খারিজি কারা? খারিজিদের উদ্ভব ও খারেজি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় মতবাদ ও রাজনৈতিক মতবাদ আলোচনা কর।


 

খারিজি কারা? খারিজিদের উদ্ভব ও খারেজি সম্প্রদায়ের  ধর্মীয় মতবাদ ও রাজনৈতিক মতবাদ আলোচনা কর।

হযরত মুহম্মদ (সা.) মুসলিম সমাজে কোরআন ও হাদিসভিত্তিক যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পরবর্তীকালে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আদর্শগত সংঘাতের কারণে তা বিনষ্ট হয়ে যায়। কালক্রমে মুসলিম সমাজ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ দলসমূহের মাঝে খারিজি সম্প্রদায় অন্যতম। এ দলটি প্রথমে ধর্মীয়-রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও পরবর্তীতে ধর্মীয় দলে রূপান্তরিত হয়।

খারিজি : নিম্নে খারিজিদের সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

১. খারিজি শব্দের শাব্দিক অর্থ : খারিজি শব্দটি আরবি খরুজ শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে । খারিজি শব্দের অর্থ দলত্যাগী বা বহির্গামী ।

২. খারিজি শব্দের পারিভাষিক অর্থ : সিফফিনের যুদ্ধের পর সংঘটিত দুমাতুল জান্দালের সালিশ মেনে না নিয়ে যে ১২ হাজার সৈন্যের দল আলি (রা.)-এর দলত্যাগ করে ইসলামের ইতিহাসে তারা খারিজি নামে পরিচিত।

৩. খারিজিদের উৎপত্তি : কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন যে হযরত আবু জর আল গিফারি এর অনুসারীরা নিজেদেরকে খারিজি নামে অভিহিত করে। আবু জর আল গিফারির নির্বাসন ক এবং সেখানে তার মৃত্যু হলে তাদের আন্দোলন জোরদার হয়ে পড়ে। ইবনে সাবার নেতৃত্বে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উত্তরসূরিদের মধ্যে থেকে খারিজি সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। তারা ওসমান (রা.)-কে পদচ্যুত করে আলি (রা.)-কে খিলাফত পদে অধিষ্ঠিত করার জন্য দুর্বার আন্দোলন পরিচালনা করে। ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে হযরত আলি ও মুয়াবিয়া (রা.)-এর মাঝে সংঘটিত যুদ্ধে দুমাতুল জান্দালের সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করা হয়। এর সময় আলি (রা.)-এর ১২ হাজার সমর্থক এ সালিশের সিদ্ধান্ত না মেনে দলত্যাগ করে। আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহাবকে দলপতি নির্বাচন করে তারা দল গঠন করে। এভাবেই মূলত খারিজি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয় ।

৪. খারিজিদের বিকাশ : হযরত আলি (রা.)-এর ইন্তেকালের পর খারিজিরা উমাইয়া সাম্রাজ্যের বিরোধিতা করতে শুরু করে। তারা উমাইয়া সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে নানা অরাজক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। তারা বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তবে প্রত্যেক দলের মূলনীতি প্রায় এক ছিল। দলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আযরাকী, নাজদায়ী, হামিরী, সাফারী, ইবাদী প্রভৃতি। পরবর্তীতে আযরাকী ও নাজদায়ীগণ বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তারা ইয়ামামা, বসরা, কুফা, ফারস, কিরমান, ওমান, বাহরাইন, খোরাসান, হিরাট, মসুল প্রভৃতি অঞ্চল বিধ্বস্ত করে ।

 

ইসলামের ইতিহাসে খারিজিদের উদ্ভব কীভাবে হয়েছিল?

ইসলামের ইতিহাসে খারিজি সম্প্রদায় প্রথম ধর্মীয় রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দল হিসেবে এদের জন্ম হলেও পরবর্তীতে এটি ধর্মীয় দলে পরিণত হয়। তাদের ধর্মীয় মতামত অপরাপর ধর্মীয় সম্প্রদায়ের তুলনায় ভিন্নতর ছিল বস্তুত খারিজি আন্দোলন ছিল উগ্রপন্থিদের দ্বারা পরিচালিত সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন ।

ইসলামের ইতিহাসে খারিজিদের উদ্ভব

ইসলামের ইতিহাসে খারিজিদের উদ্ভব : নিম্নে খারিজি সম্প্রদায়ের উদ্ভবের ইতিহাস সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :

১. আবু জর আল গিফারির অনুসারী : হযরত ওসমান (রা.)-এর শাসনামলে আবু জর আল গিফারি সম্পদ সঞয়ে জনগণকে নিরুৎসাহিত করতে প্রচারণা চালান। তিনি পার্থিব প্রভাব থেকে ইসলামের বিশুদ্ধতা ও সরলতা বজায় রাখার জন্য স্বীয় শিষ্যদের উমাইয়া প্রভাব থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে আবু জর আল গিফারির অনুসারীরা নিজেদেরকে খারিজি নামে অভিহিত করে। তারা উমাইয়াদের বিলাসিতা ও পার্থিব লালসার বিরোধিতা করে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে ।

২. ইবনে সাবার নেতৃত্ব : হযরত ওসমান (রা.)-এর শাসনামলে আবু জর আল গিফারি আল রাবাধা নামক পল্লিতে নির্বাসিত এবং পরবর্তীতে ঐ স্থানে মৃত্যুবরণ করলে উমাইয়া বিরোধী আন্দোলন আরও তৎপর হয়ে ওঠে। বিদ্রোহীরা ইবনে সাবার নেতৃত্বে তাদের আন্দোলন পরিচালনা করে। ওসমান (রা.)-এর স্থলে খিলাফতের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে তারা আলি (রা.)- কে খলিফা পদে অধিষ্ঠিত করার দাবি জানায়। ইবনে সাবার নেতৃত্বে পরিচালিত এ বিদ্রোহী গোষ্ঠী পরবর্তীতে খারিজি নামে পরিচিতি লাভ করে ।

৩. দুমাতুল জান্দালের সালিশে খারিজিদের উত্থান : হযরত আলি ও মুয়াবিয়া (রা.)-এর দ্বন্দ্বের সময় খারিজিরা তথা উমাইয়া বিরোধী আন্দোলনকারী বিদ্রোহীরা আলি (রা.)-কে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে। দুমাতুল জান্দালে আমর বিন আল আস কূটকৌশলের মাধ্যমে আলি (রা.)-কে খলিফা পদ থেকে অপসারণ করে মুয়াবিয়াকে খলিফা পদে নিযুক্ত করেন। আলি (রা.)-এর ১২ হাজার সমর্থক এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এবং তারা ঘোষণা করে লা হুকমা ইল্লাল্লাহু অর্থাৎ, আল্লাহ ছাড়া কারো ফয়সালা চলবে না । তারা আলি (রা.)-এর দলত্যাগ করে নতুন দল গঠন করে এবং খারিজি নামে পরিচিত হয়। হযরত আলি (রা.)-এর মৃত্যুর পর খারিজিরা উমাইয়া সাম্রাজ্যের বিরোধিতা শুরু করে। তারা উমাইয়া সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে নানা অরাজক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তবে প্রত্যেক দলের মূলনীতি প্রায় এক ছিল ।

 খারিজি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় মতবাদ

খারিজি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় মতবাদ : নিম্নে খারিজি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় মতবাদগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

১. ইমান ও আমলের প্রতি গুরুত্বারোপ : খারিজিরা ইমান ও আমলের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করতো। তাদের মতে, আমল ছাড়া ইমান অথবা ইমান ছাড়া আমলের কোনো গুরুত্ব নেই। এ দুটি পরস্পর অবিভাজ্য এবং উভয়ের মাঝে সামঞ্জস্য অপরিহার্য। সুতরাং কোনো ব্যক্তি নিয়মিত নামাজ আদায় এবং রোজা পালন না করলে সে কাফের হয়ে যাবে। এমন ব্যক্তিকে হত্যা করা উচিত।

২. কবিরা গুনাহকারী কাফেরঃ খারিজিদের মতে, যে ব্যক্তি কবিরা গুনাহ করে মৃত্যুমুখে পতিত হয় সে ব্যক্তি অনন্তকাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে থাকবে। তাদের মতে, গুনাহকারী কাফের এবং তাদেরকে হত্যা করা বৈধ। অপরদিকে, তারা বিবাহিত ব্যভিচারীর শাস্তি পাথর নিক্ষেপে হত্যা সমর্থন করে না ।

৩. কোরআনের অখণ্ডতায় বিশ্বাসী : খারিজিরা কোরআন মাজিদের অখণ্ডতায় বিশ্বাস করতো। তারা কোরআন মাজিদের শাব্দিক অর্থসমূহ গ্রহণ করতো। তাদের মতে, মহাগ্রন্থ আল কোরআন আল্লাহর সৃষ্ট বাণী হওয়ায় একে রূপকার্থে নয়; বরং আক্ষরিক অর্থে বুঝতে হবে। এমনকি রূপকার্থ বা অন্তর্নিহিত অর্থবোধক শব্দগুলো তারা অপসারণের দাবি জানায় এবং পার্থির বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ায় তারা সুরা ইউসুফকে প্রক্ষিপ্ত মনে করতো।

৪. অমুসলিমদের প্রতি উদারতা : খারিজিরা অমুসলিমদের প্রতি অত্যন্ত উদারনীতি পোষণ করতো। কোনো অমুসলিম মহানবি (সা.)-কে আল্লাহর নবি হিসেবে স্বীকার করলেই তাকে মুসলমানদের সমান অধিকার প্রদান করা হতো ।

৫. অখারিজিদের সম্পর্কে ধারণা : খারিজিদের সবচেয়ে বড় দল আযরাকী নিজেদের ছাড়া অন্য সকল মুসলমানদের মুশরিক মনে করতো। তাদের মতে, নিজেদের ছাড়া অন্য আসনে সাড়া দেওয়া খারিজিদের জন্য বৈধ নয়, অন্য কারো জবাই করা পশু হালাল নয়, অন্য কোনো মুসলিমকে বিবাহ করাও জায়েজ নয়।

খারিজি সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক মতাদর্শ 

খারিজি সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক মতাদর্শ : নিম্নে খারিজি সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

১. স্বর্গীয় ক্ষমতা: খারিজিদের মূলমন্ত্র হলো না মা ইন্না অর্থাৎ, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো হুকুম বা ফয়সালা দেওয়ার অধিকার নেই। সুতরাং তাদের মতে, বিচার, ফয়সালা বা মীমাংসা করার ক্ষমতা কোনো মানুষের নেই।

২. বংশগত কৌলীনা : খারিজিদের মতে খলিফাদের কুরাইশ বা বিশেষ কোনো গোত্র বা সম্প্রদায় হতে নির্বাচিত হতে হবে তা ঠিক নয়। উপযুক্ততা বিচারে যেকোনো আরব মুসলমান, হাবশি ক্রীতদাস এমনকি নারীগণও যোগ্যতার ব্যাপারে মুসলিম জাহানের খলিফা হতে পারেন।

৩. খিলাফত : খারিজিরা খিলাফত সম্পর্কে সম্পূর্ণ প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক মনোভাব পোষণ করে। তাদের মতে, আল্লাহ হলো প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী এবং খলিফা তার প্রতিনিধি মাত্র, সুতরাং খিলাফতের ওপর কারো একচেটিয়া অধিকার থাকবে না বরং খলিফাকে অবশ্যই সমগ্র মুসলিম জাতি কর্তৃক নির্বাচিত হতে হবে ।

৪. সরকার প্রতিষ্ঠা নিষ্প্রয়োজন : চরমপন্থি খারিজিদের বড় দল আন নাজদায়ী মনে করতো খিলাফত তথা রাষ্ট্র সরকার প্রতিষ্ঠা আদতেই অপ্রয়োজনীয়। মুসলমানদের নিজেদের পক্ষ থেকে সামাজিক কাজ করা উচিত। তাদের জন্য কোরআন সুন্নাহই যথেষ্ট। তবে মুসলমানরা খলিফা নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলে করতে পারে।

৫. আইনগত খলিফা : খারিজিরা হযরত আবু বকর (রা.) এবং হযরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকে বৈধ হিসেবে স্বীকার করতো। তারা মনে করতো খিলাফতের শেষের দিকে ওসমান (রা.) আদর্শচ্যুত হয়ে পড়েন। অপরদিকে, আল্লাহ ছাড়া মানুষকে সালিশ নিযুক্ত করে আলি (রা.) ও কবিরা গুনাহ করেছেন । তারা উভয়েই পাপী ব্যক্তি।

৬. উমাইয়া ও আব্বাসি খিলাফত সম্পর্কে তাদের অভিমত : খারিজিরা উমাইয়া খলিফাদের মাঝে শুধুমাত্র ওমর বিন আব্দুল আজিজকে খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং অন্যান্য উমাইয়া খলিফাদের খিলাফত অপহরণকারী হিসেবে অভিহিত করে। আব্বাসি খলিফাদের মধ্যে মামুন ব্যতীত অন্যান্য খলিফাদের তারা অবৈধ মনে করতো।


পরিশেষে বলা যায় যে, খারিজিগণ ইসলামে ধর্মীয়, রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে পরিচিত। তারা ইসলামের এমন একটি শুদ্ধাচারী ও চরমপন্থি দল যারা ধর্মীয়ভাবে গোঁড়া এবং রাজনীতিতে গণতন্ত্রমনা ছিল। খারিজিরা ইসলামের ইতিহাসে বিভিন্ন সংঘর্ষ সৃষ্টিকারী হিসেবে পরিচিত।


 

Post a Comment

Previous Post Next Post