তাবুক অভিযানের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল আলোচনা কর।

 

তাবুক অভিযানের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল আলোচনা কর।


তাবুক অভিযানের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল লোচনা কর।


ভূমিকা :

মহানবি (সা.)-এর জীবনের সর্বশেষ অভিযান ছিল তাবুক অভিযান যা 'গাজওয়াতুল ওসারাত' বা কষ্টের যুদ্ধ নামে পরিচিত। বাইজান্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস মুসলমানদের বিজয়ে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাদের দমন করার জন্য ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে লক্ষাধিক সৈন্য নিয়ে মদিনা আক্রমণের জন্য বের হলে মহানবি (সা.) তাদের প্রতিরোধ করার জন্য তাবুক অভিযানে বের হন। মুসলমানদের ব্যাপক প্রস্তুতির কথা শ্রবণ করে বাইজান্টাইনরা ভয় পেয়ে যুদ্ধ না করে ফিরে যান। ফলে কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। এ অভিযানের পর মহানবি (সা.)- এর জীবদ্দশায় আর কোনো যুদ্ধ হয়নি ।

তাবুক অভিযানের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল : নিম্নে তাবুক অভিযানের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো : 

তাবুক অভিযানের কারণ : তাবুক অভিযানের কারণসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো :

১. ইহুদিদের ষড়যন্ত্র:

মদিনায় বসবাসরত ইহুদিরা মদিনা সনদের শর্তাবলি ভঙ্গ করলে তাদের খাইবারে নির্বাসিত করা হয়। খাইবারে নির্বাসিত হয়ে ইহুদিরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ইহুদিদের ষড়যন্ত্রের ফলে তাবুক অভিযান অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।

২. সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সাম্রাজ্য হারানোর ভয় :

হুদায়বিয়া সন্ধির পর মুসলমানরা একে একে মক্কা বিজয়, মুতার যুদ্ধ ও হুনাইনের যুদ্ধ প্রভৃতি যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার ফলে ইসলাম দ্রুত সারা বিশ্বে প্রসার লাভ করে। ইসলামের দ্রুত প্রসারের কারণে বাইজান্টাইন সম্রাট নিজের সাম্রাজ্য হারানোর আশঙ্কা করেন। তিনি নিজের সাম্রাজ্যকে অটুট রাখার জন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন । ফলে তাবুক অভিযান সংঘটিত হয়।

৩. মক্কা ও তায়েফ বিজয় :

মহানবি (সা.) মক্কা ও তায়েফ বিজয় করলে মুসলমানদের শক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। মুসলমানদের এই বিজয় বাইজান্টাইন সম্রাটকে ঈর্ষান্বিত করে তোলে। কেননা তিনি অনেক পূর্ব থেকেই আরবদেশ জয়ের স্বপ্ন দেখছিলেন। তিনি মুসলমানদের আধিপত্য সহ্য করতে না পেরে তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেন । ফলে তাবুক অভিযান অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।

৪. মহানবি (সা.) নিহত হওয়ার গুজব :

 বাইজান্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে গুজব সংবাদ পৌঁছে যে, মহানবি (সা.) মৃত্যুবরণ করেছেন এবং আরবে দুর্ভিক্ষ দেখা দেওয়ায় সেখানকার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থাও প্রায় ভঙ্গুর। এ সুযোগে মদিনা আক্রমণের জন্য বাইজান্টাইন সম্রাট বিশাল সৈন্যবাহিনী সংগ্রহ করে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ফলে তাবুক অভিযান ত্বরান্বিত হয়।

৫. ঘাসসানিদের সহযোগিতা :

মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযানে বাইজান্টাইন সম্রাটকে ঘাসসানিরা সহযোগিতা করেছিল। সম্রাট হিরাক্লিয়াস ৬৩১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে ঘাসসানিদের সহযোগিতায় লক্ষাধিক সৈন্য নিয়ে মদিনা অভিমুখে রওয়ানা দেন। মহানবি (সা.) মদিনা রাষ্ট্রকে নিরাপদ রাখার জন্য তাদের বিরুদ্ধে সৈন্য নিয়ে তাবুক অভিযানে বের হন ।

তাবুক অভিযানের ঘটনা : 

হুদায়বিয়া সন্ধির পর হযরত মুহম্মদ (সা.) বাইজান্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াসের দরবারে দূত প্রেরণ করলে সম্রাট দূতকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান। কিন্তু সম্রাট বহুদিন থেকে আরবদেশ জয় করার আশা পোষণ করতেন । মক্কা ও তায়েফ বিজয়ের পর সমগ্র আরবে মুহম্মদ (সা.)-এর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি ঈর্ষান্বিত হন। তদুপরি ইহুদিদের প্ররোচনা এবং মুতার যুদ্ধে খ্রিস্টানদের শোচনীয় পরাজয়ে তিনি অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে লক্ষাধিক সৈন্যসহ মদিনা অভিযানে অগ্রসর হন। 

মহানবি (সা.) এ সংবাদ পেয়ে ১০,০০০ অশ্বারোহীসহ মোট ৩০,০০০ মুসলিম সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী নিয়ে সিরিয়ার সীমান্তবর্তী তাবুক নামক স্থানে হাজির হন । এ যুদ্ধে আবু বকর (রা.) তাঁর সমস্ত সম্পত্তি, হযরত ওমর (রা.) তাঁর অর্ধেক সম্পত্তি, হযরত ওসমান (রা.) ১,০০০ স্বর্ণমুদ্রা, ১,০০০ উট এবং ৭০টি অশ্ব যুদ্ধ তহবিলে দান করেন। মুসলিম বাহিনীর বিরাট আয়োজন, সাহস ও শক্তি দেখে রোমানরা ভীত হয়ে পলায়ন করে। মহানবি (সা.) ২০ দিন তাবুকে অবস্থান করে মদিনা ফিরে আসেন। তাবুক অভিযানে মূলত কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি।

তাবুক অভিযানের ফলাফল : তাবুক অভিযানের ফলাফল ছিল নিম্নরূপ : 

১. বাইজান্টাইন শক্তির পতন :

তাবুক অভিযানে মুসলমানদের ইমানি দৃঢ়তার কারণে বাইজান্টাইনরা লক্ষাধিক সৈন্য নিয়েও মুসলমানদের ক্ষুদ্র বাহিনীর মোকাবিলা করতে সাহস করেনি । তারা মুসলমানদের মোকাবিলা না করে বশ্যতা স্বীকার করে নেয় । তাবুক অভিযানের মাধ্যমে বাইজান্টাইন শক্তির পতন ঘটে । বাইজান্টাইনদের এতদিনের শক্তি, ঐতিহ্য, গর্ব সব বিলীন হয়ে যায় ।

২. মহানবি (সা.)-এর বিশ্বনেতার মর্যাদা লাভ :

মহানবি (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় মোট ২৭/২৮টি যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এর মধ্যে ৯টি যুদ্ধে তিনি স্বয়ং অংশগ্রহণ করেন। তাবুক অভিযান ছিল মহানবি (সা.)-এর জীবনের সর্বশেষ যুদ্ধ। তাবুক অভিযানে বাইজন্টাইনরা মহানবি (সা.)-এর বশ্যতা স্বীকার করার মাধ্যমে তিনি দ্রুত বিশ্বনেতায় পরিণত হন ।

৩. মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম আধিপত্য বিস্তার :

তাবুক অভিযানে বাইজান্টাইন শক্তির পতন ঘটে। এর আগে মুতার যুদ্ধে রোমানদের পতন হয়। বাইজান্টাইন ও রোমান এ দুই বৃহৎ শক্তির পতন ঘটলে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের বাধা দেওয়ার মতো আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট থাকে না, ফলে মুসলমানরা এ অঞ্চলের একক শক্তিতে পরিণত হয় ।

৪. আয়লার শাসকের বশ্যতা স্বীকার:

তাবুক অভিযানে বাইজান্টাইনদের পতন হলে আয়লার খ্রিস্টান শাসক মুসলমানদের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। সে মুসলমানদের বার্ষিক করদানে সম্মত হয় । এবং পরবর্তীতে কোন আক্রমণ ও বিদ্রোহী মনোভাব পোষণ করবেনা বলে চুক্তি স্বাক্ষর করে। 

৫. দুমাতুল জান্দালের শাসকের বশ্যতা স্বীকার :

দুমাতুল জান্দালের খ্রিস্টান শাসক সর্বদা মুসলমানদের বাধা দিত। তাবুক অভিযানের পর কয়েকটি ইহুদি ও খ্রিস্টান বসতি মুসলমানদের দখলে আসে এবং দুমাতুল জান্দালের খ্রিস্টান শাসক মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়ে মুচলেকা প্রদান ও করদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। এ অভিযানে খ্রিস্টান সম্রাট হিরাক্লিয়াস যুদ্ধ না করে ফিরে যাওয়ায় এটি নির্ধারিত হয় যে, মুসলিম শক্তিকে আক্রমণ করার ক্ষমতা, সাহস আর কোনো শক্তির রইল না।

৬. মুসলমানদের ত্যাগের নজরানা পেশ :

তাবুক অভিযানে মুসলমানরা তাদের ত্যাগের সর্বোচ্চ নজরানা পেশ করেন। এ যুদ্ধে হযরত আবু বকর (রা.) তাঁর সমস্ত সম্পত্তি, হযরত ওমর (রা.) তাঁর অর্ধেক সম্পত্তি, হযরত ওসমান (রা.) ১,০০০ স্বর্ণমুদ্রা, ১,০০০টি উট ও ৭০টি অশ্ব যুদ্ধ তহবিলে দান করেন। মুসলমানদের এ ত্যাগ বিশ্ব ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

উপসংহার :

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, তাবুক অভিযানের মাধ্যমে মহানবি (সা.) বাইজান্টাইনদের পরাজিত করে বিশ্ব নেতা হিসেবে নিজের আসন পাকাপোক্ত করেন। এ অভিযানের মাধ্যমে মুসলমানরা বিশ্ব নেতৃত্ব লাভের দিকে দ্রুত অগ্রসর হয় । এছাড়াও, এ অভিযানের মাধ্যমে মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের পাশাপাশি বহিঃবিশ্বে ইসলাম প্রচারের পথ সুগম হয়। এ যুদ্ধে হযরত আবু বকর (রা.) তাঁর সমস্ত সম্পত্তি, হযরত ওমর (রা.) তাঁর অর্ধেক সম্পত্তি, হযরত ওসমান (রা.) ১,০০০ স্বর্ণমুদ্রা, ১,০০০টি উট ও ৭০টি অশ্ব যুদ্ধ তহবিলে দান করে ত্যাগের যে নজরানা পেশ করেছেন তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

Post a Comment

Previous Post Next Post