মেরি ওলস্টোনক্রাফট কে ছিলেন? সিমোন দ্য বোভোয়ার কে ছিলেন?
নারীদের মুক্তি
তথা অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে যেসব মহিয়সী নারী আগ্রহ দেখিয়েছে এবং যারা নানাভাবে পুরুষতান্ত্রিক
সমাজের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন সমাজের নিকট এদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করে উপস্থাপন করা হয়েছে।
তা সত্ত্বেও অনেক মহীয়সী নারী নারীমুক্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে নারীদের রক্ষার আপ্রাণ
চেষ্টা করেছেন। এদের মধ্যে মেরি ওলস্টোনক্রাফট অন্যতম। তাকে আধুনিক নারীবাদী চিন্তাজগতের
এক অন্যতম পথিকৃৎ বলা হয় ।
মেরি ওলস্টোনক্রাফট
মেরি ওলস্টোনক্রাফটকে নারীবাদের জননী বলা হয়। কেননা নারীবাদকে সর্বপ্রথম একটি মতবাদ হিসেবে উপস্থাপন করার ব্যাপারে যিনি সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন তিনি হলেন ওলস্টোনক্রাফট। তিনি তাঁর নিজ পরিবারের মধ্যেই নারীর প্রতি নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র দেখেছেন । তাঁর মায়ের ওপর তার পিতা নির্যাতন করতেন। এ বিষয়টি তাঁর মনে ভীষণভাবে দাগ কাটে। এ বিষয়টিকে তিনি অতি সহজেই মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি নিজ প্রচেষ্টায় লেখাপড়া শিখে নিজেকে একজন নারীবাদী হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হন ।
তিনি নারীর দুঃখদুর্দশা লাঘবের জন্য নারীদের
ওপর লেখনী ধারণ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি 'ভিন্ডিকেশন অব দি রাইটস অব ওম্যান' (Vindication of the Rights of
Women)
নামে একটি নারীবাদী গ্রন্থ লিখেন। এটি নারীমুক্তির ‘মহা ইস্তেহার' হিসেবে বিশ্বে সর্বাধিক পরিচিত। 'নারী কোনো যৌন জীবন নয়, বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ- নারীকে দিতে হবে স্বাধিকার'। এটি ছিল এ গ্রন্থের মূল বক্তব্য ।
নারীর সপক্ষে মেরি ওলস্টোনক্রাফট অনেক অকাট্য যুক্তি
উপস্থাপন করেছেন । তাঁর মতে, সমাজে নারীকে খণ্ডিত, যুক্তিবর্জিত, বিচারবোধহীন, আবেগপ্রবণ হিসেবে
উপস্থাপন করা হয়েছে। নারী আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে বঞ্চিত হয়ে হীনম্মন্যতায়
ভুগছে। তিনি বলেন, “নিম্নবিত্ত নারী
শৃঙ্খলিত রয়েছে ধর্ম আর সমাজনীতির শেকলে- তারা স্ত্রী এবং মা হিসেবে দক্ষতা দেখাতে
বাধ্য। কিন্তু উচ্চ শ্রেণির নারীদের সব ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাদের বুদ্ধিমত্তা, স্বকীয়তা প্রদর্শনের কোনো পথ খোলা নেই।
যারা সমাজে সবচেয়ে সচেতন তারাই বন্দি এবং নিগ্রহের শিকার।” তিনি আরও বলেন, “যতদিন না নারীকে আপন চেতনায় চেতনালব্ধ যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে দেওয়া হয়, যতদিন না তার বিচার ক্ষমতা গড়ে ওঠে ততদিন মানবসমাজের অগ্রগতির প্রতিবন্ধকতা থেকে যাবে।”
পরিশেষে বলা
যায় যে,
মেরি ওলস্টোনক্রাফট নারীবাদী আন্দোলনে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ
করেন। তাঁর অবদানের কারণে নারীসমাজ অনেকটা অগ্রসর হতে সক্ষম হয়েছে। তিনি তাঁর অসামান্য
অবদানের জন্য যুগে যুগে সবার কাছে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে রয়েছেন।
সিমোন দ্য
বোভোয়ার কে ছিলেন?
আধুনিক নারীবাদী চিন্তাজগতের একজন অন্যতম পথপ্রদর্শক সিমোন দ্য বোভোয়ার। তাকে অস্তিত্ববাদী নারীবাদের প্রধান প্রবন্ধা বলা হয়। নারীদের মুক্তির ব্যাপারে যেসব নারী আন্দোলন করেছে তারা নানাভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের হাতে নিগৃহীত হয়েছে। তা সত্ত্বেও অনেক মহীয়সী নারী নারীমুক্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে নারীদের রক্ষার আপ্রাপ চেষ্টা করেছেন। এদের মধ্যে সিমোন দ্যা বোভোয়ার অন্যতম।
সিমোন দ্য বোভোয়ার :
সিমোন দ্য বোভোয়ার ছিলেন ফরাসি নারীবাদী। নারীবাদী আন্দোলনে সিমোন দ্য বোভোয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন অস্তিত্ববাদী দার্শনিক, সক্রিয় বামপন্থি রাজনৈতিক কর্মী ও সৃষ্টিশীল লেখিকা। তিনি ফরাসি দার্শনিক লেখক জ্যাঁ পল সার্ত্রের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ও সহযোগী ছিলেন। তবে তিনি সার্ত্রের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি। তিনি বিবাহ প্রথার বিরোধিতা করতেন। তিনি 'দ্য সেকেন্ড সেক্স' নামে একটি পুস্তক লিখে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেন ।
নারীর সৃষ্টি রহস্য ও নারীনির্যাতন এ গ্রন্থটির মূল বক্তব্য। এ গ্রন্থে নারীকেন্দ্রিক প্রচলিত মিথ ও বিশ্বাস, নারী বাস্তবতা, আর্থসামাজিক পরিকাঠামো, নারীমুক্তি ইত্যাদি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেন। তিনি নারীকে একটি আলাদা সত্তা হিসেবে বিচার করেছেন। তিনি নারী-পুরুষের কতকগুলো বাস্তব রূপরেখা বর্ণনা করেন। তাঁর মতে, পুরুষ সক্রিয়, নারী লাজুক, পুরুষ কর্মতৎপর, নারী কর্মবিমুখ, জগৎ সম্পর্কে জানাশোনা পুরুষ সমাজ পরিবর্তনে সক্ষম। অপরদিকে, নারী বাইরের জগতে প্রভাব বিস্তার করার গুণ ও ক্ষমতা রাখে না।
তার মতে, পুরুষরা নারীর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য নানা | কাল্পনিক কাহিনি তৈরি করে। তারা নারীকে শক্তিহীন এং বহুরূপী হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা নারীর সন্তান জন্মদান, নারীর দৈহিক দুর্বলতা ও যৌন ভূমিকার কথা বলে তাদেরকে অপর করে দিতে চায়। তিনি আরও বলেন যে, পুরুষ হলো সাবজেক্ট আর নারী হলো অবজেক্ট এবং সাবজেক্ট হিসেবে পুরুষ নারীর ওপর প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা চালায়।
পরিশেষে বলা যায় যে, তিনি নারীকল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিশ্বের অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত নারীসমাজের
জন্য সিমোন দ্য বোভোয়ার ছিলেন একজন প্রতিবাদী মুখ। নারীর অবস্থার সার্বিক উন্নয়নে
তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তার এ চিন্তাধারা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিল। তবে
তিনি নারীমুক্তির অন্যতম দিশারি হিসেবে বিবেচিত।