সিরাহ কী? সিরাহ সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর ।

 

সিরাহ কী? সিরাহ সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর ।

সিরাহ কী? সিরাহ সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর ।

মুসলিম ইতিহাস চর্চার উদ্ভব, বিকাশ ও অগ্রগতিতে সিরাহ সাহিত্য একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। মুসলিম ইতিহাস চর্চা আরম্ভই হয়েছে সিরাহ সাহিত্য রচনার মাধ্যমে। সিরাহ বলতে সাধারণত যেকোনো মানুষের জীবনী বুঝালেও মুসলিম ইতিহাসে সিরাহ মানে হলো মহানবি (সা.) এর চরিত ইতিহাস। এ সিরাহ সাহিত্যের উদ্ভব ঘটে শিহাব আল যুহরির হাত ধরে। আর পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করে মুহম্মদ ইবনে ইসহাকের হাতে। সিরাহ সাহিত্যের কতগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে।


 সিরাহ কী : নিম্নে সিরাহ এর পরিচয় তুলে ধরা হলো :

১. আভিধানিক পরিচয়: সিরাহ আরবি শব্দ । এর বাংলা অর্থ হলো জীবনী, চরিত ইতিহাস ও আত্মজীবনী ইত্যাদি ।

২. পারিভাষিক পরিচয়: সাধারণভাবে যেকোনো মানুষের জীবনীকে সিরাহ বলা হয়। কিন্তু মুসলিম ইতিহাস তত্ত্বে বা ইসলামের ইতিহাসে সিরাহ শব্দটি একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখানে সিরাহ বলতে মহানবি (সা.) এর জীবনীকে বুঝানো হয় । সুতরাং বলা যায় যে, সিরাহ হলো হযরত মুহম্মদ (সা.) এর জীবনীভিত্তিক রচনা ।

৩. সিরাহ সাহিত্যের উদ্ভব : নিম্নে সিরাহ সাহিত্যের উদ্ভব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

ক. মহানবি (সা.) এর অবির্ভাব : সিরাহ সাহিত্যের উদ্ভবের পিছনে মূল কারণ হলো মহানবি (সা.) এর আবির্ভাব। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন মহানবি (সা.) এবং ৬১০ খ্রিস্টাব্দে নবুয়ত লাভ করেন। এসব ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে সিরাহ সাহিত্যের উদ্ভব ঘটে ।

খ. পবিত্র কুরআনের অবতরণ : ৬১০ খ্রিস্টাব্দে ৪০ বছর বয়সে মুহম্মদ (সা.) এর ওপর প্রথম কুরআন নাযিল হয় । এটি ২৩ বছর পর্যন্ত চলমান থাকে । মহানবি (সা.) এর ওপর কুরআনের অবতরণের ঘটনা উপস্থাপন করতে গিয়ে সিরাহ এর উদ্ভব হয় ।

 গ. মহানবি (সা.) সামরিক অভিযান : মহানবি (সা.) ২৩ বছরের নবুয়তি জিন্দেগিতে অনেক সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছেন। এসব অভিযানসমূহের সন, তারিখ উল্লেখসহ স্থানের বিবরণ আবশ্যক হয়ে পড়ে। যদিও এগুলো মাগাজি সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু মাগাজি আবার সিরাহর একটি অংশ । এভাবে সিরাহ এর উদ্ভব ঘটে ।

সিরাহ সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য : নিম্নে সিরাহ সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হলো :

১. মহানবি (সা.) এর জীবনী : সিরাহ সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি মহানবি হযরত মুহম্মদ (সা.) এর জীবনী সিরাহ বলতে একমাত্র মহানবি (সা.) এর জীবনীকে বুঝানো হয় ।

২. রাসুলের পূর্বাপর জীবনীর বিবরণ : সিরাহ সাহিত্যের অপর বৈশিষ্ট্য হলো এটি মহানবি (সা.) এর জীবনের পূর্ণাঙ্গ একটি বিবরণ। এখানে মহানবি (সা.) এর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক প্রভৃতির বিষয়ের বিশদ বিবরণ রয়েছে। এটিই সিরাহর অনন্য বৈশিষ্ট্য।

৩. মাক্কি ও মাদানি জীবন : সিরাহতে মহানবি (সা.) এর মাক্কি ও মাদানি জীবনের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ রয়েছে। তাঁর সম্পর্কে জানতে হলে সিরাহ এর কোনো বিকল্প নেই ।

৪. অন্যান্য নবি রাসুলের বিবরণ : সিরাহ বলতে শুধু মহানবি (সা.) এর জীবনীকে বুঝানো হলেও তাঁর জীবনী বর্ণনায় অন্যান্য অনেক নবি রাসুলের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যদিও সেগুলো মুখ্য নয় ।

৫. সিরাহ এর বিভক্তি : বিশ্লেষণ করলে মহানবি (সা.) এর সিরাহ তিনটি পর্বে বা অংশে বিভক্ত। যেমন আল মুবতাদা, আল মাবআস ও আল মাগাজি । এ তিনটি পর্বে মহানবি (সা.) এর পূর্ণাঙ্গ জীবনের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।


উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইতিহাস মানববিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর মুসলিম ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সিরাহ সাহিত্য। প্রাক-ইসলামি আরবে মুসলিম ইতিহাস চর্চা বলতে কিছুই ছিল না। মুসলিম ইতিহাস চর্চার উদ্ভব ঘটে মহানবি (সা.) এর আগমনের পর। আর মুসলিম ইতিহাস চর্চার সূচনা মানেই সিরাহ সাহিত্যের উদ্ভব। কেননা মুসলিম ইতিহাস চর্চা শুরুই হয়েছে মহানবি (সা.) এর জীবনী রচনার মাধ্যমে। আর মহানবি (সা.) এর জীবনীর পারিভাষিক অর্থ হলো সিরাহ। সর্বোপরি বলা যায় যে, মুসলিম ইতিহাস চর্চায় সিরাহ সাহিত্যের অবদান অপরিসীম।

সিরাহ সাহিত্যের উদ্ভবের প্রেক্ষাপট 

সিরাহ সাহিত্যের উদ্ভবের প্রেক্ষাপট : নিম্নে সিরাহ সাহিত্যের উদ্ভবের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

১. মহানবি (সা.) এর আবির্ভাব: সিরাহ সাহিত্যের উদ্ভবের পিছনে মূল কারণ হলো মহানবি (সা.) এর আবির্ভাব। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন মহানবি (সা.) এবং ৬১০ খ্রিস্টাব্দে নবুয়ত লাভ করেন। এসব ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে সিরাহ সাহিত্যের উদ্ভব ঘটে

২. পবিত্র কুরআনের অবতরণ : ৬১০ খ্রিস্টাব্দে ৪০ বছর বয়সে মুহম্মদ (সা.) এর ওপর প্রথম কুরআন নাযিল হয়। এটি ২৩ বছর পর্যন্ত চলমান থাকে। মহানবি (সা.) এর ওপর কুরআন অবতরণের ঘটনা উপস্থাপন করতে গিয়ে সিরাহ এর উদ্ভব হয় ৷

৩. মহানবি (সা.) সামরিক অভিযান : মহানবি (সা.) ২৩ বছরের নবুয়তি জিন্দেগিতে অনেক সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছেন। এসব অভিযানসমূহের সন, তারিখ উল্লেখসহ স্থানের বিবরণ আবশ্যক হয়ে পড়ে। যদিও এগুলো মাগাজি সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত । কিন্তু মাগাজি আবার সিরাহর একটি অংশ । এভাবে সিরাহ এর উদ্ভব ঘটে ।

জীবনী গ্রন্থ হিসেবে সিরাতে রাসুলুল্লাহ এর গুরুত্ব : নিম্নে জীবনী গ্রন্থ হিসেবে সিরাতে রাসুলুল্লাহ এর গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :

১. এক নজরে সিরাতে রাসুলুল্লাহ' :

গ্রন্থের নাম : সিরাতে রাসুলুল্লাহ' । 
লেখক : ইবনে ইসহাক ।
রচনার সময়কাল : ১৩৫ হিজরি।
বিষয়বস্তু : মহানবি (সা.) এর জীবনী ।

ইবনে ইসহাকের পরিচিতি : মুহম্মদ ইবনে ইসহাক ৮৫ হিজরিতে বা ৭০৪ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৫১ হিজরি বা ৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে মৃত্যুবরণ করেন। ছাত্র হিসেবে তিনি অনেক মেধাবী ছিলেন। বাল্যকালে তিনি মাগাজি সম্পর্কে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করেন। মুহম্মদ ইবনে মহানবি (সা.) এর জীবনের ওপর নানাবিধ তথ্য সংগ্রহের পর এটিকে গ্রন্থাকারে রূপদানের চেষ্টা করেন। অবশেষে ১৩৫ হিজরিতে মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক সিরাতে রাসুলুল্লাহ'র রচনা সমাপ্ত করেন।

২. বিষয়বস্তু : সিরাতে রাসুলুল্লাহ'র বিষয়বস্তুর পর্যালোচনায় এ গ্রন্থটিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন

ক. আল মুবতাদা : এখানে সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে মহানবি (সা.) এর শৈশবকাল পর্যন্ত ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। এখানে মহানবি (সা.) এর বংশক্রম আলোচনা করতে গিয়ে সৃষ্টিতত্ত্ব ও বিশ্ব ইতিহাসের প্রধান প্রধান ঘটনাবলি বর্ণনা করেছেন ।

খ. আল মাবআস বা মহানবি (সা.) এর রিসালাতের ইতিহাস : এ অংশে ওহি অবতীর্ণ বা নবুয়ত বা নবুয়ত প্রাপ্তির পর হতে মক্কা জীবনে ইসলাম প্রচার এবং হিজরতের পূর্ব পর্যন্ত ঘটনাবলির বিবরণ রয়েছে।

গ. আল মাগাজি : এ অংশে মহানবি (সা.) এর সামরিক অভিযানসমূহের বিশদ বিবরণ রয়েছে। মহানবি (সা.) এর ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত ঘটনাবলির বিবরণ রয়েছে আল মাগাজি অংশে ।

৩. গুরুত্ব : একটি সিরাহ গ্রন্থ হিসেবে আরব ইতিহাস চর্চার প্রারম্ভিক পর্যায়ে ইবনে ইসহাকের সিরাহর গুরুত্ব অপরিসীম পরবর্তী ঐতিহাসিকগণ মহানবি (সা.) এর সিরাহ চর্চায় এটিকে আকর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর বিশ্বাসযোগ্যতা বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়।

জীবনী গ্রন্থ হিসেবে সিরাতে ইবনে হিশামের গুরুত্ব: 

মহানবি (সা.) এর জীবনী গ্রন্থ হিসেবে সিরাতে ইবনে হিশামের গুরুত্ব নিম্নে আলোচনা করা হলো :

১. মহানবি (সা.) এর জীবনী : সিরাহ সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি মহানবি হযরত মুহম্মদ (সা.) এর জীবনী সিরাহ বলতে একমাত্র মহানবি (সা.) এর জীবনীকে বুঝানো হয় ।

২. রাসুলের পূর্বাপর জীবনীর বিবরণ : সিরাহ সাহিত্যের অপর বৈশিষ্ট্য হলো এটি মহানবি (সা.) এর জীবনের পূর্ণাঙ্গ একটি বিবরণ। এখানে মহানবি (সা.) এর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক প্রভৃতির বিষয়ের বিশদ বিবরণ রয়েছে । এটিই সিরাহর অনন্য বৈশিষ্ট্য ।

৩. মাক্কি ও মাদানি জীবন : সিরাহতে মহানবি (সা.) এর মাক্কি ও মাদানি জীবনের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ রয়েছে। তাঁর সম্পর্কে জানতে হলে সিরাহ এর কোনো বিকল্প নেই ।

৪. অন্যান্য নবি রাসুলের বিবরণ : সিরাহ বলতে শুধু মহানবি (সা.) এর জীবনীকে বুঝানো হলেও তাঁর জীবনী বর্ণনায় অন্যান্য অনেক নবি রাসুলের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যদিও সেগুলো মুখ্য নয় ৷

৫. সিরাহ এর বিভক্তি : বিশ্লেষণ করলে মহানবি (সা.) এর সিরাহ তিনটি পর্বে বা অংশে বিভক্ত। যেমন-আল মুবতাদা, আল মাবআস ও আল মাগাজি ।  এ তিনটি পর্বে মহানবি (সা.) এর পূর্ণাঙ্গ জীবনের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে ।


উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মুহম্মদ ইবনে ইসহাক এবং ইবনে হিশাম সিরাহ চর্চার অগ্রপথিক হিসেবে বিবেচিত। তাদের পূর্বে সিরাহ চর্চার কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না। ইবনে ইসহাকের রচিত সমকক্ষহীন অনন্য গ্রন্থ হলো মহানবি (সা.) এর চরিত ইতিহাস সিরাতে রাসুলুল্লাহ। এ সিরাহ গ্রন্থে অনেক অপ্রয়োজনীয় তথ্য ছিল । যার ফলে এটিকে সংস্কার ও পরিমার্জন করে ইবনে হিশাম এর নামকরণ করেন সিরাহ ইবনে হিশাম'। সর্বোপরি বলা যায় যে, সিরাতে রাসুলুল্লাহ' ও সিরাহ ইবনে হিশাম মহানবি (সা.) এর জীবনী ইতিহাসের দুটি আকর গ্রন্থ ।

 


Post a Comment

Previous Post Next Post