. বহুপত্নীক বা বহুস্ত্রী বিবাহভিত্তিক পরিবার : 

যে পরিবারে কোনো পুরুষ একাধিক স্ত্রী নিয়ে বসবাস করে তাকে বহুপত্নী বা বহুস্ত্রী বিবাহভিত্তিক পরিবার বলে । আদিম সমাজে এ ধরনের বিবাহ ছিল।

গ. বহুপতি বা বহু স্বামী বিবাহভিত্তিক পরিবার : 

একজন স্ত্রী একাধিক স্বামী গ্রহণ করে যে পরিবার গঠন করে তাকে বহুপতি বা বহুস্বামী বিবাহভিত্তিক পরিবার বলে ।

ঘ. দলগত বিবাহভিত্তিক পরিবার : 

যখন একদল লোক একদল স্ত্রীকে বিয়ে করে পরিবার গঠন করে তখন তাকে দলগত বিবাহভিত্তিক পরিবার বলে।

৪. বিবাহোত্তর বসবাসের ভিত্তিতে পরিবার : 

বিবাহোত্তর বসবাসের ভিত্তিতে পরিবার ৩ প্রকার। যথা :

ক. পিতৃবাস পরিবার : 

বিবাহ পরবর্তী সময়ে দম্পতি যদি স্বামীর পিতৃগৃহে বসবাস করে তবে তাকে পিতৃবাস পরিবার বলে। অধিকাংশ সমাজেই প্রচলিত রীতি অনুযায়ী স্ত্রীকে স্বামীর পিতার বাড়িতে গিয়ে বসবাস করতে হয়। বাঙালি মুসলিম ও হিন্দু সমাজে এ রীতি প্রচলিত ।

খ. মাতৃবাস পরিবার : 

বিবাহ পরবর্তী সময়ে দম্পতি যদি স্ত্রীর পিতৃগৃহে বসবাস করে তবে তাকে মাতৃবাস পরিবার বলে। গারো উপজাতির মধ্যে এ প্রথা প্রচলিত থাকলেও বাঙালি মুসলিম ও হিন্দু সমাজে বিশেষ ক্ষেত্রে এ ধরনের পরিবার দেখা যায়। বিশেষ করে স্ত্রীর পিতার যদি পুত্র সন্তান না থাকে তখন কন্যাকেই নিজ বাড়িতে রেখে যেতে দেখা যায় ।

গ. নয়াবাস পরিবার : 

বিবাহ পরবর্তী সময়ে দম্পতি যদি স্বামীর পিতা বা স্ত্রীর পিতার গৃহে পরিবার গঠন না করে অন্য কোথাও পরিবার গঠন করে তবে তাকে নয়াবাস পরিবার বলে ।

৫. বংশ মর্যাদা ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে পরিবার : বংশ মর্যাদা ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে পরিবার ২ প্রকার। যথা :

ক. পিতৃসূত্রীয় পরিবার : 

যে পরিবারে নেতৃত্ব, সম্পত্তি, বংশ মর্যাদা, পদবি ইত্যাদি পিতা থেকে পুত্রে বর্তায় তাকে পিতৃসূত্রীয় পরিবার বলে । এখানে দাদা, পিতা, পুত্র, নাতিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাঙালি, চাকমা নৃগোষ্ঠীর মধ্যে এ ধরনের পরিবার দেখা যায় ।

 

খ. মাতৃসূত্রীয় পরিবার : 

যে পরিবারে নেতৃত্ব, সম্পত্তি, বংশমর্যাদা, পদবি ইত্যাদি মাতা হতে কন্যার ওপর বর্তায় তাকে মাতৃসূত্রীয় পরিবার বলে। এখানে নানি, মা, মেয়ে, নাতনিকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়। গারো উপজাতির মধ্যে এ ধরনের পরিবার প্রথা প্রচলিত  নৃবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীর মোট ১৫ শতাংশ পরিবার মাতৃসূত্রীয় ।

 

 উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পরিবার একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠান। পরিবার হচ্ছে দুই বা ততোধিক মানুষকে নিয়ে গঠিত সামাজিক প্রতিষ্ঠান যারা রক্ত, বিবাহ বা পোষ্য গ্রহণের সম্পর্কে সংযুক্ত এবং একত্রে বাস করে। পরিবারের মধ্যেই ব্যক্তিজীবনের সুখশান্তি নিহিত থাকে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবার ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। পরিবারের বিভিন্ন প্রকার সৃষ্টি হচ্ছে। তবে পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত নয় বা ছিল না এমন কোনো ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না।

 

পরিবারের উৎপত্তি সংক্রান্ত মর্গানের তত্ত্বটির বর্ণনা কর।

পরিবারের উৎপত্তি সংক্রান্ত মর্গানের তত্ত্বটির বর্ণনা কর।


পরিবার সমাজের মৌলিক ও প্রাচীন প্রতিষ্ঠান । এটি মানব সমাজ সৃষ্টির উষালগ্ন থেকেই বিদ্যমান। তাই এর সাথে মানুষের গভীর সম্পর্ক ও যোগাযোগ রয়েছে। পরিবারের সাথেই মানুষের আন্তরিক এবং অনেকটা অকৃত্রিম সামাজিক মিথস্ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়। পরিবারের উৎপত্তি সম্পর্কে সুপ্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অনেক তাত্ত্বিক মতবাদ লক্ষ করা যায়। এসব মতবাদের মধ্যে বিবর্তনবাদী মতবাদ গুরুত্বপূর্ণ ।

পরিবারের উৎপত্তি সংক্রান্ত মর্গানের তত্ত্ব : প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী ও বিবর্তনবাদী তাত্ত্বিক লুইস হেনরি মর্গান ১৮৭৭ সালে তার বিখ্যাত 'Ancient Society' গ্রন্থে পরিবারের বিবর্তন ধারাটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন।

পরিবারের উৎপত্তি সংক্রান্ত মর্গানের তত্ত্ব


১. অবাধ যৌনাচার : 

মর্গানের মতে, পরিবারের প্রথম পর্যায় ছিল অবাধ যৌনাচার। ব্যাকোফনকে সমর্থন করে মর্গান বলেন, আদিম সমাজজীবনে অবাধ যৌনাচার প্রচলিত ছিল। তখন যৌন জীবনের ওপর কোনো সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ছিল না। মর্গানের মতে, এটাই ছিল যৌন জীবনের প্রথম স্তর। গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে যৌন জীবন ছিল অনিয়ন্ত্রিত। সেটাই ছিল অবাধ যৌনাচারের যুগ। মর্গান যে অবাধ যৌনাচারের কথা বলেছেন তা ছিল সামাজিক বিবর্তনের প্রাথমিক স্তর ও বন্যদশার নিম্ন পর্যায় অর্থাৎ তা ছিল প্রাগৈতিহাসিক কালের পরিবার।

২. পুনালুয়ান পরিবার : 

এল. এইচ. মর্গানের মতে, আপন রক্ত সম্পর্কের ভাইবোনের মধ্যে বিবাহের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পরিবারকে রক্ত সম্পর্কযুক্ত বা কনস্যাঙ্গুইন পরিবার বলে । তার মতে, এটাই মানবসমাজের প্রথম ও আদি পরিবার, কিন্তু যৌন সম্পর্কের দ্বিতীয় স্তর। কারণ এ পরিবারের আগে অবাধ যৌন সম্পর্ক পর্যায় বিদ্যমান ছিল, তখন অবশ্য কোনো বিবাহ ব্যবস্থা ছিল না ।

 

৩. কনস্যাঙ্গুইন পরিবার : 

কনস্যাঙ্গুইন পরিবার গঠিত হয় আপন জ্ঞাতি সম্পর্কের নিকট ভাইবোনদের মধ্যে বিয়ের ভিত্তিতে। অবাধ যৌন জীবনের স্তর অতিক্রম করে মানবসমাজে প্রথম ধরনের পরিবার হিসেবে কনস্যাঙ্গুইন পরিবারের আবির্ভাব ঘটে। এভাবে যৌনজীবনের ওপর প্রথমবারের মতো কিছুটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।

৪. সিনডিয়াসমিয়ান পরিবার : 

একজন পুরুষ ও একজন মহিলার মধ্যে অস্থায়ী যুগল বন্ধনে এ পরিবার গঠিত হয়। এ পরিবারের স্থায়িত্ব স্বামী-স্ত্রীর খেয়ালখুশির উপরে নির্ভর করতো। সাধারণত একটি সন্তান জন্মের পর পরিবারটি বাতিল হয়ে যেতে। মর্গানের মতে, এটাই হচ্ছে তৃতীয় স্তরের পরিবার এবং চতুর্থ পর্যায়ের যৌনজীবন। আরও উল্লেখ্য, সিনডিয়াসমিয়ান পরিবার যেহেতু এক স্বামী-এক স্ত্রীর পরিবার সেহেতু এটাই আধুনিক একক পরিবারের প্রথম সূচনার ইঙ্গিত প্রদান করে। তবে এটাও বলা দরকার যে, সিনডিয়াসমিয়ান বা যুগল পরিবারে প্রধান স্ত্রী ছাড়াও অন্য রমণীতে যৌনাধিকার স্বীকৃত ছিল ।

৫. পিতৃতান্ত্রিক পরিবার : 

এ পরিবার গড়ে ওঠে একজন পুরুষের সাথে একাধিক স্ত্রীর বিবাহের ভিত্তিতে। এ পরিবারটির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো পরিবারের ক্ষমতা স্বামী, পিতা বা বয়স্ক পুরুষের হাতে বর্তায়। মর্গানের মতে, এটা হচ্ছে চতুর্থ স্তরের পরিবার এবং পঞ্চম পর্যায়ের যৌন জীবন । মর্গান বলেন, কনস্যাঙ্গুইন ও পুনালুয়ান পরিবারের পুরুষের চেয়ে মেয়েদের ক্ষমতাই বেশি স্বীকৃত ছিল । কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে স্ত্রীর স্বাধীনতা নেই বললেই চলে । এ পরিবারের স্থায়ীত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কারণ বর্তমানেও এ ধরনের পরিবারের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায় ।

৬. মনোগামি পরিবার : 

মর্গান বর্ণিত পরিবারের বিবর্তন ধারার এটি হচ্ছে সর্বশেষ পর্যায়। সাধারণত একজন পুরুষের সাথে একজন মহিলার বিবাহের মাধ্যমে এ পরিবার গঠিত হয়। এটি হচ্ছে আধুনিক পরিবারের বর্তমান রূপ এবং সভ্যতার সূচনার অন্যতম লক্ষণ। এ স্তরেই ব্যক্তি মালিকানার উদ্ভব ঘটে। তিনি আরো বলেন, বর্বর যুগের শেষ পর্যায়ে এ ধরনের একক বিবাহভিত্তিক পরিবার স্থায়ী রূপ লাভ করে। এ সময়ে স্ত্রীর সতীত্ব বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। এ কারণে স্ত্রীর জন্য একটি পৃথক আবাস ও পর্দার ব্যবস্থা রাখা হতো। কিন্তু পুরুষরা নিজেদের যৌন স্বাধীনতা ঠিকই বজায় রেখেছিল । এটি পরিবারের বিবর্তনধারার পঞ্চম পর্যায়ের পরিবার এবং স্বাভাবিকভাবেই ষষ্ঠ পর্যায়ের যৌনজীবন ।

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পরিবারের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মর্গানের বিবর্তন তত্ত্ব। মর্গানের ধারণায় এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, পরিবার হলো একটি সক্রিয় ব্যাপার। এটি কখনও অচল নয় । সমাজ যেমন নিম্নতর থেকে উচ্চতর অবস্থায় যায়, তেমনি পরিবার নিম্নতর থেকে উচ্চতর অবস্থায় পৌঁছে। এ কারণে পরিবার অবাধ যৌনজীবন থেকে একক পরিবারের রূপ ধারণ করেছে। তবে পরিবারের বিবর্তন সংক্রান্ত মর্গানের মতবাদকে একসূত্রীয় ব্যাখ্যা বলে গণ্য করা হয়।

 

আধুনিক পরিবারের কার্যাবলি বর্ণনা কর।

আধুনিক পরিবারের কার্যাবলি বর্ণনা কর।


পরিবার একটি তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠান । নিরাপত্তাসহ জীবনের সার্বিক বিকাশ সাধনের একমাত্র আশ্রয়স্থল হলো পরিবার । সৃষ্টির শুরু থেকেই মানব গোষ্ঠী ছোট ছোট পরিবার গঠন করেছে । পরিবারের মধ্যেই মানব শিশুর জন্ম, বৃদ্ধি ও বিকাশ সাধিত হয়। আর এ প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করতে গিয়ে পরিবারকে বিভিন্ন ধরনের কার্যাবলি সম্পাদন করতে হয়। মূলত পরিবারই সব সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মূলকেন্দ্র ।

"আধুনিক পরিবারের কার্যাবলি: পরিবারের কিছু সুনির্দিষ্ট কার্যাবলি রয়েছে। নিম্নে আধুনিক পরিবারের কার্যাবলি আলোচনা করা হলো-

১. জৈবিক কার্যাবলি : 

মানুষের স্বভাবজাত চাহিদা হলো যৌন চাহিদা । সমাজের শৃঙ্খলা ও শালীনতা রক্ষার জন্য নারী-পুরুষের বিবাহের মাধ্যমে পরিবার গঠন ও জৈবিক চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। সিগমন্ড ফ্রয়েডের মতে, পরিবারের জৈবিক কাজ প্রধানত দুই প্রকার । যথা :  স্বামী-স্ত্রীর জৈবিক সম্পর্ক বজায় রাখা এবং ii. সন্তান জন্মদান। সুতরাং বলা যায়, জৈবিক চাহিদা পূরণ পরিবারের মৌলিক কাজ ৷

২. সন্তান লালনপালন : 

পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সন্তান লালনপালন করা। সন্তান জন্মলাভের পর দীর্ঘকাল সে পরনির্ভর ও অসহায় অবস্থায় থাকে। নবজাতক শিশুর লালনপালন এবং ভরণপোষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পরিবারের।

৩. বংশরক্ষা : 

মানুষ পরিবারের মাধ্যমে জৈবিক চাহিদা পূরণ এবং সমাজে তার বংশের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য সন্তান জন্মদান করে। পরিবারের মৌলিক কাজের মধ্যে এটি অন্যতম । মানবসমাজে সন্তান জন্মের স্বীকৃত সংগঠন হলো পরিবার বিবাহ ব্যবস্থার মাধ্যমে সৃষ্ট পরিবারেই স্বামী-স্ত্রীর মিলন ঘটে। এর ফলে নবজাতকের আবির্ভাব ঘটে।

৪. রক্ষণাবেক্ষণমূলক কার্যাবলি : 

মানব শিশু খুবই অসহায়। সে পরিবারের বাইরে অজানা অচেনা মানুষকে দেখে ভয় পেতে পারে, বিষাক্ত কোনো ওষুধ সেবনে হঠাৎ অসুস্থ হতে পারে, অন্ধকার রাতে ভয় পেতে পারে। তাই এ ধরনের বিপদ আপদ থেকে শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান পরিবারের একটি গুরুত্বপুর্ণ কাজ ।

৫. শিক্ষামূলক কার্যাবলি : 

শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড। সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা পরিবারের অন্যতম কাজ। পরিবার প্রতিটি শিশুর উত্তম বিদ্যালয় । প্রতিটি শিশু পরিবার থেকে পারস্পরিক আচরণ, স্নেহ, প্রেম-ভালোবাসা, নম্রতা, ভদ্রতা, দয়ামায়া প্রভৃতি শিক্ষা লাভ করে ।

৬. সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণ : 

সম্পত্তির মালিকানা ও উত্তরাধিকার নির্ধারণের কাজটি পরিবার সম্পাদন করে থাকে। পরিবারভিত্তিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রথা সব সমাজে বিদ্যমান। উত্তরাধিকারসূত্রে পিতামাতার সম্পত্তি তার ছেলে-মেয়েরা পেয়ে থাকে। এছাড়াও বিষয়-সম্পত্তি, নগদ অর্থ ইত্যাদি পারিবারিক সম্পদ বা সম্পত্তি উত্তরাধিকারসূত্রে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয়।

৭. নাগরিকতাবোধ শিক্ষা : 

নাগরিকতাবোধ শিক্ষাদানের প্রধান কেন্দ্র হলো পরিবার । একটি শিশু প্রথমেই তার পরিবারে নাগরিকত্বের ধারণা লাভ করে। স্নেহ, ভালোবাসা, সহযোগিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রভৃতি গুণ শিশু প্রথমে তার পরিবারেই আয়ত্ত করে । এর ফলে সে একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে ।

 

৮. মনস্তাত্ত্বিক কার্যাবলি : 

একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, প্রতিটি পরিবারই মনস্তাত্ত্বিক ভূমিকা পালন করে । এছাড়া ব্যক্তির আবেগীয় চাহিদাগুলো পরিবারই পূরণ করে থাকে ।

৯. সামাজিকীকরণ কার্যাবলি : 

মানব শিশুর জন্য সামাজিকীকরণ অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। পরিবার সন্তানদের সামাজিকীকরণ ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করে থাকে । পরিবার সন্তানসন্ততিদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে শিক্ষা দেয় এবং শিশুকে ভারসাম্যপূর্ণ সামাজিক জীব হিসেবে গড়ে তোলে।

১০. বাসস্থানের ব্যবস্থা : 

বিবাহের মাধ্যমে গঠিত পরিবারে স্ত্রী তাদের সন্তানসন্তুতি নিয়ে একত্রে বসবাসের ব্যবস্থা করে থাকে । এতে তাদের মানসিক পরিতৃপ্তি সাধিত হয়। পরিবারই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে মানুষ স্নেহ ভালোবাসাসহ বসবাসের সুযোগ পায় ।

১১. আর্থিক প্রয়োজন পূরণ : 

সদস্যের অর্থের চাহিদা পূরণ করাও পরিবারের অন্যতম দায়িত্ব পরিবারের সদস্যদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রদান করার ক্ষেত্রে পরিবারের বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে ।

১২. স্বাস্থ্য সুরক্ষা : 

পরিবারের সদস্যগণের কোনো রোগ হলে চিকিৎসাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা পরিবার করে থাকে। অর্থাৎ পরিবারের সুরক্ষার দায়িত্ব পরিবারের।

 

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবারের তাৎপর্য অপরিসীম । পরিবার এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে মানুষ তার প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করে থাকে। মানুষ জন্মগ্রহণের পর থেকে আমৃত্যু পরিবারে যুক্ত থাকে। পরিবারের মাধ্যমে মানুষের সকল চাহিদা পূরণ হয়। মূলত মানুষের মৌলিক প্রয়োজনের তাগিদেই পরিবারের সৃষ্টি । এসব প্রয়োজন পূরণের জন্য পরিবার বিভিন্ন ধরনের কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে। তাই পরিবারের কার্যাবলি ও গুরুত্ব দিন দিন বেড়েই চলছে।

Post a Comment

Previous Post Next Post