মুতা যুদ্ধের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল বর্ণনা কর
ভূমিকা:
হুদায়বিয়া সন্ধির পর মহানবি (সা.) আরবের বাইরে
ইসলাম প্রচারের জন্য বিভিন্ন দেশে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে দূত প্রেরণ করেন। বিভিন্ন
দেশে দূত প্রেরণের অংশ হিসেবে মহানবি (সা.) রোমান সম্রাটের নিকটও দূত প্রেরণ করেন।
রোমান সম্রাট সোরাহবিল দূতকে মুতা নামক স্থানে হত্যা করলে ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে মহানবি
(সা.) জায়েদ বিন হারিসের নেতৃত্বে মুতা অভিযান প্রেরণ করেন । এ যুদ্ধে তিনজন
মুসলিম সেনাপতি শহিদ হওয়ার পর খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে মুসলমানরা বিজয়ী
হয়। এই যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে সর্বপ্রথম রোমান সাম্রাজ্যের পতন
ঘটে ।
মুতা যুদ্ধের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল : মুতা যুদ্ধের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল সম্পর্কে নিম্নে বর্ণনা করা হলো : মুতা যুদ্ধের কারণ : মুতা যুদ্ধের কারণসমূহ নিম্নরূপ :
১. হুদায়বিয়া সন্ধি:
মহানবি (সা.) ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কুরাইশদের
সাথে হুদায়বিয়া সন্ধি স্বাক্ষর করেন। হুদায়বিয়া সন্ধির শর্তানুযায়ী দশ বছর
যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ হয়। যুদ্ধবিগ্রহ থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে মহানবি (সা.) আরবের
বাইরে ইসলাম প্রচারে মনোযোগ দেন । আর এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন সাম্রাজ্যে ইসলামের
দূত প্রেরণ করেন। মহানবি (সা.) রোমান সাম্রাজ্যে দূত প্রেরণ করলে মুতার যুদ্ধ
সংঘটিত হওয়ার পথ সুগম হয় ।
২. ইসলামের প্রসার :
মহানবি
(সা.) হুদায়বিয়া সন্ধির পর আরবের বাইরে ইসলাম প্রচারের জন্য বিভিন্ন দেশে দূত
প্রেরণের জন্য সিদ্ধান্ত নেন। মহানবি (সা.)-এর দূতগণ অধিকাংশ দেশে সম্মানিত হন।
ফলে ইসলাম দ্রুত সারাবিশ্বে প্রসার লাভ করে। ইসলামের এ প্রসারে রোমানরা ভীত হয়ে
ইসলামকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলে মুতার যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
৩. ইহুদিদের ষড়যন্ত্র :
হুদায়বিয়া সন্ধির পর ইসলাম দ্রুত বহির্বিশ্বে প্রসার লাভ
করে। ইসলামের এই অগ্রগতি ইহুদিরা মেনে নিতে পারেনি। তারা নিজেদের অবস্থান হারানোর
ভয়ে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। যার ফলে মুতার যুদ্ধ সংঘটিত
হয়।
৪. রোমানদের ক্ষমতার দাপট :
তৎকালীন বিশ্বে রোমান ও বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য ছিল
সর্ববৃহৎ শক্তি। রোমানদের অর্থ, সম্পদ, সৈন্য সবই ছিল অন্যদের তুলনায় অনেক
শক্তিশালী রোমানরা বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করতো। রোমানরা মনে করতো তাদের হারানো কারো
পক্ষে সম্ভব নয় । কিন্তু হুদায়বিয়া সন্ধির পর ইসলাম দ্রুত সারাবিশ্বে বিকাশ লাভ
করলে রোমানরা নিজেদের ক্ষমতা হারানোর ভয়ে অস্থির হয়ে পড়ে। ফলে রোমানরা নিজেদের
ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ফলে মুতার
যুদ্ধ ত্বরান্বিত হয়।
৫. মুসলিম দূতকে হত্যা :
হুদায়বিয়া সন্ধির পর বহির্বিশ্বে ইসলাম
প্রচারের জন্য মহানবি (সা.) বিভিন্ন সাম্রাজ্যে দূত প্রেরণ করেন। অধিকাংশ সম্রাট
মুসলিম দূতকে সাদরে গ্রহণ করেন। মহানবি (সা.) হারেস বিন উমায়েরকে ইসলামের
দাওয়াতপত্র দিয়ে রোমান সম্রাটের নিকট প্রেরণ করেন। মহানবি (সা.)-এর দূত রোমান
দরবারে ইসলামের দাওয়াতপত্র নিয়ে গেলে সম্রাট সোরাহবিল তাকে বন্দি করেন। বন্দি
অবস্থায় তাকে মুতা নামক স্থানে হত্যা করে। মহানবি (সা.) মুসলিম দূত হত্যার
প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে জায়েদ বিন হারিসের নেতৃত্বে ৩,০০০ সৈন্য
সহ নিয়ে আরবের বাইরে সর্বপ্রথম মুতায় অভিযান প্রেরণ করেন।
মুতা যুদ্ধের ঘটনা:
রোমান
সম্রাট সোরাহবিল মুসলিম দূতকে সিরিয়ার সীমান্তে মুতা নামক স্থানে হত্যা করলে
প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য বাধ্য হয়ে মহানবি (সা.)-কে সর্বপ্রথম আরবের বাইরে এক
অভিযান প্রেরণ করতে হয়। ৬২৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে তার দত্তক পুত্র
জায়েদ বিন হারিসের নেতৃত্বে ৩,০০০ সৈন্যের এক বাহিনী প্রেরণ করেন। রোমের সৈন্য
সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক। মহানবি (সা.) যুদ্ধের জন্য পর পর জায়েদ বিন হারিস, জাফর বিন
আবু তালেব ও আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহাকে সেনাপতি নিযুক্ত করেন আর বলেন, এই তিনজন
শহিদ হলে তোমাদের মধ্য থেকে একজনকে আলোচনা করে সেনাপতি নির্বাচিত করবে। মুতায়
তুমুল যুদ্ধ বাধলে যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতি জায়েদ বিন হারিস, জাফর বিন আবু তালেব ও
আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা শহিদ হন। অবশেষে খালিদ বিন ওয়ালিদ মুসলমান সৈন্যদের
নেতৃত্ব গ্রহণ করলে যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হয় এবং মুসলমানরা জয়লাভ করে। যুদ্ধে
রোমান সম্রাট সোরাহবিল নিহত হয় ।
মুতা যুদ্ধের ফলাফল: মুতা যুদ্ধের ফলাফল নিম্নরূপ :
১.
বহির্বিশ্বে ইসলামের প্রসার :
৬২৯
খ্রিস্টাব্দে মুতার যুদ্ধের মাধ্যমে ইসলাম সর্বপ্রথম বহির্বিশ্বে বিশ্ব নেতৃত্বের
বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে। এ যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে মুসলমানরা বিশ্ব
নেতৃত্বের গৌরব অর্জন করে। মুতার যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে ইসলাম দ্রুত
বহির্বিশ্বে প্রসার লাভ করে।
২. রোমান সাম্রাজ্যের পতন :
৬২৯ খ্রিস্টাব্দে মুতার যুদ্ধে রোমান সম্রাট
প্রায় লক্ষাধিক সৈন্য নিয়ে মুসলমানদের ৩,০০০ সৈন্যের নিকট পরাজিত হন। ফলে রোমান
সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এতদিন ধরে তারা যে গর্ব করতো তাদের কেউ পরাজিত করতে পারবে না
সে দম্ভের পতন ঘটে। এ যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর রোমান সাম্রাজ্য আর নেতৃত্ব লাভ
করতে পারেনি।
৩. মহানবি (সা.)-এর বিশ্ব নেতৃত্ব লাভ:
মুতার
যুদ্ধ ছিল মহানবি (সা.)-এর বিশ্ব নেতৃত্ব লাভের প্রথম ধাপ। মুতার যুদ্ধের মাধ্যমে
মূলত মহানবি (সা.) আরবের বাইরে তাঁর ক্ষমতা দেখানোর সুযোগ লাভ করে। মুতার যুদ্ধে
বিজয়ী হলে বিশ্বের বিভিন্ন সাম্রাজ্য মহানবি (সা.)-এর নেতৃত্ব স্বীকার করে নেয় ।
৪. মুসলমানদের তিনজন বীর সেনাপতি শহিদ:
মুতার
যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের জন্য ব্যতিক্রমী যুদ্ধ। এযুদ্ধে মুসলমানদের প্রথম তিনজন
সেনাপতি জায়েদ বিন হারিস, জাফর বিন আবু তালেব ও আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা শহিদ হন।
যা অন্য কোনো যুদ্ধে হয়নি।
৫. খালিদ বিন ওয়ালিদের কৃতিত্ব:
মুতার
যুদ্ধে প্রথম তিনজন সেনাপতি শহিদ হলে খালিদ বিন ওয়ালিদ মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব
গ্রহণ করেন। খালিদ বিন ওয়ালিদ সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলে
যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে মুসলমানরা বিজয়ী হয়। রোমান
সম্রাট সোরাহবিল নিহত হয় খালিদ বিন ওয়ালিদের অসীম বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে মহানবি
(সা.) তাকে ‘সাইফুল্লাহ' অর্থাৎ ‘আল্লাহর তরবারি' খেতাবে
ভূষিত করেন।
৬. মুসলমানদের অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ :
মুতার যুদ্ধে বিশাল রোমান সাম্রাজ্যের পতন
ঘটিয়ে মুসলমানরা প্রচুর গনিমতের সম্পদ লাভ করেন। এই সম্পদ মুসলমানদের আর্থিক
সচ্ছলতা প্রদান করে। ফলে পরবর্তীতে তারা নিশ্চিন্তে ইসলাম প্রচার করতে পারে।
উপসংহার:
উপর্যুক্ত
আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মুতা যুদ্ধ ছিল আরবের বাইরে মুসলমানদের প্রথম
সামরিক অভিযান। এ যুদ্ধে মুসলমানরা তৎকালীন বিশ্বের পরাক্রমশালী রোমান সাম্রাজ্যের
পতন ঘটিয়েছিল। মুতার যুদ্ধে মুসলমানদের সাফল্যের কারণে মক্কার কুরাইশরা ভীত হয়ে
পড়ে। ফলে পরবর্তী বছর অর্থাৎ ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মহানবি (সা.) প্রায় বিনা বাধায়
মক্কা বিজয় করেন । তাই বলা যায়, মুতা যুদ্ধ মুসলমানদের মক্কা বিজয়কে সহজ করে
দিয়েছিল। এ যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের ফলে বহির্বিশ্বে ইসলাম দ্রুত বিকাশ লাভ
করে।