সমাজ সংস্কার, অর্থনৈতিক সংস্কার, প্রশাসক ও বিশ্ব শান্তির দূত হিসেবে হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর।

সমাজ সংস্কার, অর্থনৈতিক সংস্কার, প্রশাসক ও বিশ্ব শান্তির দূত হিসেবে হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর।

সমাজ সংস্কার, অর্থনৈতিক সংস্কার, প্রশাসক ও বিশ্ব শান্তির দূত হিসেবে হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর: 

 

ভূমিকা:

মহানবি (সা.) আরবের প্রচলিত সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। এছাড়াও প্রশাসন ব্যবস্থার সংস্কারও অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্র ব্যবস্থায়  সুশাসন নিশ্চিত করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। মহানবি (সা.)-এর আবির্ভাবের সময় আরবের সমাজব্যবস্থা ছিল হিংসা, বিদ্বেষ ও রেষারেষিতে ভরপুর। মহানবি (সা.) শতধা বিভক্ত আরবের সমাজব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সাধন করে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। মহানবি (সা.) শাসনকার্যের সুবিধার্থে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশাসন কাঠামো চালু করেন। ফলে আরবে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। আজকের আলোচ্য প্রবন্ধে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স) এর সমাজ সংস্কার, অর্থনৈতিক সংস্কার, প্রশাসন ব্যবস্থায় সংস্কার এবং বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার কার্যক্রম বিশধভাবে আলোকপাত করা হবে। 

 

সমাজসংস্কারক হিসেবে মুহম্মদ (সা.)-এর কৃতিত্ব:

 

সমাজসংস্কারক হিসেবে মুহম্মদ (সা.) -এর কৃতিত্ব নিম্নরূপ: 


১. মানবতার ভিত্তিতে সমাজগঠন:


মহানবি (সা.) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজসংস্কারক। সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে তিনি যে এক উন্নত ও আদর্শ সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন করেন পৃথিবীর ইতিহাসে তার আর কোনো নজির নেই। তিনি আভিজাত্যের গৌরব ও বংশ মর্যাদার মূলে কুঠারাঘাত করেন । মানুষে মানুষে সকল প্রকার অসাম্য ও ভেদাভেদ দূর করে ন্যায়ের ভিত্তিতে সমাজ গঠন করেন। খুন খারাবি, মদ্যপান, জুয়াখেলা, সুদপ্রথা এবং সব ধরনের অন্যায় ও ব্যভিচার, শিশুকন্যা হত্যা ও নারীর অপমানকর সকল প্রকার কাজকে তিনি দৃঢ়হস্তে বন্ধ করেছিলেন। তিনি ঘোষণা করেন সব মানুষ সমান, মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও উৎকৃষ্ট সে ব্যক্তি যিনি মানুষের সর্বাধিক কল্যাণকামী । তিনি আভিজাত্যের গৌরব, কৌলীন্য প্রথা, বংশমর্যাদা ইতাদি দূর করে ন্যায়ভিত্তিক সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তিনি সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য বলেন, "কোনো আরব অনারবের ওপর মর্যাদাবান নয়, যেমন কোনো অনারব আরবের ওপরও নয়। মহানবি (সা.) সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্বের বলবৎ জোর যার মুলুক তার' নীতি পরিহার করার জন্য যেসব সাম্যভিত্তিক গঠনমূলক পদক্ষেপ নেন তার ফলস্বরূপ সমাজের মধ্যে ঘটমান খুন খারাবি, মদ্যপান, জুয়াখেলা, সুদপ্রথা এবং সর্বপ্রকার অন্যায়, অবিচার, শিশুকন্যা হত্যা ইত্যাদি সামাজিক অনাচার দৃঢ় হস্তে দমিত হয়েছিল ।


২. নারীর মর্যাদা প্রদান:


জাহেলি যুগে নারীদের কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিল না। তারা শুধু ভোগের সামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হতো। মহানবি (সা.) নারীদের মর্যাদা প্রদানের জন্য পুরুষদের ন্যায় তাদের সমান অধিকার প্রদান করেন। সে সময় পিতৃপ্রধান সমাজ প্রতিষ্ঠা করলেও সমাজে যাতে নারী জাতির মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত হয় সে বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন। পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, স্ত্রীর ওপর তোমাদের যেরূপ অধিকার আছে, স্বামীর ওপর স্ত্রীরও তেমনি অধিকার আছে। জাহেলি যুগে আরবে নারীদের কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিল না। মহানবি (সা.) নারীদের সামাজিক মর্যাদা দানের জন্য মা হিসেবে নারীদের মর্যাদা প্রদান করেন। মহানবি (সা.) ঘোষণা করেন, মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত। জাহেলি যুগে নারীদের সামাজিক কোনো স্বীকৃতি ছিল না। পুরুষরা নিজেদের ইচ্ছামতো নারীদের ভোগ করতো, কিন্তু তাদের স্ত্রীর মর্যাদা দিত না। মহানবি (সা.) বিবাহ ও পরিবার আইন সংশোধন করে নারীদের সহধর্মিনীর আসনে অধিষ্ঠিত করেন । তিনি তাদেরকে পৈতৃক সম্পত্তি ও মৃত স্বামীর সম্পত্তি ভোগদখলের এবং বিবাহে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রদান করেন ।

 

৩. কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর রহিতকরণ:


আরবে দারিদ্র্য ও লজ্জার ভয়ে শিশুকন্যা হত্যার প্রচলন ছিল। মহানবি (সা.) আরবের এ শিশুকন্যা হত্যার জঘন্য প্রথা বন্ধ করেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, তোমরা দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের শিশুদের হত্যা করো না। তিনি নারীদের সামাজিক মর্যাদা দানের জন্য কন্যাসন্তানের জন্মকে অভিশাপ হিসেবে না দেখার জন্য আরববাসীদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যার প্রথম সন্তান মেয়ে। এছাড়া তিনি নারীদের জন্য. পর্দাপ্রথা চালু করে পরকীয়া, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, ব্যভিচার দূর করে একটি সুন্দর সমাজ গঠনের মাধ্যমে নারীদের সমাজে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন ।

 

৪. দাসপ্রথার উচ্ছেদ:


জাহেলি আরবে ঘৃণ্য দাসপ্রথার প্রচলন ছিল । মহানবি (সা.) সকল মানুষকে সমান মর্যাদা দানের জন্য দাসপ্রথার বিলোপসাধন করেন। তিনি দাসদের সাথে ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ দেন। দাসপ্রথার বিলোপসাধনের জন্য তিনি স্বীয় পালকপুত্র জায়েদকে সেনাপতি ও বেলালকে মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। জাহেলি যুগের মনিবগণ দাসদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতেন। দাসদের কাজ ছিল সূর্যোদয় হতে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পরিশ্রম করা। তাদের কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিল না। মনিবের ইচ্ছামতোই তাদের কাজ করতে হতো। দাসীরা মনিবের গোলাম হিসেবে কাজ করতো। দাসদাসীদের বিবাহ, জীবন মৃত্যু প্রভুর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করতো। মহানবি (সা.) দাসদাসীদের মুক্তিদানের জন্য  উৎসাহ প্রদান করে ঘোষণা করেন, গোলামকে আজাদি দানের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কাজ আল্লাহর কাছে আর কিছুই নেই। তিনি মনিবদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা যা খাবে, যা পরবে, দাসদাসীদেরও তাই খেতে ও পরতে দিবে।

 

মহানবি (সা.)-এর অর্থনৈতিক সংস্কার:


জাহেলি যুগে কোনোরূপ সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল না। বেশিরভাগ লোক সুদ, লুটতরাজ, পশুপালন করে জীবিকানির্বাহ করতো। প্রাচীন আরবে ব্যাপক হারে সুদপ্রথা চালু ছিল । ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে। মহানবি (সা.) সুদপ্রথা বিলোপ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক বিপ্লবাত্মক সংস্কার সাধন করেন। ফলে আরবে এক অর্থনৈতিক বিপ্লব সূচিত হয়। মহানবি (সা.) তাঁর অর্থনৈতিক বিপ্লবের জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন । মহানবি (সা.) জাহেলি যুগের সুদপ্রথা বিলোপ করে রাষ্ট্রীয় আয় ও ব্যয়ের খাত নির্দিষ্ট করেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মহানবি (সা.)-এর সংস্কার নিম্নে আলোচনা করা হলো:


১. সুদপ্রথা রহিতকরণ:


জাহেলি যুগে আরবে উচ্চহারে সুদপ্রথার প্রচলন ছিল। ফলে এক শ্রেণির লোক ধনী হতো, আর অধিকাংশ লোক দরিদ্র হতো। ফলে সমাজে ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। মহানবি (সা.) এই সুদপ্রথার বিলোপসাধন করেন। সুদপ্রথা রহিত হওয়ার ফলে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় । দরিদ্ররা সুদের হাত থেকে রক্ষা পায় ।


২. ব্যবসার প্রসার:


জাহেলি আরবে অধিকাংশ মানুষ পশুপালন কিংবা লুটতরাজ করে জীবিকানির্বাহ করতো । তাছাড়া চড়া হারে সুদ আদায় করে কিছুলোক সম্পদশালী হয়ে ওঠে। মহানবি (সা.) আরবের লোকদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সুদকে হারাম করেন। আর মানুষের উন্নত জীবনযাপনের জন্য ব্যবসায় বাণিজ্যকে উৎসাহিত করেন। তিনি ঘোষণা করেন, রিজিকের ১০ ভাগের ৯ ভাগ ব্যবসাতে রয়েছে'।


৩. অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা:


মহানবি (সা.) ধন বৈষম্য দূরীভূত করে সঞ্চয় ও বণ্টনের সামঞ্জস্যবিধান করেন। ধনীদের সম্পদে তিনি গরিবদের জন্য অংশ নির্ধারণ করেন। তাছাড়া রাষ্ট্রের সম্পদে জনসাধারণের অধিকার ও ভোগ নিশ্চিত করেন। ফলে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় ।

 

৪. বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠা:


মহানবি (সা.) রাষ্ট্রীয় সম্পদ সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করার জন্য বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠা করেন। বায়তুলমালে রাষ্ট্রের সব আয় ও ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষিত হতো। বায়তুলমালের মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রের সব ব্যয় নির্বাহ করতেন ফলে রাষ্ট্রে সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিকাশ লাভ করে ।

 

৫. রাজস্ব আয়ের উৎস:


হযরত মুহম্মদ (সা.) ধন বৈষম্য দূর করে সঞ্জয় ও বণ্টনে সামঞ্জস্যবিধান করেন। প্রকৃত অর্থে তিনি ধনবাদী ও পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূলে আঘাত হানেন। তিনি মুসলমানদের নীতি সম্মত উপায়ে ধনার্জন করার এবং সদকা ও জাকাতের মাধ্যমে সে সম্পদের কিছু অংশ গরিবের মধ্যে বিতরণ করার জন্য কড়া নির্দেশ দেন। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পদে যাতে জনসাধারণের অধিকার ও ভোগ করার সুযোগ সুবিধা থাকে তা বিবেচনা করে তিনি পাঁচ প্রকার রাজস্বের প্রবর্তন করেন। যথাঃ


ক. জাকাত:


জাকাত হলো ধনীদের সম্পদে গরিবের অধিকার। ধনীদের দেয় দারিদ্র্য কর যা নিয়মানুযায়ী গরিবদের মধ্যে বণ্টন। এবং যুদ্ধ ও শাসনকার্যে ব্যয় করা হতো। জাকাত নগদ অর্থ, সোনা, রুপা, উট, ভেড়া, মেষ, ছাগল, গরু-মহিষ ও ব্যবসায়িক সম্পদে ধার্য করা হতো। কারো নিকট ঋণ ও নিজ পরিবারের ভরণপোষণ বাদে এই তোলা স্বর্ণ বা টু তোলা রৌপ্য বা সমপরিমাণ অর্থ যদি এক বছর স্থায়ী থাকে তার ওপর জাকাত ফরজ হয়। মেষ ও ছাগলের নিসাব ৪০টি, গরু-মহিষের নিসাব ৩০টি। কারো নিকট উল্লিখিত পরিমাণ অর্থসম্পদ এক বছর স্থায়ী থাকলে তাকে শতকরা ৮% হারে জাকাত প্রদান করতে হয় ।


খ. গনিমত:


গনিমত হলো যুদ্ধলব্ধ সম্পদ। যথা: অশ্ব, উট, রসদ-পণ্য, অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধবন্দি ইত্যাদি! পবিত্র কোরআনে বর্ণিত নিয়মানুযায়ী ভাগ মুজাহিদদের মধ্যে বণ্টন এবং বাকি ভাগ রাজকোষ বা বায়তুলমালে জমা দিতে হয়।


গ. খারাজ:


খারাজ ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমদের ওপর ধার্যকৃত কৃষি কর। অমুসলিমদের তাদের জমিতে উৎপাদিত ফসলের অংশ খারাজ হিসেবে ইসলামি কোষাগারে জমা দিতে হতো ।


ঘ. জিজিয়া:


জিজিয়া ছিল ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমদের নিরাপত্তা কর। অমুসলিমরা ইসলামি রাষ্ট্রে নিরাপদে বসবাস করতো। তাদের জানমালের নিরাপত্তা ইসলামি রাষ্ট্র প্রদান করতো। বিনিময়ে তাদের মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানকে জিজিয়া বা নিরাপত্তা কর প্রদান করতে হতো। জিজিয়া বা নিরাপত্তা কর ছিল মাথাপিছু এক দিনার।


ঙ. আল ফাই:


ইসলামি রাষ্ট্রে মহানবি (সা.) পতিত জমি আবাদ করার জন্য উৎসাহ প্রদান করতেন। এ পতিত জমি সরকারি সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হতো। আর এই রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি থেকে আদায়কৃত অর্থ আল ফাই নামে পরিচিত ছিল। উপর্যুক্ত আয়ের উৎস ছাড়াও সদকা নামে ইচ্ছাধীন এক প্রকার আয়ও রাষ্ট্রের আয় ছিল। সদকার নির্দিষ্ট কোনো পরিমাণ ছিল না। ব্যক্তি তার ইচ্ছানুযায়ী সদকা করতে পারত।


৬. ব্যয়ের খাত:

মহানবি (সা.) অর্থনৈতিক সংস্কার সাধনের মাধ্যমে যেমন রাষ্ট্রের আয়ের উৎস নির্ধারণ করেন, তেমনি ব্যয়ের খাতও নির্দিষ্ট করে দেন। মহানবি (সা.)-এর বায়ের খাতসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো :


ক. সমতার ভিত্তিতে বণ্টন:


মহানবি (সা.) তাঁর রাষ্ট্রের বিভিন্ন উৎস থেকে আদায়কৃত অর্থসমূহ নির্ধারিত হারের ভিত্তিতে জনসাধারণের মাঝে সমতার ভিত্তিতে বণ্টন করতেন ।


খ. ভাতা প্রদান:


মহানবি (সা.) আদায়কৃত রাজস্ব থেকে রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের জন্য সমানহারে ভাতা প্রদান করতেন। ফলে প্রত্যেকে সমান নাগরিক সুবিধা ভোগ করতে পারত ।


গ. প্রশাসন পরিচালনায় ব্যয়:


মহানবি (সা.) বিভিন্ন উৎস থেকে আদায়কৃত রাজস্ব রাজ্যের প্রশাসনিক কাজ পরিচালনায় ব্যয় করতেন। তিনি বিভিন্ন প্রদেশে ওয়ালি নিয়োগ করতেন। এছাড়া অন্যান্য প্রশাসন পরিচালনার জন্য রাজকর্মচারী নিয়োগ দিতেন। এসব কর্মচারীদের বেতন তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ব্যয় করতেন।


ঘ. ফকিরদের সাহায্য প্রদান:


মহানবি (সা.) জাকাত ও সদকা থেকে প্রাপ্ত অর্থ ফকির অর্থাৎ যাদের সামান্য পরিমাণ অর্থ রয়েছে তাদের প্রদান করতেন ।


ঙ. মিসকিনদের অর্থ প্রদান:


মিসকিন অর্থাৎ যাদের কোনো সম্পদই ছিল না। মহানবি (সা.) জাকাত ও সদকা থেকে প্রাপ্ত অর্থ মিসকিনদের মাঝে বণ্টন করতেন।


চ. মুসাফিরদের সাহায্য প্রদান:


মুসাফির অর্থাৎ যারা ভ্রমণে এসে অর্থসম্পদ শেষ করে ফেলতেন, তাদের সাহায্য করার জন্য মহানবি (সা.) জাকাত ও সদকা থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যয় করতেন।


ছ. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে সাহায্য প্রদান:


সমাজে যারা ঋণগ্রস্ত ছিল তাদের ঋণ পরিশোধের জন্য মহানবি (সা.) জাকাত ও সদকা থেকে অর্থ সাহায্য করতেন।


জ. নওমুসলিমদের অর্থ প্রদান:


মহানবি (সা.) ইসলামের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য জাকাত ও সদকা থেকে নওমুসলিমদের অর্থ প্রদান করতেন। ফলে মানুষ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতো ।


ঝ. দাস মুক্তির জন্য:


তৎকালীন আরবে ভয়াবহ দাসপ্রথার প্রচলন ছিল। দাসপ্রথার উচ্ছেদের জন্য মহানবি (সা.) জাকাত ও সদকা থেকে প্রাপ্ত অর্থ দাসদের মুক্তির জন্য ব্যয় করতেন । 


ঞ. যুদ্ধের জন্য অর্থ ব্যয়:


মহানবি (সা.) যুদ্ধের জন্য অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় ও মুজাহিদদের সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য ইসলামি রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে সম্পদ ব্যয় করতেন।


ট. বিচার পরিচালনা:


মহানবি (সা.) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন প্রদেশে বিচারক নিযুক্ত করতেন। বিচারকরা যাতে নিরপেক্ষভাবে বিচার পরিচালনা করতে পারেন সেজন্য তিনি বিচারকদের রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ প্রদান করতেন ।


উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মহানবি (সা.) রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের সংস্কার সাধনসহ অথনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেন। মহানবি (সা.)-এর রাজস্ব সংস্কারের মাধ্যমে আরবে অর্থনৈতিক ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয় । কুসীদ প্রথায় জর্জরিত বৈষম্যমূলক আরব সমাজ মহানবি (সা.)-এর অর্থনৈতিক সংস্কার সাধনে এক সুদৃঢ় অর্থনৈতিক কাঠামোয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই মহানবি (সা.) অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।


প্রশাসক হযরত হিসেবে হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর কৃতিত্ব:


প্রশাসক হিসেবে হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর কৃতিত্ব নিম্নরূপ:


১. গোত্র প্রথার উচ্ছেদ:

জাহেলি আরবে গোত্রীয় শাসন প্রচলিত ছিল। আরবরা গোত্র প্রধানের অধীনে পরিচালিত হতো। গোত্র প্রধানের ইচ্ছানুযায়ী সব কিছু প্রচলিত হতো। মহানবি (সা.) শাসন কাঠামো সুন্দরভাবে পরিচালনা করার জন্য গোত্র প্রথার বিলোপসাধন করেন ।


২. কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠা:

জাহেলি আরবের সমাজ ছিল বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না। মহানবি (সা.) সর্বপ্রথম গোত্র প্রথার উচ্ছেদ সাধন করে আরবে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার প্রচলন করেন। মহানবি (সা.) কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করে ধর্মের আলোকে সেটা পরিচালনা করতেন।


৩. প্রশাসনিক বিন্যাস সাধন:

মহানবি (সা.) শাসন পরিচালনার সুবিধার্থে সমগ্র সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রশাসনিক ভাগে বিভক্ত করেন। প্রত্যেকটি বিভাগ শাসন করার জন্য তিনি একজন ওয়ালি বা প্রশাসক নিযুক্ত করতেন। যিনি মহানবি (সা.)-এর প্রতিনিধি হিসেবে প্রদেশে শাসন পরিচালনা করতেন ।

 

৪. সেনাপতি হিসেবে কৃতিত্ব:

মহানবি (সা.) একজন দক্ষ সেনানায়ক ছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। মহানবি (সা.)-এর প্রচেষ্টায় মুসলিম সৈন্যবাহিনী পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাহিনীতে পরিণত হয়। মহানবি (সা.) স্বয়ং ২৭/২৮টি যুদ্ধ পরিচালনা করেন। যার মধ্যে ৯টি যুদ্ধে তিনি স্বয়ং সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন ।


৫. রাজনৈতিক দূরদর্শিতা:

মহানবি (সা.) আরবের শাসনব্যবস্থা সুন্দরভাবে পরিচালনা করার জন্য শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক কূটনীতিবিদের পরিচয় দেন। মহানবি (সা.)-এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর মদিনা সনদ ও হুদায়বিয়া সন্ধি স্বাক্ষরের মাধ্যমে । মহানবি (সা.) রাজনৈতিক সংস্কারক হিসেবে তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদের আসনে অধিষ্ঠিত হন।


উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মহানবি (সা.) ছিলেন শ্রেষ্ঠ সমাজসংস্কারক । মহানবি (সা.) এক ঘুণেধরা সমাজে জন্মগ্রহণ করেন। সংস্কার কাজের মাধ্যমে মহানবি (সা.) সেই অধঃপতিত সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। এছাড়া মহানবি (সা.) গোত্রপ্রথার বিলোপসাধন করে প্রশাসনিক কাঠামোকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। তাই ঐতিহাসিকগণ মুহম্মদ (সা.)-কে শ্রেষ্ঠ প্রশাসকের পাশাপাশি সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজসংস্কারকের আসনে আসীন করেছেন।

 

জাতি গঠনকারী হিসেবে মুহম্মদ (সা.)-এর কৃতিত্ব:

নিম্নে জাতি গঠনকারী হিসেবে মহানবি (সা.)-এর কৃতিত্ব আলোচনা করা হলো:

 

১. বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা:

মহানবি (সা.)-এর আগমনের সময়ে আরবে গোত্রকলহ, ভেদাভেদ, মারামারি, হিংসা বিদ্বেষ চরম আকার ধারণ করে। মহানবি (সা.) সব ধরনের কলহ, বিবাদের অবসান ঘটিয়ে ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে সমাজ গঠন করেন। মদিনার আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে সর্বপ্রথম বিশ্বভ্রাতৃত্বের মহান আদর্শে তিনি এক সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন। ফলে এক নতুন সমাজ ও সভ্যতা আরবের বুকে এক নবযুগের সূত্রপাত ঘটায়। তিনি মুসলমান অমুসলমান এবং জাতিধর্মনির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের সহযোগিতা ও সদিচ্ছার ভিত্তিতে এক জাতি গঠন করেন। 

 

২. মানবতার ভিত্তিতে দ্বন্দ্ব কলহের অবসান:

মহানবি (সা.) ধর্মপ্রচার ও সমাজসংস্কারের পাশাপাশি একটি শক্তিশালী জাতি গঠন করেন। জাহেলি আরবে কোনোরূপ ঐক্যবোধ বা জাতীয় চেতনা ছিল না। গোত্রপ্রীতিতে তারা এত বেশি আসক্ত ছিল যে, বৃহত্তর রাষ্ট্র বা জাতি গঠনের কোনো ধারণাই তাদের মধ্যে ছিল না। তারা কলহ বিবাদে লিপ্ত থেকে বিষময় ও বিশৃঙ্খল জীবনযাপন করতো। তিনি শুধু ধর্মের মাধ্যমে প্রথমে তাদের মধ্যে সকল কৃত্রিম ভেদাভেদ ও দ্বন্দ্ব-কলহের অবসান ঘটান গোত্রীয় প্রীতির পরিবর্তে তিনি তাদেরকে মানবতাবোধের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত করে তোলেন।

 

৩. সহযোগিতার ভিত্তিতে জাতি গঠন:

মহানবি (সা.) মুসলমান অমুসলমান এবং জাতিধর্মনির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের সদিচ্ছা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে এক জাতি গঠনের চিন্তা করেন। তাঁর সে প্রচেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হয়। মদিনাতে সকল বংশ, গোত্র ও ধর্মের লোকদের সমন্বয়ে তিনি এক শক্তিশালী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন । এ উদ্দেশ্যে তিনি মদিনার ইহুদি ও খ্রিস্টানদেরকে মদিনা সনদ দ্বারা তাদের স্ব স্ব ধর্ম স্বাধীনভাবে পালনের অধিকার প্রদান করেন এবং তাদের জানমাল রক্ষারও প্রতিশ্রুতি দেন। সব ধর্মাবলম্বী লোকদের পূর্ণ নাগরিক স্বাধীনতা দান করে তিনি তাদের সমন্বয়ে এবং সদিচ্ছার ভিত্তিতে যে জাতি গঠন করেন তা অতি অল্পসময়ের মধ্যে শৌর্যবীর্যে, জ্ঞানবিজ্ঞানে ও শিক্ষা সভ্যতায় উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করে ।


৪. সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠা:

মানুষে মানুষে ভেদাভেদ মানবজাতির জন্য একটি চিরন্তন অভিশাপ। প্রাচীনকাল থেকেই মানবসমাজে এই কৌলীন্য প্রথা প্রচলিত ছিল। মহানবি (সা.) বংশগত কৌলীন্য বিলুপ্ত করেন। তিনি ঘোষণা করেন, মানুষ আদমের বংশজাত আর আদমের সৃষ্টি মাটি হতে। তাছাড়া তিনি মানুষের মধ্যে তাকওয়ার মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নিরূপণ করেছেন। এভাবে সাম্য ও মৈত্রীভিত্তিক সমাজ গঠনের ফলে মুসলিম জাতি এক শক্তিশালী জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।


৫. বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা:

মুহম্মদ (সা.)-এর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে মানবতার আদর্শ প্রচার করা। মদিনায় হিজরতের পরই তিনি মুসলিমদের ভ্রাতৃবন্ধন জোরদার করার জন্য আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করেন। এ লক্ষ্যে তিনি মদিনা সনদ প্রণয়ন করে বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বিদায় হজের ভাষণে তিনি ঘোষণা করেন, সকল মুসলিম ভাই ভাই। তিনি ধর্ম, বর্ণ ও আঞ্চলিক বৈষ্যমের ওপর জাতীয়তার ভিত্তি স্থাপন করেন। এ ভাষণে তিনি তাদের জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলকে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হতে বলেছেন । 


৬. বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা:

মহানবি (সা.) ছিলেন বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত। তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন শান্তির বাণী নিয়ে বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করতে। পরধর্মে যেমন মহানবি (সা.) ছিলেন পরম সহিষ্ণু, তেমনি পররাষ্ট্রের প্রতি তাঁর নীতি ছিল শান্তি, সমৃদ্ধি ও ভ্রাতৃত্বের । বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সাথে শান্তি ও সম্প্রীতি স্থাপনের জন্য তিনি বিভিন্ন রাজদরবারে দূত প্রেরণ করেন। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও পারস্পরিক সৌহার্দ্যের নীতিতে মহানবি (সা.) আস্থাবান ছিলেন। এই নীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি আন্তঃসাম্প্রদায়িক বিবাহকে স্বীকৃতি দেন। তিনি মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করেন ।


৭. কুসংস্কারের মূলোৎপাটন:

মহানবি (সা.) আরবে প্রচলিত ধর্মীয় কুসংস্কার মূলোৎপাটনের জন্য বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মহিলাদের বিবাহ করেন। তাঁর এই বিবাহ আন্তঃসম্প্রদায়ের বিবাহকে উৎসাহিত করাসহ সব সম্প্রদায়কে নিয়ে এক ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠনকে উৎসাহিত করে। ফলে একটি শক্তিশালী জাতি গড়ে ওঠে।


৮. ইমান ও জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধকরণ:

ঐতিহাসিক খোদাবক্স বলেন, আরবের গোত্রভিত্তিক সমাজের বিনাশ ও তদস্থলে ইসলামের ভ্রাতৃত্ব স্থাপনই মহানবি (সা.)-এর শিক্ষার প্রত্যক্ষ ফল। তিনি শুধু গোত্রভিত্তিক সমাজের বিনাশ সাধন করেননি; বরং তিনি দেশের মধ্যে বসবাসকারী সব শ্রেণির লোককে একাত্মবোধে অনুপ্রাণিত করে এক মহান আদর্শ, উদ্দেশ্য ও গন্তব্যের পথে পরিচালিত করেন। এরূপে ইমান ও জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে আরববাসী মহানবি (সা.)-এর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করেন ।


৯. মদিনা সনদ প্রণয়ন:

মহানবি (সা.) মদিনায় হিজরত করে সবাইকে নিয়ে একটি শক্তিশালী সাধারণ জাতি গঠনের চেষ্টা করেন। এজন্য তিনি মদিনার সব সম্প্রদায়কে নিয়ে সবার জন্য কল্যাণকর ও সাধারণ একটি নীতিমালার আলোকে মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন। মদিনা সনদে তিনি সব সম্প্রদায়কে নিয়ে একটি সাধারণ জাতি গঠনের কথা বলেন। এটা মহানবি (সা.)-এর এক জাতি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ।


১০. গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা:

এককথায় বলতে গেলে বিবদমান গোত্র ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ পুনর্মিলন সাধন করে মহানবি (সা.) আরবভূমিকে এক উন্নত প্রগতিশীল দেশে পরিণত করেন। বিশ্বনবি আজীবন পৌত্তলিকতার অবসানকল্পে সংগ্রাম করেন। কিন্তু তবুও তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে প্রতিমাপূজক জাতিকে ঘৃণা করতে নিষেধ করেন। এখানেই তাঁর চরিত্রের আসল কৃতিত্ব । তিনি পূর্ণ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন বলে তা সম্ভব ছিল। এসব কারণে তাঁকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী বলা হয় ।


উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মহানবি (সা.)-এর আদর্শ গঠিত আরব জাতি পরবর্তীতে সাৱা বিশ্বে নেতৃত্ব প্রদান করে। মহানবি (সা.) নিজের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে একটি বর্বর জাতিকে শক্তিশালী একটি জাতিতে পরিণত করেন। মহানবি (সা.)-এর কৃতিত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিক P. K. Hitti বলেন, মরণশীল জীবনের অতি স্বল্প পরিসরে মুহম্মদ (সা.) অনৈক্যে জর্জরিত অনমনীয় এক জনগোষ্ঠীকে এমন এক দেশে ঐক্যবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত করেন যা ইতঃপূর্বে ছিল শুধু একটি ভৌগোলিক সংজ্ঞা।

 

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর কৃতিত্ব: 

 বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর কৃতিত্ব নিম্নে আলোচনা করা হলো:


১. হিলফুল ফুজুল গঠন:


মহানবি (সা.)-এর মাত্র ১৫ বছর বয়সে ওকাজ মেলার সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে কুরাইশ ও বনু কায়েসের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মহানবি (সা.) এ যুদ্ধে কুরাইশদের পক্ষে তীর কুড়িয়ে দেন। যুদ্ধে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। এই অন্যায় যুদ্ধের ভয়াবহতা মহানবি (সা.)- এর মনে দারুণভাবে আঘাত হানে। তিনি এ ধরনের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য আরবের উদ্যমী কিছু যুবকদের নিয়ে হিলফুল ফুজুল বা শান্তি সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংঘের সদস্যরা সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য শপথ গ্রহণ করে। এটা ছিল মহানবি (সা.)-এর শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ ।


২. ন্যায় ও সত্যের প্রচার :


হযরত মুহম্মদ (সা.) বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ন্যায় ও সত্যের প্রচার করতেন। তিনি ন্যায় ও সত্যের প্রচারে একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন। মহানবি (সা.) সমাজের সকল প্রকার অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিনি অন্যায় ও অবিচার নির্মূল করে ন্যায় ও সত্যের ভিত্তিতে সমাজ গঠন করেন।

 

৩. আর্তমানবতার সেবা:


মহানবি হযরত মুহম্মদ (সা.) আর্তমানবতার সেবায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। সমাজের নির্যাতিত মানুষের মুক্তি সাধন করে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন ।


৪. অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ:


মহানবি (সা.)-এর আগমন হয়েছিল অন্যায় দূরীভূত করে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য। বিশ্বশান্তির পথে অন্তরায় হিসেবে কোনো অন্যায় কাজ হতে দেখলে মহানবি (সা.) সেটা প্রতিরোধ করতেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বদা প্রতিরোধ গড়ে তুলে মহানবি (সা.) বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।


৫. মানবতার ভিত্তিতে সমাজজীবন:


সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে মহানবি (সা.) যে এক উন্নত ও আদর্শ সমাজব্যবস্থা প্রবর্তন করেন পৃথিবীর ইতিহাসে তার নজির বিরল । তিনি আভিজাত্যের গৌরব ও বংশমর্যাদার মূলে কুঠারাঘাত করেন। মানুষে মানুষে, সকল প্রকার অসাম্য ও ভেদাভেদ দূর করে মানবতার ভিত্তিতে সমাজ গঠন করেন।


৬. মদিনা সনদ প্রণয়ন:


মহানবি (সা.) ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় হিজরত করে সেখানে বসবাসরত সব সম্প্রদায়ের মাঝে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তিনি মদিনার সমাজে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য সবার মতামতের ভিত্তিতে মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন।মদিনা সনদ প্রণয়নের মাধ্যমে মহানবি (সা.) মদিনার সব সম্প্রদায়ের মাঝে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ স্থাপন করেন। মহানবি (সা.) মদিনা সনদের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় যে উদারতার পরিচয় দেন ইতিহাসে তা বিরল।

 

৭. বিশ্বমানবের ত্রাণকর্তা:


বিশ্বমানবের ত্রাণকর্তা হিসেবে হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটেছিল । তিনি ছিলেন বিশ্বের রহমতস্বরূপ। মানব চরিত্রে যত প্রকার সদগুণ থাকতে পারে তাঁর চরিত্রে সেসব গুণ পরিপূর্ণতা লাভ করে। মহান আল্লাহ কোরআন মজিদে বলেন, হে মুহম্মদ! নিশ্চয় তুমি অনুপম চরিত্রের অধিকারী। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন সর্বোৎকৃষ্ট এবং মহাপুরুষ এবং নবিদের মধ্যে ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ।"

 

৮. ক্ষমার মূর্তপ্রতীক:


হযরত মুহম্মদ (সা.) ছিলেন ক্ষমার মূর্তপ্রতীক। প্রাণঘাতী দুশমনকেও তিনি ক্ষমা করতে দ্বিধাবোধ করেননি । মক্কা ও তায়েফ বিজয়ের সময় তিনি যে ক্ষমার আদর্শ প্রদর্শন করেন বিশ্বের ইতিহাসে তার কোনো নজির নেই। তাঁর সুন্দর, সার্থক ও নির্মল চরিত্র বিশ্ববাসীর পথপ্রদর্শক হিসেবে বিশ্বের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ঐতিহাসিক আমির আলি বলেন, এত কোমল অথচ বীরোচিত স্বভাব শুধু শ্রদ্ধাই নয়, ভালোবাসাও অনুপ্রাণিত করতো।


৯. বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা:


মহানবি (সা.) মদিনায় আনসার ও মুহাজির মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম বিশ্বভ্রাতৃত্বের মহান আদর্শে এক সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন। ফলে এক নতুন সমাজ সভ্যতা এবং আরবের বুকে নবযুগের সূত্রপাত হয়। তিনি মুসলমান অমুসলমান এবং জাতিধর্মনির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের সদিচ্ছা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে জাতি গঠন করেন ।

১০. বিশ্বশান্তির অগ্রদূত:


মহানবি (সা.) ছিলেন বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত। তিনি শান্তির বাণী নিয়ে বিশ্বশান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করতে প্রেরিত হয়েছিলেন । পরধর্মে যেমন মুহম্মদ (সা.) ছিলেন পরম সহিষ্ণু, তেমনি পররাষ্ট্রের প্রতি তাঁর বাণী "ছিল শান্তি, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের। বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সাথে শান্তি ও সম্প্রীতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন রাজদরবারে দূত প্রেরণ করেন। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও পারস্পরিক সৌহার্দের নীতিতে মহানবি (সা.) আস্থাবান ছিলেন। এই নীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি আন্তঃসাম্প্রদায়িক বিবাহকে স্বীকৃতি দেন। তিনি মানুষে মানুষে ভেদাভেদ পছন্দ করতেন না ।


১১. অসহায়ের বন্ধু:


মহানবি হযরত মুহম্মদ (সা.) একজন শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন। যুদ্ধ, হানাহানি, ঝগড়া-বিবাদ তাঁর হৃদয়কে জর্জরিত করতো। তিনি একজন শান্তিকামী ব্যক্তি হিসেবে সর্বদাই অসহায়, নির্যাতিত, নিপীড়িত ব্যক্তিদের পক্ষে কাজ করতেন। তাঁর কাছে বন্ধু, শত্রু, মুসলিম, অমুসলিম সবাই সমান সম্মান ও মর্যাদা পেত ।

 

১২. ন্যায়পরায়ণতা:


মহানবি (সা.) সর্বদা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়পরায়ণতার পরাকাষ্ঠা ব্যক্তি ছিলেন । তিনি সর্বদা অবিচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তাঁর মাঝে যেমন উদারতা, কোমলতা, ক্ষমাপ্রবণতা ছিল অন্যদিকে সত্যের জন্য কঠোরতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করার শক্তি ছিল । তিনি যেমন অনাড়ম্বর ও নির্লোভ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তেমনি আল্লাহর নির্দেশে মুসলমানদের জন্য জীবন চলার দিকনির্দেশনাও দিয়ে গেছেন। মুহম্মদ (সা.) চারিত্রিক ও মানবিক দিক দিয়ে এতটাই উজ্জ্বল ছিলেন যে, বিখ্যাত মনীষী জর্জ বার্নার্ড শ বলেন, যদি গোটা বিশ্বের ধর্ম, সম্প্রদায়, আদর্শ ও মতবাদসম্পন্ন মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে একজন শাসকের অধীনে আনা হতো, তবে একমাত্র মুহম্মদই (সা.) সুযোগ্য নেতা হিসেবে তাদেরকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করতে পারতেন। 

 

উপসংহার:

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহম্মদ (সা.) ছিলেন মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শক। মহানবি (সা.) শতধা বিভক্ত জাহেলি আরব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালান । - মহানবি (সা.) জাহেলি যুগের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে সমাজ গঠন করেন। মহানবি (সা.)-এর সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থায় সর্বদা শান্তি ও কল্যাণ বিরাজিত ছিল। তাই মহানবি (সা.)-কে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত বলা হয় ।

 


Post a Comment

Previous Post Next Post