সমালোচনাসহ ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর।

সমালোচনাসহ ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর।

সমালোচনাসহ ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর।

জনসংখ্যা সম্পর্কে যেসব চিন্তাবিদগণ ধারণা প্রদান করেছেন তাদের মধ্যে টমাস ম্যালথাস (Thomas Malthus) অন্যতম । অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ১৭৯৮ সালে তিনি তার জনসংখ্যা বিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থ 'An Essay on The Principles of Population' নামক গ্রন্থে জনসংখ্যা বিষয়ক এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী তত্ত্ব প্রচার করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে প্রকাশিত এই বইটিতে জনসংখ্যার সাথে প্রাপ্ত সম্পদের তুলনা করে জনসংখ্যা ও খাদ্য উৎপাদনের মধ্যে সম্পর্ক সম্বন্ধে যে বক্তব্য প্রদান করেন তাই ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব নামে পরিচিত।

ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব

ম্যালথাস খাদ্যের যোগান এবং ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধির পটভূমিকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যাটি আলোচনা করেছেন। ম্যালথাস মনে করেন আর্থিক সামর্থ্যের চেয়ে জনসংখ্যা বেশি হলে মানুষের উন্নতি ও সুখ হবে না। সীমিত সম্পদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা অর্থনৈতিক (Economical) স্বাচ্ছন্দ্যকে নস্যাৎ করে দেয়। ম্যালথাসের মতে, জনসংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায় এবং খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায় গাণিতিক হারে।

অর্থাৎ জনসংখ্যা বাড়ে ১, ২, ৪, ৮, ১৬, ৩২, ৬৪ জ্যামিতিক (Geometrical progression) হারে এবং খাদ্য উৎপাদন বাড়ে Arithmetical progression বা গাণিতিক হারে। স্বভাবতই জনসংখ্যা খাদ্য উৎপাদন থেকে দ্রুততর গতিতে বৃদ্ধি পায়।


ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের বিশ্লেষণ: ম্যালথাস তার তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উল্লেখ করেন যে, খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সম্পদ কখনোই নিঃশেষ হবে না। কিন্তু ভূমির যোগান সীমাবদ্ধ হওয়ায় খাদ্য উৎপাদন দ্রুত বাড়ানো সম্ভব হয় না। জমিতে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধি কার্যকর হওয়ায় খাদ্যশস্যের উৎপাদন দ্রুত বাড়তে পারে না। এর ফলে এমন এক সময় আসে যখন জনসংখ্যার পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণকে অতিক্রম করে দেশে জনাধিক্য সমস্যা দেখা দেয়। জনসংখ্যা ও খাদ্য উৎপাদনের বিষয়টি নিম্নেক্ত গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমে দেখানো যায় :

ধরি, Y = 2^ একটি Exponential Function এ Function টিতে X কে গাণিতিক চলক খাদ্য এবং Y কে জ্যামিতিক চলক জনসংখ্যা বিবেচনা করলে ম্যালথাসের বক্তব্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। Y = 2^ সূচক ফাংশনের ওপর ভিত্তি করে গাণিতিক চলক (x) অর্থাৎ ম্যালথাসের খাদ্য মানের প্রেক্ষিতে জ্যামিতিক চলক (y) বা জনসংখ্যা মানের একটি ছক টেবিল তৈরি করি।

Explain Malthus' theory of population with criticism.

১ নং চিত্রে ভূমি অক্ষে সময় এবং লম্ব অক্ষে খাদ্য উৎপাদন গাণিতিক হারে প্রকাশ করে P, F রেখা দ্বারা সময়ের সাথে খাদ্য উৎপাদনের আনুপাতিক ও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক দেখানো হয়েছে।

২ নং চিত্রে খাদ্য উৎপাদন ও জনসংখ্যার মধ্যে সম্পর্ক নির্দেশ করে। এক্ষেত্রে খাদ্য উৎপাদন নির্দিষ্ট একক হলেও জনসংখ্যা দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পায়। ফলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি রেখার চেয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির রেখাটি বেশি খাঁড়া হয় ।

জনসংখ্যার প্রতিরোধ ব্যবস্থা 

জনসংখ্যার প্রতিরোধ ব্যবস্থা: ম্যালথাস জনসংখ্যা মোকাবিলা বৃদ্ধির প্রবণতা প্রতিরোধ কল্পে দুধরনের ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন । যথা:

১. প্রাকৃতিক নিরোধ: ম্যালথাস বলেন, এভাবে জনাধিক্য জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেলে দেশে দুর্ভিক্ষ, মহামারি, খাদ্যাভাব, যুদ্ধবিগ্রহ প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। এ সব দুর্যোগের ফলে জনসংখ্যার বর্ধিত অংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে পুনরায় জনসংখ্যা ও খাদ্য উৎপাদনের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি এ ব্যবস্থাকে দুর্দশাজনক বলে অভিহিত করেছেন।

২. প্রতিরোধ ব্যবস্থা: ম্যালথাস প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধকল্পে সক্ষমতা অবলম্বনের ধারণা প্রদান করেছেন। কোনো প্রকার অনিয়ম অনাচার ব্যতিরেকেই বিবাহ থেকে বিরত থাকা, পরিবারের ভরণপোষণ সক্ষম না হওয়া পর্যন্ত বিবাহ থেকে বিরত থাকা, সন্তান উৎপাদনের স্পৃহা নিরোধ প্রভৃতি উপায়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা।

 ম্যালথাসীয় চক্র

ম্যালথাসীয় চক্র: জনসংখ্যা সম্পর্কিত ম্যালথাসের এ তত্ত্বকে চক্রাকারে রেখাচিত্রের সাহায্যেও ব্যাখ্যা করা যায়। তার তত্ত্বের এ চক্রাকারে ব্যাখ্যাকে ম্যালথাসীয় চক্র (Malthusian Cycle) বলা হয়।

সমালোচনাসহ ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর।

চিত্রে খাদ্য ও জনসংখ্যার মধ্যে প্রথমে ভারসাম্য অবস্থা দেখানো হয়েছে কিন্তু জনসংখ্যা সর্বদাই খাদ্য যোগানকে অতিক্রম করে চলে। ফলে দ্রুত জনাধিক্য দেখা দেয়। তখন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক উপায়গুলো কাজ করতে থাকে এবং অতিরিক্ত জনসংখ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে খাদ্য ও জনসংখ্যার মধ্যে ভারসাম্য অবস্থা পুনরায় প্রত্যক্ষণ লক্ষ করে। কিন্তু এটি অস্থায়ী ভারসাম্য মাত্র। 

পুনরায় জনসংখ্যাধিক্য সমস্যা দেখা দেয়। তাই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক উপায়গুলো জনসংখ্যা ও খাদ্যোৎপাদনের মধ্যে স্থায়ী ভারসাম্য প্রতিরক্ষা করতে সক্ষম নয় । তাছাড়া ম্যালথাস প্রাকৃতিক উপায়গুলোকে জনসংখ্যাধিক্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অমানবিক ও হৃদয়বিদারক উপাদান হিসেবে গণ্য করেছেন। এসব প্রাকৃতিক উপায়গুলোর প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করে ম্যালথাস জনসংখ্যাধিক্য সমস্যা সমাধানে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেন ।

ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বটির সমালোচনা:

ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বটি সমসাময়িক যুগে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও পরবর্তীকালে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও জনবিজ্ঞানী কর্তৃক কঠোরভাবে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে ম্যালথাসের তত্ত্বের সমালোচনার কতিপয় দিক নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

১. মিথ্যা ভবিষ্যদ্বাণী: ম্যালথাস জনসংখ্যা সম্পর্কিত যে জ্যামিতিক বৃদ্ধির কথা বলেছেন তা বর্তমানে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ উনিশ শতকের শিল্পবিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের কতিপয় দেশের উৎপাদন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে অতিক্রম করে। তাই পশ্চিম ইউরোপের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাস সম্পর্কে ম্যালথাসের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

২. জমির সীমিত ধারণা ভ্রান্ত: ম্যালথাস জমির যোগান সীমাবদ্ধ বলে যে ধারণা প্রদান করেছেন তা ঠিক নয়। কারণ আধুনিক পরিবহণ ও যোগাযোগের উন্নতির সাথে বাজার সম্প্রসারণ ও উন্নত বিপণন ব্যবস্থার সূচনা হয়। উন্নত বীজ, সার ও ফসল বণ্টনের উন্নত ব্যবস্থা সীমিত জমির বাধাকে কাটিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এ বিষয়টি তিনি চিন্তা করেননি।

 কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বের সমালোচনা 

ম্যালথাসীয় চক্র:

কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বের সমালোচনা: কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বের কাজগুলোর মৌলিক ত্রুটি রয়েছে। এ ত্রুটির কারণে এ তত্ত্বটি নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। নিম্নে তা প্রদত্ত হলো-

১. বাস্তবতাহীন: কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বটি অনেকটা বাস্তবতাহীন একটি তত্ত্ব। কারণ প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রযুক্তি জ্ঞান এবং উৎপাদন পদ্ধতি সর্বদাই পরিবর্তনশীল। সুতরাং তাদেরকে স্থির ধরে নেওয়া যুক্তিনির্ভর নয় ।

২. স্থিতিশীল তত্ত্ব: কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বটি স্থিতিশীল ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ তত্ত্বে প্রাকৃতিক ও মানবীয় সম্পদের পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করা হয়নি। অথচ তাদের মাথাপিছু আয় প্রভাবিত হয়। যদি অর্থনৈতিক পরিবেশের কোনো পরিবর্তন না ঘটে তাহলে কাম্য জনসংখ্যা নির্ধারণ করা যেতে পারে, কিন্তু বাস্তব জীবনে অর্থনৈতিক পরিবেশ কখনোই স্থির বা গতিহীন থাকে না ।

৩. কাম্য জনসংখ্যা নির্ধারণ খুবই জটিল: কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে কোনোরূপ আলোচনা করা হয়নি। তত্ত্বে নির্দিষ্ট সময়ে কাম্য জনসংখ্যা পরিমাপের কথা বলা হয়েছে কিন্তু সময় ও জনসংখ্যা উভয়ই পরিবর্তনশীল । সেই সঙ্গে মজুত মূলধনের পরিবর্তন হয় এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ও মাথাপিছু আয়ের পরিবর্তন হয় । কাজেই সুনির্দিষ্ট কাম্য জনসংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন ।

৪. মৌলিক তথ্যের অভাব: কাম্য জনসংখ্যাতত্ত্বের মৌলিক তথ্যের যথেষ্ট অভাব লক্ষণীয়। কারণ এ তত্ত্বের শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো দেশের জনসংখ্যার সাথে সে দেশের সম্পদের কী সম্পর্ক সে সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। কিন্তু কোনো দেশের জনসংখ্যা হ্রাসবৃদ্ধির কারণ, জন্মহার, মৃত্যুহার প্রভৃতি সম্পর্কে কোনো ধারণা প্রদান করা হয়নি।

৫. ব্যবহারিক গুরুত্ব: কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বটির ব্যবহারিক গুরুত্ব খুবই কম। এটি কল্পনা নির্ভর একটি তত্ত্ব। অধ্যাপক মায়ারজ্যাল যথাথই বলেন, কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বটি বর্তমান জগতের সাথে সম্পর্কবিহীন একটি কল্পনাপ্রসূত ধারণা।

৬. অন্যান্য বিষয় 'অপরিবর্তিত' ধারণাটির সঠিক নয়: কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বে একটি দেশের অভ্যন্তরে প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ, কারিগরি জ্ঞান, উৎপাদন কাঠামো অপরিবর্তিত ধরা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা অসম্ভব। এজন্য কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বটি ভ্রান্ত হিসেবে সমালোচিত হয়েছে।


উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বটি দার্শনিক মহলে দারুণভাবে সমালোচিত হলেও এ তত্ত্বের গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে উন্নত। কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এ তত্ত্বে জনসংখ্যাকে দেশের সামগ্রিক সম্পদের সাথে তুলনা করা হয়েছে। ম্যালথাস জনসংখ্যা তত্ত্বে যে নৈরাশ্যবাদ ব্যক্ত করেছেন তা কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। কাম্য জনসংখ্যা তত্ত্বে আশাবাদ লক্ষ করা যায়।


Post a Comment

Previous Post Next Post