সিফফিনের যুদ্ধের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল পর্যালোচনা কর।

সিফফিনের যুদ্ধের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল পর্যালোচনা কর।

সিফফিনের যুদ্ধের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল পর্যালোচনা কর।

হযরত ওসমান (রা.)-এর শাহাদাতের পর ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের চতুর্থ খলিফা হিসেবে হযরত আলি (রা.) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। হযরত আলি (রা.) খিলাফত গ্রহণ করে বিভিন্ন বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হন। এসব গৃহযুদ্ধের মধ্যে হযরত আলি (রা.) ও হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর মধ্যে সংঘটিত সিফফিনের যুদ্ধ ছিল অন্যতম। এ যুদ্ধে হযরত আলি (রা.) হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর কূটনৈতিক দূরদর্শিতার নিকট ব্যর্থ হন যা খিলাফতের পরিসমাপ্তি ঘটায় এবং রাজতন্ত্রের সূচনা করে ।

সিফফিনের যুদ্ধের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল : নিম্নে সিফফিনের যুদ্ধের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল পর্যালোচনা করা হলো :

সিফফিনের যুদ্ধের কারণ : নিম্নে সিফফিনের যুদ্ধের কারণসমূহ আলোচনা করা হলো :

১. হযরত ওসমান (রা.)-এর হত্যার বিচার দাবি : হযরত আলি (রা.)-এর খিলাফত লাভের সাথে সাথে হযরত মুয়াবিয়া (রা.) এবং পদচ্যুত আমিরগণ একযোগে উমাইয়াদের নিয়ে হযরত ওসমান (রা.) হত্যার বিচার দাবি করে। হযরত আলি (রা.) তাৎক্ষণিকভাবে বিচারকার্য সমাধা করতে না চাইলে হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর সাথে হযরত আলি (রা.)-এর সম্পর্কের অবনতি হয়। ফলে সিফফিনের যুদ্ধ ত্বরান্বিত হয় ।

২. উমাইয়া-হাশেমি দ্বন্দ্ব : হযরত আলি (রা.)-এর খিলাফতকালে উমাইয়া-হাশেমি দ্বন্দ্ব ব্যাপক আকার ধারণ করে। হযরত আলি (রা.) হাশেমি বংশের হওয়ায় তাঁর খিলাফত প্রাপ্তিতে উমাইয়া বংশের স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটে। ফলে উমাইয়াগণ হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর নেতৃত্বে হযরত আলি (রা.)-এর বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে ।

৩. উমাইয়াদের সম্পত্তির হিসাব দাবি : হযরত আলি (রা.) খিলাফতে আসীন হয়ে হযরত মুয়াবিয়া (রা.) ও প্রাদেশিক শাসনকর্তাসহ উমাইয়াদের অনেকের সম্পত্তির হিসাব দাবি করেন। হযরত ওসমান (রা.)-এর খিলাফতকালে মুয়াবিয়া ও উমাইয়ারা বিভিন্ন উপায়ে সরকারি সম্পত্তি ও জায়গির লাভ করেছিল। হযরত আলি (রা.) তাদের এ দখলকৃত সম্পত্তি বায়তুলমালে জমা দেওয়ার আদেশ দিলে তারা হযরত আলি (রা.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ করে ।

৪. হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর খলিফা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা : হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর মধ্যে প্রথম থেকেই খলিফা হওয়ার বাসনা সুপ্ত ছিল। ফলে হযরত আলি (রা.)-এর খিলাফতকে তিনি সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। তিনি সিরিয়ার শাসনকর্তা হিসেবে বিপুল পরিমাণে সৈন্য সংগ্রহ করে হযরত আলি (রা.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং নিজের খলিফা হওয়ার বাসনাকে বাস্তব রূপদান করেন ।

৫. হযরত আলি (রা.)-এর বিরুদ্ধে হযরত মুয়াবিয়া (রা.)- এর অপপ্রচার : হযরত মুয়াবিয়া (রা.) হযরত ওমান (রা.)- এর হত্যাকাণ্ডের জন্য হযরত আলি (রা.)-কে দায়ী করেন ও জনগণের নিকট অপপ্রচার চালাতে থাকেন। তিনি সমান (রা.)-এর রক্তাক্ত পোশাক ও তাঁর স্ত্রীর কাটা আঙুল জনসম্মুখে প্রদর্শন করে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেন। যার ফলে হযরত আলি (রা.) হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর বিরুদ্ধে অভিযানে অগ্রসর হন এবং এযুদ্ধ সংঘটিত হয়।

সিফফিনের যুদ্ধের ঘটনা :উপরিউক্ত কারণগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে হযরত আলি (রা.) হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-কে দমনের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-কে সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসের প্রথম দিকে ৫০,০০০ সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে সিরিয়া অভিমুখে রওনা হন। এ সংবাদ শুনে হযরত মুয়াবিয়া (রা.) বিলম্ব না করে ৬০,০০০ সৈন্যসহ ইউফ্রেটিস নদীর তীরে সিফফিন নামক স্থানে উপস্থিত হন।

 হযরত আলি (রা.) রক্তপাত পরিহার করার জন্য হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর নিকট শান্তি প্রস্তাব পাঠান। মুয়াবিয়া (রা.) তাতে রাজি না হলে হযরত আলি (রা.) মল্লযুদ্ধের আহ্বান করেন। এতেও হযরত মুয়াবিয়া (রা.) কোনো সাড়া না দিলে হযরত আলি (রা.) ২৭ হিজরির ১১ সফর সিফফিন প্রান্তরে যুদ্ধ পরিচালিত করেন। যুদ্ধে মুয়াবিয়া (রা.) যখন হযরত আলি (রা.)-এর নিকট চূড়ান্ত পরাজয়বরণের পথে ধাবিত হন সেই মুহূর্তে তার সহচর আমর বিন আল আসের একটি পরামর্শ তাকে পরাজয় হতে রক্ষা করে। 

তিনি আমর বিন আল আসের পরামর্শে হঠকারিতার আশ্রয় নিয়ে সন্ধির জন্য বর্শার মাথায় কোরআন শরিফ উত্তোলন করে মীমাংসা প্রার্থনা করলে হযরত আলি (রা.) সৈন্যদের অনুরোধে যুদ্ধ বিরতি করতে বাধ্য হন। ফলে দুমাতুল জান্দালের মীমাংসায় হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর সালিশ আমর বিন আল আসের কূটকৌশলের কারণে হযরত আলি (রা.)-এর সালিশ আবু মুসা আল আশয়ারি পরাজয়বরণ করেন। এর মাধ্যমে হযরত আলি (রা.) একটি চূড়ান্ত বিজয় থেকে বঞ্চিত হন এবং খিলাফতের ভবিষ্যৎ বিপন্ন করেন।


সিফফিনের যুদ্ধের ফলাফল : নিম্নে সিফফিনের যুদ্ধের ফলাফল আলোচনা করা হলো :

১. খিলাফতের পতন : এ যুদ্ধের মাধ্যমে হযরত আলি (রা.) ও হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর মধ্যে সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ হয়। ফলে মুসলিম সাম্রাজ্যে অরাজকতার সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে হযরত আলি (রা.)-কে হত্যার মধ্য দিয়ে মুসলিম খিলাফতের পতন ঘটে।

২. খারিজি সম্প্রদায়ের উদ্ভব : এ যুদ্ধের ফলে ইসলামের ইতিহাসে খারিজি সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। যুদ্ধে হযরত আলি (রা.)-এর সেনাবাহিনীতে ১২,০০০ সৈন্যের একটি দল যুদ্ধের মীমাংসার জন্য আল্লাহর সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত বলে “লা হুকমা ইল্লা লিল্লাহ” নীতি গ্রহণ করে হযরত আলি (রা.)-এর দল পরিত্যাগ করেন। ইতিহাসে এরাই খারিজি নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে এই খারিজিরা বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে জড়িয়ে সাম্রাজ্যে অরাজকতার সৃষ্টি করে ।

৩. মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট :এ যুদ্ধের ফলে মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন বিনষ্ট হয়। তারা বিভিন্ন দলে  উপদলে বিভক্ত হয়ে যায় ।

৪.উমাইয়া-হাশেমি দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি : এ যুদ্ধের ফলে উমাইয়া-হাশেমি দ্বন্দ্ব ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। মহানবি (সা.)-এর সাম্যের বাণীতে উমাইয়া-হাশেমিদের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সিফফিনের যুদ্ধের ফলে তার ব্যাপক অবনতি ঘটে।

৫. রাজতন্ত্রের উদ্ভব : সিফফিনের যুদ্ধের মাধ্যমে খিলাফতের পরিসমাপ্তি ঘটে ও হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের উত্থান ঘটে।

৬. বায়তুলমালের সম্পত্তির ওপর উমাইয়াদের কর্তৃত্ব : সিফফিনের যুদ্ধের ফলে খিলাফতের সমাপ্তি ঘটে ও হযরত মুয়াবিয়া (রা.) উমাইয়া শাসন প্রতিষ্ঠা করে বায়তুলমালের সম্পত্তির ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি উমাইয়াদের ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হয়।


উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সিফফিনের যুদ্ধ ছিল ইসলামের ইতিহাসে একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা । এ যুদ্ধে হযরত আলি (রা.)-এর পরাজয়ের মাধ্যমে মুসলিম খিলাফতের পতন ত্বরান্বিত হয় এবং হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর উমাইয়া শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের উত্থান ঘটে । ইসলামের ইতিহাসে এ যুদ্ধটি যথার্থই একটি প্রহসন হিসেবে আখ্যায়িত। এ যুদ্ধের ফলে পরবর্তীতে ইসলামের ঐক্য ও সংহতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যা ইসলামের ভিতকে নড়বড়ে করে দেয় ।

Post a Comment

Previous Post Next Post