ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা.)-এর
সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সারা মুসলিম জাহানে যখন ব্যাপক অরাজকতা বিরাজ করছিল
ঠিক সে মুহূর্তে হযরত আলি (রা.) ইসলামের চতুর্থ খলিফা হিসেবে খিলাফতের দায়িত্বভার
গ্রহণ করেন। হযরত আলি (রা.)-এর খিলাফতকালে তিনি বিভিন্ন গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হন। এসব
গৃহযুদ্ধের মধ্যে উষ্ট্রের যুদ্ধ ছিল অন্যতম। মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের এটিই
ছিল সর্বপ্রথম গৃহযুদ্ধ। বিশিষ্ট সাহাবি হযরত তালহা, জুবায়ের এবং হযরত আয়েশা (রা.)-এর সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে হযরত আলি (রা.)-এর
পরিচালিত যুদ্ধটি ইসলামের ইতিহাসে উষ্ট্রের যুদ্ধ নামে পরিচিত ।
উষ্ট্রের যুদ্ধের কারণ : হযরত আলি (রা.)-এর
খিলাফতকালে সংঘটিত উষ্ট্রের যুদ্ধের পশ্চাতে কতিপয় কারণ দায়ী ছিল। নিম্নে উষ্ট্রের
যুদ্ধের কারণগুলো আলোচনা করা হলো :
১. হযরত ওসমান (রা.) হত্যার বিচার দাবি :
হযরত আলি (রা.) খিলাফত লাভের পর হযরত তালহা, জুবায়ের ও আয়েশা (রা.) খলিফা হযরত ওসমান (রা.)-এর নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে হত্যাকারীদের শাস্তি দাবি করেন। এমতাবস্থায় হযরত আলি (রা.) সাম্রাজ্যের বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ওসমান (রা.) হত্যার তাৎক্ষণিক বিচারে অসম্মতি জানালে হযরত তালহা, জুবায়ের ও আয়েশা (রা.) হযরত আলি (রা.)-এর বিরোধিতা শুরু করেন। যা উষ্ট্রের যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে ।
২. হযরত আলি (রা.)-এর বিরুদ্ধে অসন্তোষ :
হযরত আলি (রা.)-এর বিরুদ্ধে খিলাফত লাভের পর তালহা (রা.) ও জুবায়ের (রা.) যথাক্রমে
কুফা ও বসরার শাসনক্ষমতা দাবি করেন। কিন্তু হযরত আলি (রা.) তাদের দাবি পূরণে অসম্মতি
জ্ঞাপন করলে তারা খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেন।
৩. হযরত আয়েশা (রা.)-এর বিরোধিতা :
হযরত
আলি (রা.)- এর খিলাফত লাভে হযরত আয়েশা (রা.)-এর সমর্থন থাকলেও হযরত ওসমান (রা.)-এর
হত্যার বিচারের দাবিতে তালহা ও ন জুবায়ের (রা.) হযরত আলি (রা.)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
শুরু করলে হযরত আয়েশা (রা.) তাদের পক্ষ অবলম্বন করেন এবং য়. তারা সমবেতভাবে হযরত
আলি (রা.)-এর বিরোধিতা করেন।
৪. অন্যায়ের প্রতিকারে বিলম্ব :
হযরত
আয়েশা (রা.) ছিলেন ন্যায়বিচারের মূর্তপ্রতীক। এ ন্যায়ের পথ অনুসরণ করে তিনি হযরত
ওসমান (রা.) হত্যার বিচার দাবি করলে হযরত আলি (রা.) এ অন্যায়ের প্রতিকারে বিলম্ব শুরু
করে। হযরত আলি (রা.)-এর বিলম্বের কারণে যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হয় ।
৫. হযরত আলি (রা.)-এর অদূরদর্শিতা :
হযরত
আলি (রা.) খিলাফতে আসীন হয়ে শাসনব্যবস্থার কিছু নীতি পরিবর্তন র্ত করেন। হযরত আয়েশা
(রা.),
তালহা (রা.) ও জুবায়ের (রা.) তাঁর অনুসৃত নীতিগুলো পছন্দ করতেন
না। তাঁর অনুসৃত নীতিগুলো হযরত আলি (রা.)-এর কূটনৈতিক অদূরদর্শিতার পরিচয় বহন
করে।
৬. প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের অপসারণ :
হযরত
আলি (রা.) হা, খিলাফত লাভ করে ওসমান (রা.)-এর শাসনকালে
নিযুক্ত উমাইয়া গোত্রীয় শাসকদের শাসন ক্ষমতা থেকে অপসারণ মর করেন। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের
অপসারণে বিশিষ্ট সাহাবিগণসহ আরবের বহু জনগণ হযরত আলি (রা.)-এর প্রতি অসন্তুষ্ট হন।
উষ্ট্রের যুদ্ধের ঘটনাবলী :
হযরত তালহা, জুবায়ের ও আয়েশা (রা.)-এর বাহিনীর সাথে হযরত আলি (রা.)-এর
বাহিনীর মধ্যে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে উষ্ট্রের যুদ্ধটি সংঘটিত হয়। হযরত আয়েশা (রা.) উষ্ট্রের
পিঠে চড়ে যুদ্ধটি পরিচালনা করেছিলেন বলে ইতিহাসে এ যুদ্ধ উষ্ট্রের যুদ্ধ নামে পরিচিত।
হযরত ওসমান (রা.)-এর নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে তালহা, জুবায়ের ও আয়েশা (রা.)-এর সাথে আলি (রা.)-এর যুদ্ধ বাধে। নিম্নে
উষ্ট্রের যুদ্ধের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. তালহা ও জুবায়ের (রা.)-এর সাথে আয়েশা (রা.)-এর যোগদান :
হযরত আলি (রা.)-এর প্রতি আনুগত্যের শপথ ভঙ্গ করে তালহা ও জুবায়ের (রা.) ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে তিন সহস্রাধিক সৈন্য সংগ্রহ করে মদিনা ত্যাগ করেন। এসময় আয়েশা (রা.) হজ শেষে উষ্ট্রের পিঠে করে মক্কা থেকে মদিনায় ফিরছিলেন । পথিমধ্যে তালহা ও জুবায়ের (রা.)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয় । হযরত আয়েশা (রা.) তালহা ও জুবায়েরের নিকট থেকে সবকিছু সম্পর্কে অবগত হয়ে ওসমান হত্যার বিচারের দাবিতে তাদের সাথে যোগদান করেন এবং আলি (রা.)-এর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন ।
২. তালহা, জুবায়ের ও আয়েশা (রা.)-এর বসরা অধিকার :
তালহা, জুবায়ের ও আয়েশা (রা.) মক্কা, মদিনা ও ইরাক থেকে ৩ হাজার সৈন্য সংগ্রহ করে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের
অক্টোবর মাসে বসৱা অধিকার করেন। আয়েশা (রা.)-এর বাগ্মিতায় মুগ্ধ হয়ে বসরাবাসীগণ
তাঁর সাথে যোগদান করেন। তারা ওসমান (রা.)-এর হত্যার সাথে জড়িত কিছু ব্যক্তিকে কঠোর
শাস্তি প্রদান করেন এবং বসরার শাসনকর্তা ওসমান বিন হানিফকে পরাজিত ও ধৃত করেন ।
৩. হযরত আলি (রা.)-এর বসরা অভিযান :
হযরত
তালহা,
জুবায়ের ও আয়েশা (রা.)-এর বসরা অধিকারের সংবাদ শোনামাত্র আলি
(রা.) কুফার শাসনকর্তা আবু মুসা আল আশআরিকে নিয়ে বসরায় যাত্রা করতে চাইলেন। কিন্তু
কুফার শাসক আলি (রা.)-কে সাহায্যদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেন। ফলে আলি (রা.) তাকে পদচ্যুত
করলেন। অতঃপর তিনি ২০ হাজার সৈন্যের সাথে কুফার ৯ হাজার সৈন্য মিলিয়ে ২৯ হাজার সেন্য
নিয়ে বসরা অভিমুখে অভিযান চালান। তিনি রক্তপাত এড়ানোর লক্ষ্যে আয়েশা (রা.)-এর বাহিনীর
প্রতি শান্তিপূর্ণ আলোচনার প্রস্তাব দেন। তালহা, জুবায়ের ও আয়েশা (রা.) উক্ত প্রস্তাবে সম্মতি দেন।
৪. কোরায়বার যুদ্ধ :
আলি (রা.) ও আয়েশা
(রা.)-এর মধ্যে শান্তি প্রস্তাব চলাকালে একটি গুপ্তঘাতক দল রাতের অন্ধকারে নগরের উপকণ্ঠে
কোরায়বা নামক স্থানে আয়েশা (রা.)-এর নিদ্রিত বাহিনীর ওপর অতর্কিতে হামলা করে। ফলে
প্রভাতে উভয়পক্ষ ভীষণভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এতে বহু মুসলমান হতাহত হতে লাগল ।
এ সংবাদ শুনে খলিফা ও আয়েশা (রা.) বিস্মিত হলেন এবং আয়েশা (রা.) উষ্ট্রে চড়ে ও খলিফা
অশ্বে আরোহণ করে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি স্থাপনে সচেষ্ট
হন ।
৫. হযরত আয়েশা (রা.)-এর পরাজয় :
আয়েশা
(রা.) যুদ্ধ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে কোরআন উত্তোলন করে আদেশ দিলে কোরআন উত্তোলনকারীকে
হত্যা করা হয় এবং স্বয়ং আয়েশা ফন (রা.)-কে আক্রমণ করা হয়। এমতাবস্থায় আয়েশা
(রা.)-কে হ্য বিদ্রোহীদের আক্রমণ থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রায় ৪,৭৩০ জন সৈন্য আত্মাহুতি দেয় ।
৬. হযরত তালহা ও জুবায়ের (রা.)-এর মৃত্যু :
তালহা ও জুবায়ের (রা.) সন্ধির পর মক্কার পথে বসরা ত্যাগ করার সময় দুজন আততায়ী
কর্তৃক নিহত হন।
৭. হযরত আলি (রা.)-এর যুদ্ধ বন্ধের প্রচেষ্টা ও বিজয় :
এমতাবস্থায় হযরত আলি (রা.) বহু কষ্টে যুদ্ধ বন্ধ করতে সচেষ্ট হন এবং যুদ্ধে
আলি (রা.)-এর পক্ষ জয়লাভ করে। যুদ্ধ শেষে আলি (রা.) মুহম্মদ বিন আবু বকরকে ৪০ জন মহিলাসহ
হযরত আয়েশা (রা.)-কে সসম্মানে ও নিরাপদে মদিনায় পাঠিয়ে দেন। এছাড়া হযরত আলি (রা.)
হতাহতদের চিকিৎসা ও নিহতদের দাফনের ব্যবস্থা করেন। এ যুদ্ধে প্রায়
দশ হাজার মুসলমান শহিদ হয় ।
উষ্ট্রের যুদ্ধের ফলাফল : নিম্নে উল্টের যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. হযরত আলি (রা.)-এর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা :
উষ্ট্রের যুদ্ধের মাধ্যমে কৃষ্ণা ও বসরায় হযরত আলি (রা.)-এর কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত
হয় । কুফা ও বসরায় মুসলমানদের মধ্যে যে অন্তর্ষস্থ বিরাজ করছিল তাঁর সমাপ্তি ঘটে
উস্ট্রের যুদ্ধের মাধ্যমে।
২. আত্মঘাতী যুদ্ধ :
ইসলামের ইতিহাসে
উস্ট্রের যুদ্ধ ছিল প্রথম আত্মঘাতীমূলক গৃহযুদ্ধ। কারণ এ যুদ্ধে সর্বপ্রথম মুসলমানরা
মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে।
৩. মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট :
উষ্ট্রের
যুদ্ধের ফলে মুসলমানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করায় মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট
হয়। এর মাধ্যমে মুসলমানদের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে ভাঙন তৈরি হয় ।
৪. ইসলামের অকল্যাণ ও ক্ষতি :
মুসলমানদের
ভ্রাতৃত্ব ও সংহতিতে গুরুতর আঘাত হানার ফলে উষ্ট্রের যুদ্ধের মাধ্যমে ইসলামের ব্যাপক
অকল্যাণ ও ক্ষতি সাধিত হয়। এছাড়া হযরত তালহা ও যুবায়ে (রা.)-এর মতো বিশিষ্ট সাহাবিদ্বয়ের
মৃত্যু ইসলামের পক্ষে অকল্যাণকর ও ক্ষতিকর বলে গণ্য করা হয়।
৫. খিলাফতের মূলে কুঠারাঘাত :
উষ্ট্রের
যুদ্ধের ফলে হযরত আলি (রা.) রাজধানী মদিনা থেকে কুফায় স্থানান্তর করেন। যা ইসলামি
খিলাফতের মূলে কুঠারাঘাত করে। রাজধানী কুফা হওয়ায় কুফার বিদ্রোহী জনতার ওপর হযরত
আলি (রা.)-এর নির্ভরতা বেড়ে গিয়েছিল যা খিলাফতের জন্য ছিল অকল্যাণকর।
৬. গোত্রীয় দ্বন্দ্ব সংঘাত :
রক্তক্ষয়ী
যুদ্ধের ফলে মুসলমানদের মধ্যে গোত্রীয় দ্বন্দ্ব সংঘাত সৃষ্টি হয় ।
৭. বহু মুসলমানের প্রাণনাশ :
উষ্ট্রের
যুদ্ধে বহু মুসলমানের প্রাণনাশ ঘটে। এজন্য একে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম বলা যায়। এ যুদ্ধে
আয়েশা (রা.)-এর নিরাপত্তার জন্য প্রায় ৪,৭৩০ জন সৈন্য
আত্মাহুতি দেয়। এছাড়া সামান্য ভুল বুঝাবুঝির জন্য প্রায় দশ হাজার মুসলমান প্রাণ
হারায় ।
৮. ভুল বুঝাবুঝির অবসান :
যুদ্ধের পূর্বে
হযরত আলি (রা.)- এর সাথে হযরত তালহা, জুবায়ের ও আয়েশা (রা.)-এর যে ভুল বুঝাবুঝি তৈরি হয়েছিল যুদ্ধে হযরত আলি (রা.)-এর
বিজয়ের মাধ্যমে তার সমাপ্তি ঘটে।
৯. দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষের পথ তৈরি :
উষ্ট্রের
যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষের পথ তৈরি হয়। যুগ যুগ ধরে
স্বার্থ সংঘাত, গোত্রীয় দ্বন্দ্ব মুসলমানদের মধ্যে চলতে
থাকে যা পরবর্তীতে রক্তক্ষয়ী ইতিহাস সূচনার দ্বার উন্মোচিত করে ।
১০. মদিনার প্রাধান্য হ্রাস :
উস্ট্রের
যুদ্ধের পরবর্তীতে রাজধানী স্থানান্তরের ফলে সুদীর্ঘকাল ধরে মুসলমানদের প্রশাসনের কেন্দ্রস্থল
মদিনার প্রাধান্য হ্রাস পায়। বহু পূর্ব থেকেই মুসলমানদের প্রাণকেন্দ্র ছিল মদিনা।
মুসলমানদের প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণও ছিল মদিনাকে ঘিরে। যা রাজধানী কুফায় স্থানান্তরের
ফলে পরিবর্তিত হয়।