বাংলাদেশের জনগণের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

 

বাংলাদেশের জনগণের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

বাংলাদেশের জনগণের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের জনগণ নৃতাত্ত্বিকভাবে বিশুদ্ধ নয় । এদেশের মানুষের মধ্যে মোঙ্গলীয় এবং দ্রাবিড় প্রভাব রয়েছে সবচেয়ে বেশি।  নিম্নে বাংলাদেশের জনগণের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো-

১. অবিশুদ্ধ নরগোষ্ঠী:

বাংলাদেশের মানুষ হলো একটি অবিশুদ্ধ নরগোষ্ঠী । বিশিষ্ট নৃবিজ্ঞানী হাবার্ট রিজলে তার Tribes and Castes of Bengal' গ্রন্থে বিভিন্ন আলোচনা ও পর্যালোচনার পর এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, বাংলাদেশের মানুষ কোনো একক নরগোষ্ঠী দ্বারা গঠিত হয়নি; বরং বাঙালি জাতি হলো একটি অবিশুদ্ধ জাতি গোষ্ঠী । 

তার মতে বাঙালি জাতির মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ মোঙ্গলীয় প্রভাব রয়েছে। তিনি এদেশের মানুষের দেহের রং, নাকের গড়ন, মুখে দাড়ি গোঁফের প্রাচুর্য বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে আসেন যে, বাংলার মানুষের মধ্যে দ্রাবিড় ও মোঙ্গলীয়দের প্রভাব সুস্পষ্ট । 

রিজলের মতে, বাংলার মানুষের লম্বা ও গোল মাথার যে বৈশিষ্ট্য তা প্রমাণ করে যে, বাঙালি জাতি হলো দ্রাবিড় প্রভাবিত জাতি। তিনি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, মঙ্গল-দ্রাবিড়দের রক্তের সংমিশ্রণের ফলে বাঙালিদের মাথার আকৃতি এমন হয়েছে। তবে রিজলে বিভিন্ন দৈহিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে মত দেন যে, বাঙালিদের মধ্যে মোঙ্গলীয়দের প্রভাব খুব বেশি নেই।

২. দ্রাবিড়, আদি অস্ট্রেলীয়, মোঙ্গলীয় ও ককেশীয় শ্রেণিভুক্ত নরগোষ্ঠী:

একথা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, বাঙালি জাতি একক কোনো নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য দ্বারা তৈরি হয়নি; বরং বাঙালি জাতি তৈরি হয়েছে দ্রাবিড়, আদি অস্ট্রেলীয়, মোঙ্গলীয় ও ককেশীয়দের সমন্বয়ে । প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী বিরজা শঙ্কর গুহ ভারতীয় উপমহাদেশের জনসমষ্টিকে ৬টি নরগোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছে। তার দেওয়া শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী বাঙালিদেরকে দ্রাবিড়ীয়, আদি অস্ট্রেলীয়, মোঙ্গলীয় ও ককেশীয় এই চার শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়।  

দক্ষিণ ভারতের অধিবাসী ওঁরাওরা প্রধানত দ্রাবিড় শ্রেণিভুক্ত এবং এদের অধিকাংশই বাংলাদেশের সিলেটে বাস করে। আদি অস্ট্রেলীয় বংশোদ্ভূত সাঁওতাল ও খাসিয়াদের বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করতে দেখা যায়। বিশেষ করে বাংলাদেশের সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক খাসিয়ারা বসবাস করে। এছাড়াও কালো থেকে গাঢ় বাদামি রং, ছোট ছোট পশমাকৃতির চুল, পুরু ও উল্টানো ঠোট, মধ্যম আকৃতির মাথাবিশিষ্ট খর্বকায় মানুষদের প্রভাব সুন্দরবন অঞ্চলের জেলেদের মধ্যে দেখা যায় ।

৩. মোঙ্গল ও দ্রাবিড় সংমিশ্রিত নরগোষ্ঠী:

প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী হাবার্ট রিজলের মতে, মোঙ্গলীয় ও দ্রাবিড়ীয়দের মিশ্রণের ফলে বাঙালি জাতির উৎপত্তি হয়েছে। যদিও নৃবিজ্ঞানী গুহ ও চান্দ এ বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। মোঙ্গলীয়দের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে চাকমা, অনেকের ধারণা আরাকানি ও বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক আন্তঃবিবাহের কারণে চাকমাদের উৎপত্তি হয়েছে। রাখাইন মগরা আঠার শতকের শেষভাগে এবং উনিশ শতকের প্রথমভাগে আরাকান হতে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে এসে বসতি স্থাপন করে এবং আস্তে আস্তে বাঙালিরা মিশ্র জাতিতে পরিণত হয় ।

You May also like: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায়সমূহ আলোচনা কর।

৪. মোঙ্গলীয় ও আদি অস্ট্রেলীয় সংমিশ্রিত নরগোষ্ঠী:

বাংলার উত্তরাঞ্চলে বসবাসকারী 'পোলি' নামে পরিচিত সম্প্রদায় প্রধানত মোঙ্গলীয় এবং একই সাথে তাদের মধ্যে কিছুটা অস্ট্রেলীয় প্রভাবও রয়েছে। বাংলায় বসবাসকারী গারো, হাজং, কাচারি ও টিপ উপজাতীয়রাও একই শ্রেণিভুক্ত। তাছাড়া হাজংরা গারোদের একটি শাখা হলেও তাদের মধ্যে কিছুটা অগারো উপাদান রয়েছে।

৫. আলপীয় ও দিনারীয় সংমিশ্রিত নরগোষ্ঠী:

বাংলাদেশের জনগণ আলপীয় ও দিনারীয়দের সংমিশ্রণের ফলে সৃষ্ট একটি সংকর উপজাতি । নৃবিজ্ঞানী বিরজা শঙ্কর গুহ এ সম্পর্কে বলেন, বাঙালিদের গোল মাথা, সরু নাক, মধ্যম মানের উচ্চতা প্রমাণ করে যে, বাঙালিদের মধ্যে অবশ্যই আলপীয় ও দিনারীয়দের প্রভাব রয়েছে। 

নৃবিজ্ঞানী বিরজা শঙ্কর গুহের বিশ্বাস আর্মেনীয়রাই বাংলাদেশে ককেশীয় গোল মাথা শ্রেণির উদ্ভব ঘটিয়েছে।  ইতিহাস থেকে জানা যায়, আর্মেনীয়রা আনুমানিক ৫০০ থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে বাংলাদেশে এসেছিল। এদেশে আর্য জাতির উত্থান হয় খ্রিস্টপূর্ব প্রথম বছরে। 

সে সময়ে উচ্চ শ্রেণির অনার্যরা আর্য জাতির সাথে মিশে যায় এবং নিম্ন শ্রেণির মানুষেরা অনার্য রূপ লাভ করে এবং নিম্ন বর্ণ হিসেবে পরিগণিত হয়। ঠিক একই পদ্ধতিতে আর্যরা আর্মেনীয় আলপীয় জাতির সাথে মিশে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থ জাতি তৈরি করে। নৃবিজ্ঞানীদের মতে, আদি অস্ট্রেলীয় জাতি ককেশীয় গোষ্ঠীর সাথে যথেষ্ট পরিমাণে মিশ্রিত হয়ে সাতশূদ্র নামক দ্বিতীয় স্তরের সম্প্রদায় তৈরি করে।

You May also like: প্রাচীন বাংলার জনপদগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও

৬. গুজরাটীয় সাদৃশ্যপূর্ণ নরগোষ্ঠী:

বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, তাদের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ গুজরাটীয় প্রভাব বিদ্যমান । এ প্রসঙ্গে নৃবিজ্ঞানী রমা প্রসাদ চন্দ্র বলেন, গুজরাটি ও বাঙালিদের পূর্ব পুরুষেরা আর্যদের চাপে গুজরাট, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক ও বাংলায় ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিল।  

কিন্তু অন্যান্য নৃবিজ্ঞানীরা তার মতামত গ্রহণ করতে পারেননি। তাদের অনেকের মতে, বাঙালি ও গুজরাটের পূর্ব পুরুষেরা খাইবার বা গোলান গিরিপথের মধ্য দিয়ে না এসে তারা এদেশে এসেছিল সমুদ্র পথে।  সমুদ্র দিয়ে এসে তারা সমুদ্র তীরেই বসতি স্থাপন করে। এজন্যই সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে তাদের বেশি দেখা যায়। তারা যেভাবেই এদেশে বিস্তার লাভ করুক অথবা যেভাবেই আসুক একথা সত্য যে, বাঙালিদের মধ্যে গুজরাটীয় মানুষের প্রভাব রয়েছে ।

৭. ককেশীয় বংশোদ্ভূত নরগোষ্ঠী:

এগার শতকের পরবর্তী সময়ে মুসলিমরা বাংলা জয় করলে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এবং ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর অঞ্চল থেকে বহুলোক এসে এদেশে বসতি স্থাপন করে। এসমস্ত মানুষের অধিকাংশই ছিল ককেশীয়। এছাড়াও কয়েক শতক ধরে এদেশ তুর্কিদের দ্বারা শাসিত হয়।  সেসময়েও অনেক তুর্কি বিভিন্ন কারণে এদেশে আসে এবং তাদের অনেকেই এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। এভাবে বাংলাদেশ একটি ককেশীয় বংশোদ্ভূত জাতিতে পরিণত হয়।

 

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন সময়ে নানা উদ্দেশ্যে এদেশে নানা নৃগোষ্ঠীর মানুষের আগমন ঘটেছে এবং তাদের প্রভাবেই বর্তমান বাঙালি জাতি গঠিত হয়েছে। নৃবিজ্ঞানীদের সকলেই একথার ওপর একমত হয়েছেন যে, বাঙালি জাতি হলো একটি সংকর জাতি। তবে বাংলাদেশের জনগণের ওপর অস্ট্রেলীয়, মোঙ্গলীয়, ভেড্ডিড, আর্য ও মুসলিম জাতির প্রভাবই বেশি। আর এভাবেই তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান জাতি ।


Post a Comment

Previous Post Next Post