সংস্কৃতি বলতে কী বুঝ? সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য ও উপাদানগুলো বর্ণনা কর।
সংস্কৃতি হলো মানুষের আচরণের সমষ্টি। এটি সামাজিক জীবনবোধ থেকে উদ্ভূত একটি সামাজিক প্রপঞ্চ।মানুষ একত্রে বসবাসের ফলেই সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। সংস্কৃতি প্রাগৈতিহাসিক বা সুদূর অতীত থেকে প্রবহমান, বিভিন্ন সংস্কৃতির মিশ্র রূপ, গ্রামীণ প্রভাবিত, ঐতিহ্যনির্ভর, লোকসংস্কৃতিনির্ভর, আধ্যাত্মিকতার সাথে সংশ্লিষ্ট, ধর্মীয় ও সামাজিক আচারপ্রথা, বিনোদনমুখী, কথোপকথনভিত্তিক পরিবর্তনমুখী।
সংস্কৃতি কি
সংস্কৃতি কি: মানুষের জীবনযাপন প্রণালিকে সংস্কৃতি বলা হয় । অর্থাৎ সমাজের মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যা কিছু সৃষ্টি করা হয় তাকেই সংস্কৃতি বলে। সমাজবদ্ধ মানুষের চিন্তাচেতনা, ধ্যানধারণা, তাদের জ্ঞানের ভিত্তি ও বিকাশ, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ, রীতিনীতি ও আচারব্যবহার, বিশ্বাস এমনকি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, রাজনৈতিক ব্যবহার ও আচরণ প্রভৃতির সামগ্রিক রূপই হলো সংস্কৃতি ৷
প্রামাণ্য সংজ্ঞা:
ই. বি. টেইলর (E. B. Tylor) এর মতে, “সংস্কৃতি হচ্ছে জ্ঞানবিজ্ঞান, আচার বিশ্বাস, শিল্পকলা ও নীতিবোধ, আইনকানুন, অনুশীলন, অভ্যাস যা মানুষ সমাজে বাস করতে গিয়ে আয়ত্ত করে।”
হার্বাট স্পেন্সার (Herbert Spencer) এর মতে, “সংস্কৃতি হলো একটি অধি জৈবিক পরিবেশ যা জীবজন্তুর ও বৃক্ষ রাজির দ্বারা গঠিত, জৈবিক অথবা প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে ভিন্ন ।”
নৃবিজ্ঞানী হোবেল বলেছেন, “সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের অর্জিত আচরণের সামগ্রিক রূপ, যা সমাজের সদস্যদের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। এসব মোটেই জৈবিক উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নয় ৷ ”
বিডমির (Bidmy) মতে, “কৃষিজাত, শিল্পজাত, সমাজজাত এবং বুদ্ধিজাত উৎপাদিত ফলই হচ্ছে সংস্কৃতি।”
ম্যাকাইভারের (MacIver) মতে," আমরা যা তাই আমাদের সংস্কৃতি, আমরা যা ব্যবহার করি তাই আমাদের সভ্যতা।"
সমাজবিজ্ঞানী রস (Ross) তার
'Principles of Sociology' গ্রন্থে বলেন, 'সংস্কৃতি হলো সামগ্রিক অর্জিত আচরণ, যা
অনুকরণ ও শিক্ষার মাধ্যমে এক যুগ থেকে অন্য যুগে প্রবাহিত হয়।"
সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য
সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য: সংস্কৃতির নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিম্নে সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো-
১. শিক্ষালব্ধ:
মানুষের সব দিকই হচ্ছে সংস্কৃতি। কোনো বংশের পূর্ববর্তী পুরুষের কাছ থেকে পরবর্তী পুরুষের লোকেরা সংস্কৃতির শিক্ষা গ্রহণ করে। এটি মানুষের জন্মসূত্রে লব্ধক্ষমতা বা জৈবিকভাবে সঞ্চারিত বৈশিষ্ট্য নয় ।
২. ধারণালব্ধ:
সংস্কৃতি ধারণালব্ধ বিষয় এবং এটি সংস্কৃতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বারংবার তিরস্কার, যুক্তি, পরামর্শ প্রভৃতি দ্বারা কোনোকিছু করতে প্ররোচিত বা ধারণা জন্মাবার মাধ্যমে যুগের পর যুগ শিক্ষা দেওয়া বা জ্ঞানলাভ করার এ গুণ সংস্কৃতির বিশেষত্ব এবং ভাষাই এর মাধ্যম।
৩. সংস্কৃতি সামাজিক:
জনসংখ্যা ছাড়া
যেমন কোনো সমাজ হয় না তেমনি সমাজ ছাড়া কোনো সংস্কৃতি টিকে থাকতে পারে না। সমাজ
হলো আন্তঃসম্পর্কবিশিষ্ট স্বতন্ত্র লোকদের সমন্বয়ে ঠিক দল ।
৪. আদর্শ ও ধারণাবিশিষ্ট:
সমাজ কর্মশক্তিপূর্ণ এবং যুক্তির দিক থেকে সংস্কৃতিও শক্তিশালী। সমাজ সবসময় তার নিজস্ব সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং প্রত্যেক সমাজে একটি আদর্শ সংস্কৃতির উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায় ।
৫. অর্জিত:
সংস্কৃতি অর্জিত বিষয়। মানুষ জন্মগতভাবে বা বংশগতভাবে সংস্কৃতি পায় না। সমাজ, পরিবেশ, শিক্ষাঙ্গন, পরিবার, সামাজিক সংস্থা, রাষ্ট্র প্রভৃতির মাধ্যমে মানুষ সংস্কৃতি শিক্ষালাভ করে। শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ সংস্কৃতি সংরক্ষণ করে ।
৬. অখণ্ড:
সংস্কৃতির সব উপাদান পরস্পর সম্পর্ক বিশিষ্ট, বিশুদ্ধ ও অখণ্ড । সংগীত, শিল্পকলা, সাহিত্য, পরিচ্ছদ, রীতিনীতি, ভাষা প্রভৃতি আন্তঃসম্পর্ক বিশিষ্ট। প্রত্যেক সংস্কৃতি সামগ্রিক ব্যবস্থার মধ্যে পূর্ণরূপ প্রাপ্ত বহু মনোনীত বৈশিষ্ট্য দ্বারা গঠিত ।
৭. অংশগ্রহণধর্মী:
সংস্কৃতি সামাজিক অংশগ্রহণ বা অংশীদারভিত্তিক । ব্যক্তিগতভাবে এরূপ অংশগ্রহণ হয় না। মানুষ গোষ্ঠীভুক্তভাবে যেকোনো সংস্কৃতি গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে। যেমন— সামাজিক ঐতিহ্য, লোকপ্রথা, মূল্যবোধ ।
৮. সংস্কৃতি বিনিময় বা হস্তান্তরযোগ্য:
সংস্কৃতি এক প্রজন্ম হতে আর এক প্রজন্মে হস্তান্তরিত হওয়ার
যোগ্য। মাতাপিতা সন্তানদের সংস্কৃতি শেখায় এবং তারা আবার তাদের সন্তানদের শেখায়।
এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্মে সংস্কৃতি বিনিময় হতে থাকে ।
৯. সংগতিপূর্ণ ও সুসংহত:
সংস্কৃতি তার নিজস্ব উন্নয়নে সংগতিপূর্ণ হওয়ার প্রবণতা প্রকাশ করে। সংস্কৃতির বিভিন্ন অংশ একে অপরের সাথে আন্তঃসম্পর্কীয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সমাজের মূল্যবোধ ব্যবহার এর অন্যান্য দিক যেমন- নৈতিকতা, ধর্ম, প্রথা, ঐতিহ্য ও বিশ্বাস ইত্যাদির সাথে সম্পর্কিত ।
১০. সংস্কৃতি মানুষকে খুশি করে:
আমাদের জৈবিক ও সামাজিক সব চাহিদা ও আশা পূরণে সংস্কৃতি সঠিক সুযোগ সুবিধার নির্দেশনা দিয়ে থাকে।
১১. বস্তুগত ও অবস্তুগত উভয়ই হতে পারে:
প্রত্যেক সংস্কৃতিরই দুটি রূপ থাকে। একটি বস্তুগত রূপ অন্যটি অবস্তুগত। সংস্কৃতি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীতে সীমাবদ্ধ থাকে না। যেমন- আমাদের দেশে অনেকগুলো পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
১২. বিভিন্ন সমাজে ভিন্ন ভিন্ন রকম:
প্রত্যেক সমাজেরই কিছু নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। এটি এক সমাজ হতে আরেক সমাজে পৃথক । যেমন- সাংস্কৃতিক উপাদান, প্রথা, ঐতিহ্য, বিশ্বাস, আদর্শ, নৈতিকতা ইত্যাদি প্রত্যেক জায়গায় একই রকম নয়।
সংস্কৃতি উপাদান:
সংস্কৃতি উপাদান: সংস্কৃতির অনেকগুলো উপাদান রয়েছে। নিম্নে সংস্কৃতির উপাদানসমূহ আলোচনা করা হলো-
১. মূল্যবোধ:
সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো মূল্যবোধ। মূলত সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এমন একটা জিনিস যা কোনো জনসমষ্টির মধ্যে কাঙ্ক্ষিত বস্তু হিসেবে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়। মূল্যবোধকে সবাই অনুসরণ করে।
২. বিশ্বাস:
বিশ্বাস মানুষের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা সংস্কৃতির অন্যতম বাহন। বিশ্বাসের মানদণ্ডে ভালোমন্দের বিচার হয় না । যেমন— যারা যে ধর্মে বিশ্বাসী তারা সেই ধর্মকে ভালো মনে করে।
৩. আদর্শ:
এটি আপামর জনসাধারণের মধ্যে দেখা যায়। এ জাতীয় বিমূর্ত ভাবাদর্শ যথাযথভাবে অনুসরণ না করলেও কেউ আদর্শের বিরোধিতা অথবা সমালোচনা করে না। যেমন— কেউ সন্ন্যাসি জীবন বেছে নিলে তা অন্য কেউ অনুসরণ করুক বা না করুক সমালোচনা করে না ।
৪. সামাজিক লোকনীতি:
সামাজিক লোকনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অর্থাৎ অবশ্যপালনীয় এবং লিখিত নীতিমালাগুলোকেই সামনার Mores বলে অভিহিত করেছেন। যেমন— কেউ খুন করলে তার ফাঁসি এটাই স্বাভাবিক । অর্থাৎ লোকনীতি এর সাথে সমাজের ভালোমন্দ, কল্যাণ অকল্যাণ প্রভৃতি প্রশ্ন জড়িত।
৫. সামাজিক লোকাচার:
সমাজে এমন কতকগুলো কতিপয় সাধারণ আচরণ আছে, যা লঙ্ঘন করলে সমাজ দ্বারা তিরস্কৃত হতে হয় না বা শাস্তি পেতে হয় না। যেমন— পরিচিতজনের সাথে দেখা হলে করদর্শন করা এক ধরনের সামাজিক লোকাচার।
৬. আইন:
আইন হলো সামাজিক শৃঙ্খলা বা ভারসাম্য রক্ষার জন্য সমাজ প্রণীত কতকগুলো বিধিব্যবস্থা ও নিয়মকানুনের সমষ্টি। এটি ভঙ্গ করলে অপরাধীকে শাস্তি পেতে হয়। যেমন— কেউ চুরি করলে তাকে আইনের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করা হয়।
৭. ভাষা:
ভাষা হচ্ছে প্রত্যেকটি সংস্কৃতির ভিত্তি। কেবল এর মাধ্যমেই একটি সংস্কৃতি এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সঞ্চারিত হতে পারে। ভাষার মাধ্যমেই একটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর উপাদান বংশানুক্রমে বর্তায়।
৮. আচরণবিধি বা নিয়মকানুন:
মানুষ বিবেকবান প্রাণী। সমাজের সদস্য হিসেবে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ তার কাছ থেকে কাম্য নয়। তাই সে সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত বিধিবিধান মেনে নেয়। এটি সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান ।
৯. সামঞ্জস্যবিধানের প্রবণতা:
সামঞ্জস্যবিধান করা সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য উপদান। সমাজে বিরাজমান রীতিনীতিসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান করার ক্ষমতা সংস্কৃতির রয়েছে ।
১০. চাহিদা পূরণ:
সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হলো মানুষের প্রয়োজন পূরণ করা। ফলে মানুষ চাহিদা পূরণ করতে না পারলে তা সংস্কৃতির উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে না ।
১১. অভিজ্ঞতাভিত্তিক:
সাংস্কৃতিক অর্থই হলো এটি অভিজ্ঞতাভিত্তিক হবে। সংস্কৃতির মূলকথা হলো অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এটি বিকশিত হবে। তাই জন্মগতভাবে না হয়ে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এটি অর্জিত হয়ে থাকে ।
১২. শিক্ষাগত উপাদান:
শিক্ষা মানুষের সংস্কৃতির বাহন হিসেবে অফুরন্ত সম্ভাবনার বিকাশ ঘটায়। সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে মানুষের মননশীলতার বৃদ্ধি ঘটায় শিক্ষা ।
১৩. সামাজিক প্রথা:
সামাজিক প্রথা সংস্কৃতির একটি অন্যতম ধারক ও বাহক। এটি মানুষকে ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত করে। সংস্কৃতি সমাজ থেকে পুরাতন উপাদানের বিয়োজন করে নতুন উপাদানকে সংযোজন করে। এর ফলে মানুষের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত হয় ।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা
যায় যে, মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহৃত প্রতিটি বস্তুই সংস্কৃতির উপাদান । এই
উপাদানগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয় এবং পারস্পরিক সম্পর্কসূত্রে আবদ্ধ। তাই সমাজ
বিনির্মাণে সংস্কৃতির উপর্যুক্ত উপাদান অত্যন্ত তাৎপর্য বহন করে। সময়ের বিবর্তনের
সাথে সাথে সংস্কৃতির দি বিবর্তন ঘটে, নতুন সামাজিক পরিবেশ নতুন উপাদানের সংযোজন
এবং পুরাতনের বিয়োজন ঘটে।