ভূমিকা:
বাংলাদেশ একটি শান্তি প্রিয় ও বন্ধুসুলভ দেশ। ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারোর সাথে শত্রুতা নয়'—এই স্লোগান নিয়ে বাংলাদেশ বিদেশীদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। ভারত- বাংলাদেশের একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র। স্বাধীনতার সময় ভারত বাংলাদেশকে বিভিন্নভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ভারত-বাংলাদেশ এর মধ্যে বিভিন্ন রকম সমস্যা সৃষ্টি হয়। এর ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক বৈরি রূপ ধারণ করে।
কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধান করার ক্ষেত্রে
ভারতের কোন আগ্রহ নেই বললেই চলে। ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন পানি বণ্টন সমস্যাগুলো
সমাধানের ক্ষেত্র দীর্ঘায়িত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সালিশ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ তার
দাবি-দাওয়া সহ ২০১১ সালের ৩১শে ‘মেমোরিয়াল'
এর ট্রাইব্যুনালের কাছে জমা দিয়েছে। আশা করা হচ্ছে বাংলাদেশ তার অনুকূলে সঠিক বিচার
পাবে। এর ফলে সমুদ্র অঞ্চলে পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান হতে পারে।
Table of Contents
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন নদী:
বাংলাদেশ ও ভারতের সাথে নদীগুলোর গভীর সম্পর্কযুক্ত। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক মানের নদীগুলোর ভারতের নদীর সাথে সম্পর্কযুক্ত। যৌথ নদী কমিশন প্রদত্ত তথ্য মতে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪টি। বাংলা পিডিয়ার সূত্রানুসারে ভারত বাংলাদেশ অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৫টি।
এই সব নদীগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে সিলেটে ৬টি নদী, পঞ্চগড়, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে ৪টি করে, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩টি করে, সাতক্ষীরা, নবাবগঞ্জ, মেহেরপুর, দিনাজপুর, নবাবগঞ্জ, নওগাঁ, শেরপুর, কুমিল্লা ৩টি করে, ফেনীতে ২টি, যশোর, লালমনিরহাট, নেত্রকোনা ও রাঙামাটিতে ১টি করে নদী আছে।
পানি বণ্টন
সমস্যা:
বাংলাদেশ একটি নদী মাতৃক দেশ। এ দেশের ছোট বড় অনেক নাম না জানা নদী আছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানের নদীগুলোর সাথে ভারতের নদী সাথে নিবিড় সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশের বড় বড় নদীগুলো ভারতের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ একটি ছোট রাষ্ট্র এবং শক্তির দিক দিয়েও কম শক্তিশালী রাষ্ট্র। আর এই সুযোগে ভারতের ভিতর দিয়ে আসা আন্তর্জাতিক নদীগুলোর প্রবাহ বন্ধ করে দিচ্ছে ভারত সরকার শুধু মাত্র তাদের সুবিধার জন্য । ফলে বাংলাদেশের ছোট বড় অনেক নদীর প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
অভিন্ন নদীর পানি
বণ্টন সমস্যা:
বাংলাদেশ ও ভারতের পানি বণ্টন সমস্যার দীর্ঘ দিনের ইতিহাস আছে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ৫৭টি নদীর মধ্যে অধিকাংশ নদী ভারতের ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাংলাদেশ কোন না কোনা ভাবে নদীর ক্ষেত্রে ভারতের কাছে নির্ভরশীল ভারত ইচ্ছা করলেই বিভিন্ন নদীর প্রবাহের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম।
এই সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৭২ সালে যৌথ নদী
কমিশন গঠিত হয়। কিন্তু ১৯৭৪ সালে ফারাক্কা ব্যারেজ চালু হলে বাংলাদেশে পানি প্রবাহের
মাত্রার বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফলে জলাধারের উৎস নেপাল হওয়ার কারণে বাংলাদেশ পরবর্তীতে
ভারতের সাথে নেপালকে নিয়েও যৌথ নদী কমিশনের প্রস্তাব দিলে তা বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৭৫
সালে পানি বণ্টনে দুই দেশের মধ্যে একটি স্বল্প মেয়াদী চুক্তি হয়। কিন্তু দিন দিন
পানি সমস্যার সংকট ঘনীভূত হতে থাকে।
দুই দেশের মধ্যে এ বিষয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা চললেও বাংলাদেশ এ থেকে লাভবান হয়েছে খুব নগন্যই। পানি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লিীতে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে ৩০ বছরের একটি পানি বণ্টন চুক্তি হয়। কিন্তু বিগত ৭ বছরে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিসাব বুঝে পায়নি। জুন-২০০৪ ভারতে কংগ্রেসের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হলে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান পশ্চিম বঙ্গের বাঙালি কংগ্রেস নেতা প্রিয়রঞ্জন দাস মুন্সি।
দায়িত্ব
গ্রহণ করার পরই মি. মুন্সী বাংলাদেশের পানি সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। অতঃপর ২০০৫ সাল পর্যন্ত
উভয় পক্ষের মধ্যে বিভিন্ন নদীর পানির সুষ্ঠু বণ্টন প্রশ্নে সচিব পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা
হয়েছে কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের
সাথে আলোচনা করে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।
ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প :
আগামী
৫০ বছরের ক্রমবর্ধমান পানির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র এবং এর অববাহিকার
সকল নদ-নদীর পানি বাঁধ, জলাশয় ও সংযোগ খালের মাধ্যমে প্রত্যাহার করে ভারতের উত্তর
ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে পানি সরবরাহের জন্য ভারত যে মহাপরিকল্পনা নিয়েছে তা আন্তঃনদী
সংযোগ প্রকল্প নামে পরিচিত। পরিকল্পনা অনুযায়ী বর্ষার সময়ের অতিরিক্ত সঞ্চিত পানি
শুকনো মৌসুমে বিভিন্ন স্থানে কৃষি ও অন্যান্য কাজের জন্য সরবরাহ করা হবে। এতে একদিকে
বন্যার যেমন রোধ করা যাবে, তেমনি খরার আশঙ্কা ও দুর হবে বলে ভারতীয় কর্মকর্তারা মনে
করেছেন।
বাংলাদেশ একটি ভাটির দেশ হিসেবে উজানের নদীগুলোর উপর নির্ভরশীল।
তদুপরি, ভারত তার এ প্রকল্প বাস্বায়ন করলে ভারত থেকে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে এমন সব
নদীর স্বাভাবিক গতিরোধ করা হলে বাংলাদেশের নদীসমূহে পানি যেমন কমবে তেমনি পরিবেশের
উপর প্রচণ্ড বিরূপ প্রভাব পড়বে। নদীতে পানি
কমলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আরো নেমে যাবে। সে ক্ষেত্রে আর্সেনিক সমস্যা বাড়বে।
এছাড়া নদীতে পানি কমলে মাছের উৎপাদন ভীষণভাবে ব্যাহত হবে। বাংলাদেশের উত্তরের বিশাল এলাকা মরুময় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সহজ কথায়, আন্তঃনদী প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারতের জন্য যেমন সুখের দিন শুরু হবে তেমনি বাংলাদেশের জন্য দুঃখের দিন শুরু হবে। বাংলাদেশ বিগত ভারত সরকারকে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু এনডিএ জোট সরকার সেই অনুরোধে কর্নপাত করেনি। বর্তমান ক্ষমতায় আসীন কংগ্রেস জোট সরকার বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কোন কাজ করবে না।
১. টিপাইমুখ বাঁধ:
সম্প্রতি টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে দেখা দিয়েছে দ্বিপাক্ষিক দ্বন্দ্ব। বাংলাদেশের জন্য টিপাইমুখ বাঁধ একটি মরণফাঁদ হলেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হতে কোন প্রকার জোরালো আপত্তি উত্থাপন করা হয়নি। টিপাইমুখ বাঁধের ফলে-
ক.
ভারতের বহুমুখী পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প গড়ে উঠবে। এর দ্বারা বিপুল পরিমাণ পানি
উৎপাদন করে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মনিপুর ও মিজোরামে সরবরাহ করবে। এর ফলে যে, কৃত্রিম
লেক তৈরি হবে তাতে হাজার হাজার টন মৎস উৎপাদন হবে। শুষ্ক মৌসুমে ভারত তাদের ত্রিপুরা,
মিজোরাম ও মনিপুরে সেচ সুবিধা সম্প্রসারিত করতে পারবে বাঁধের মাধ্যমে বর্ষার বন্যা
নিয়ন্ত্রণ তাদের জন্য সুবিধা হবে।
খ. বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, টিপাইমুখ বাঁধ একটি মরণ ফাঁদ। বরাক
নদীতে যদি বাঁধ পড়ে প্রকৃতপক্ষে সুরমা, কুশিয়ারা ও মেঘনার আশপাশে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের
মুখে পড়বে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বাঁধ ফারাক্কা বাঁধের চেয়েও মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়
ডেকে আনবে। বাঁধ নির্মাণ হলে, ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রাকৃতিক
বিপর্যয় হবে মরুভূমির সমতুল্য, ফলে, সিলেটের ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ, ঢাকা অঞ্চলের ৬০
লাখ মানুষ সরাসরি পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।পর্যায়ক্রমে পুরোদেশ এই আগ্রাসনের
মুখে পড়বে।
২. তিস্তা বাঁধ প্রকল্প:
তিস্তা
বাঁধ পানির অভাবে অকেজো হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। শুকনো মৌসমের শুরুতে তিস্তা এখন ধু-ধু
বালুচর। পানির অভাবে তিস্তা নদীর আশপাশের এলাকার
পানি অনেক নিচে নেমে গেছে। বাংলাদেশে ও ভারতের
মধ্যে তিস্তা নদীর পানি বন্টনে কোন চুক্তি আগে হয় নি। ভারত তিস্তা নদীর গজল ডাঙ্গার একতরফা পানি প্রত্যাহারের
কারণে প্রকল্পে পানির ঘাটতি দেখা দিয়েছে স্বাভাবিকভাবে।
তাই শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকেনা কিন্তু বর্ষাকালে প্রবল পানির
প্রবাহে বাঁধ ও আশপাশের অঞ্চল ঝুঁকির মুখে পড়ে। তখন ৪৪টি গেট খুলে রেখেও পানি সরানো
কঠিন হয়ে পড়ে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার
পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালে মন্ত্রী পর্যায়ে এক বৈঠকে তিস্তার পানি
৩৬ ভাগ বাংলাদেশ, ৩৯ ভাগ ভারত এবং ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষণ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া
হয়।
কিন্তু সিদ্ধান্তে তিস্তার পানি প্রবাহের পরিমাণ, কোন কোন
জায়গায় ভাগাভাগি হবে এরকম কোন বিষয় উল্লেখ না থাকায় তা আর আলোর মুখ দেখেনি। শুষ্ক মৌসুমে
তিস্তা নদীর উজানে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করার বিশাল আর্থ-সামাজিক সম্ভাবনাময়
তিস্তা বাঁধ প্রকল্প অকেজো হয়ে পড়েছে। প্রতি বছর পানির অভাবে এই অঞ্চলে কৃষি কাজ
ব্যাহত হচ্ছে। এমনকি বর্ষাকালে যথেষ্ট বর্ষা না হলে পানির অভাব দেখা দেয়।
সারা
বছর পানি সরবরাহ নিশ্চিত করে বিভিন্ন ফসলের চাষ সম্ভব করে তোলা ছিল এই সেচ প্রকল্পের
উদ্দেশ্য। প্রধান এই বাঁধের আওতায় ৩টি ফসল উৎপাদনের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ভারতের
পানি পত্যাহারের কারণে তিস্তা বাঁধ এখন অনেকটাই অকার্যকর।
৩. ফারাক্কা ব্যারেজ:
ফারাক্কা
হল পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার একটি শহর। ১৯৭৪ সালে ভারত গঙ্গা নদীর উপর
ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ করে । সাড়ে তিন দশক ধরে নদী প্রবাহে হস্তক্ষেপ পানি প্রত্যাহারের
ফলে পদ্মা এখন প্রায় মৃত নদী। বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর- পশ্চিমাঞ্চলের জীবন ধারা
আটকে যাচ্ছে ফারাক্কার ক্ষীণ ধারায়। ভারতের উদ্দেশ্য ছিল গঙ্গা নদী বাঁধ দিয়ে গঙ্গার
পানি প্রত্যাহার করে ভাগিরথী ও হুগলী নদীতে নিয়ে যাওয়া।
ভারত চিঠির মাধ্যমে বাংলাদেশকে জানায় যে, ফারাক্কা ব্যারেজের
সাথে ভাগিরথী হুগলি নদীর সেই সংযোগ খাল করা হয়েছে সেই ফিডার খালটি চালু করে পরীক্ষা
করে দেখা দরকার। বাংলাদেশ ও ভারতের সমঝোতায় ভারত ৪১ দিন ফিডার খাল দিয়ে গঙ্গা থেকে
নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি প্রত্যাহার করবে। সেই অনুযায়ী ভারত প্রত্যাহার শুরু করে। কিন্তু
আর কখনো শেষ হয় নাই । এভাবে পরীক্ষার নামে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করে।
ফারাক্কা নদীর ফলে, ভারত এক তরফা ভাবে পানি গ্রহণ করছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফারাক্কা পানির সংকটে বালিয়াকান্দির পাঁচটি
নদীর প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রমত্তা গড়াই, চন্দনা, হড়াই, চিত্রা ও পুষম্বলী নদী
ফারাক্কার হিংস্র ছোবলে আজ নাব্য হারিয়ে ধু ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে। একটি নদী এখন
শুধুই ইতিহাস।
১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর থেকে এই নদী গুলোর মরণদশা শুরু হয়েছে। নদী আছে কিন্তু পাখি নেই। এই নদী অঞ্চলের পরিবেশ, কৃষক ও জেলেদের জীবন-জীবিকায় নেমে এসেছে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়। একতরফা পানি প্রত্যাহার করে ভারত তাদের বন্দর, কৃষি, সেচ বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা সচল রাখলেও এদেশের কৃষি,বন্দর সেচ, নৌপথ পরিবেশ ও জীবন- জীবিকায় নেমে এসেছে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পানি বণ্টন সমস্যা সমাধানের উপায়:
বাংলাদেশ
ও ভারতের মধ্যে পানি বণ্টন সমস্যার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। পানি বণ্টন সমস্যাকে কেন্দ্র
করে দুই দেশের মধ্যের সম্পর্ক কিছুটা হলেও বিঘ্নিত ঘটে। বিভিন্ন কারণে ভারত-বাংলাদেশ
অভিন্ন পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান অত্যন্ত প্রয়োজন। দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ
সম্পর্কের জন্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি স্থাপনের জন্য পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান
হওয়া জরুরি। পানি বণ্টন সমস্যা সমাধানের জন্য নিয়ে কিছু রূপরেখা উল্লেখ করা হলো:
১.
আন্তর্জাতিক নদী আইন বাস্তবায়ন:
আন্তর্জাতিক
নদী আইন মান্য করার মাধ্যমে ভারত- বাংলাদেশ পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
এই আইন মান্য করার ক্ষেত্রে ভারতকেই আগে এগিয়ে আসতে হবে। কেননা ভারত আন্তর্জাতিক আইন
না মেনে আন্তর্জাতিক নদীতে বাঁধ নির্মাণ ও নদীগুলোর একচেটিয়ে ব্যবহার করছে। এই সমস্যা
সমাধানের জন্য ভারতকে আন্তর্জাতিক আইন মান্য করা উচিত।
২.
গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির শর্ত মান্য করা:
৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর হয় ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে পানি বণ্টন সমস্যার বাস্তবায়নের জন্য নয়াদিল্লিতে এই চুক্তি বাস্তবায়ন হয়। এর চুক্তির মূল্য উদ্দেশ্য ছিল উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে পানি বণ্টন করা।
চুক্তিতে নির্ধারিত হয় যে, উভয় পক্ষের সম্মতিতে ১ জানুয়ারি
থেকে ৩১মে পর্যন্ত সময়ে দু'দেশের মাঝে গঙ্গার পানি ভাগাভাগি হবে এবং ভারত নদীটির জলপ্রবাহের
মাত্র গত ৪০ বছরের গড় মাত্রায় বজায় রাখার চেষ্টা করবে। বাংলাদেশ কমপক্ষে ৩৫ হাজার
কিউসেক পানি পায়নি। ভারত এই চুক্তি মানেনি। ফলে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে
প্রতি বছর বঞ্চিত হচ্ছে। গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি অনুসরণের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে
পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
৩.
কূটনৈতিক তৎপরতায় গুরুত্ব দেওয়া:
কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক প্রেরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের পানি বণ্টন সমস্যার কথা তুলে ধরতে পারে । কূটনৈতিকভাবে ভারতের উপর বিভিন্ন দেশের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চাপ সৃষ্টি করতে হবে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, জাপান, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের কাছে সংশ্লিষ্ট সমস্যার কথা তুলে ধরতে হবে। ফলে তারা ভারতকে চাপ দিবে সমস্যা সমাধানের জন্য। এছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রী পর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক বৈঠকের আয়োজন করা যেতে পারে।
৪. অর্থনৈতিক কূটনীতি:
ভারত-বাংলাদেশ পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান না করে ভারত বরং
উল্টো আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বা গ্রহণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এই আন্তঃনদী
সংযোগ বাস্তবায়নের জন্য ভারত বিশ্বব্যাংকের কাছে অর্থ সাহায্য চেয়েছে। সরকারি পর্যায়ে
বাংলাদেশ এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য তুলে ধরতে পারে এবং যুক্তিসঙ্গত আপত্তি
ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা তুলে ধরতে পারে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে শক্ত অবস্থান নিতে পারে
ভারতের বিরুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক কূটনৈতিক মাধ্যমে ভারতকে কিছুটা চাপ সৃষ্টি করা যেতে
পারে।
৫.
আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপন:
ভারত-বাংলাদেশ
পানি বণ্টন সমস্যার কথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরতে হবে। আন্তর্জাতিক
নদ-নদীর পানি বণ্টন ও প্রত্যাহার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক বিধি বিধান সুস্পষ্টভাবে জাতিসংঘের
বিভিন্ন সংস্থাকে জানাতে হবে। পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান না হলে বাংলাদেশ সম্ভাব্য
কি কি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে সেটা জানাতে হবে। এছাড়াও সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের
ক্ষতির দিকগুলো তুলা যেতে পারে।
৬.
জনমত গঠন:
বাংলাদেশ-ভারত
দ্বিপাক্ষিক সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশের মধ্যে প্রথমে জনমত গঠন করতে হবে। রাজনৈতিক
প্রতিহিংসা পরিহার, দল-মত নির্বিশেষে সকলে দেশের স্বার্থে এক যোগে কাজ করতে হবে। বিভিন্ন
ধরনের সভা, সমিতি, মিছিল ও সেমিনারের মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে একই স্তরে
নিতে হবে এবং মানুষকে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
৭.
গণমাধ্যমের ভূমিকা:
বর্তমান বিশ্বে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে কোন কিছু জানানো যায় এক মুহূর্তের মধ্যে। বাংলাদেশের পানি বণ্টন সমস্যার দিকগুলো নিয়ে ইন্টারনেটে ওয়েবসাইট খুলা যেতে পারে। দেশের পানির বণ্টন সমস্যা নিয়ে বিস্তারিতভাবে লেখালেখি করা যেতে পারে এবং বিশ্বের মানুষের মতামত আমাদের দিকে আনতে পারি।
ইমেলের মাধ্যম মত বিনিময়, বিশ্বজনমত গঠন এবং
বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের কাছে ই-বার্তা পাঠাতে হবে। এছাড়া পানি বণ্টন সমস্যাকে গণমাধ্যমের
দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। পানি বণ্টন সমস্যার আলোকে বিভিন্ন ধরনের প্রচার
প্রচারণা বাড়াতে হবে। এই সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেদন, ম্যাগাজিন, টিভি অনুষ্ঠান
সম্প্রচার ও সংবাদপত্রে লেখালিখির মাধ্যমে বিশ্বের মানুষের কাছে আমাদের সমস্যাটি তুলে
ধরতে হবে।
৮. সরকারের ভূমিকা:
এক্ষেত্রে সরকারকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন
করতে হবে। কেননা সরকারই পারে দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধান করতে। সেক্ষেত্রে সরকার দ্বিপাক্ষিকভাবে
বিভিন্ন ধরনের সংলাপের ও সেমিনারের আয়োজন করতে পারে এবং সমস্যার কথা উত্থাপন করতে
পারে। কেবলমাত্র সরকারের জোরালো উপস্থাপনই বিশ্ব সংস্থার কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত।
উপরিউক্ত কাজগুলো সরকার যদি নিজেই করে তাহলে কেবল ভারত-বাংলাদেশ পানি বণ্টন সমস্যার
সমাধান হতে পারে। সরকার ইতোমধ্যে ভারতের রাষ্ট্রদূতকে এই বিষয়ে উদ্বেগের কথা তুলে
ধরেছেন।
৯. পরিবেশবাদী আন্দোলন:
ভারত-বাংলাদেশ পানি বণ্টন সমস্যার ফলে বাংলাদেশের পরিবেশ
মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তাই বাংলাদেশের নিজেদের স্বার্থে পরিবেশবাদী আন্দোলনে
সক্রিয়ভাবে যোগদান করতে হবে। বিশ্ব জনমত আমাদের পক্ষে নিয়ে আসতে হবে যাতে করে ভারত
পরিবেশ আন্দোলনকারীদের কর্তৃক চাপে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক International Rivers Network হল্যান্ড ভিত্তিক International Water Tribunal ইত্যাদি সংগঠন নদীর স্বাভাবিক
গতি প্রবাহ নিয়ে কাজ করে। তাই এই বিষয়টি তাদের কাছে খুব জোরালোভাবে উত্থাপন করতে
হবে। প্রয়োজনে ই-মেইলের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের কাছে বার্তা পাঠাতে হবে
যাতে করে তারা আমাদের সমস্যার কথা জানতে পারে।
১০.
জোট গঠন ও লবিং করা:
বাংলাদেশ-ভারতের
মধ্যে পানি বণ্টন সমস্যার ফলে শুধুমাত্র বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। পানি সমস্যা
নিয়ে ভারতের সাথে নেপাল ভুটান এবং চীনেরও সমস্যা ও বিতর্ক চলছে। ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ,
শক্তিশালী চীন, নেপাল ও একসাথে জোট গঠন করতে পারে এবং লবিং করতে পারে পরস্পরের সাথে
পানি বণ্টন সমস্যা ভুটান নিয়ে ৷
১১.
প্রবাসীদের প্রচেষ্টা:
প্রবাসীরা
পানি বণ্টন সমস্যা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ তারা যেভাবে বিভিন্ন
সংস্থার সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখতে পারেন, আমরা দেশ থেকে সেভাবে পারি না। প্রবাসীদের
প্রচেষ্টায় বিদেশীদেরকে আমাদের অনুকূলে আনা সম্ভব। এর ফলে বিভিন্ন ভাবে ভারতের বিপক্ষে
জনমত গঠনে সহায়তা করা সম্ভব।
উপসংহার:
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সুপ্রতিবেশীমূলক পারস্পরিক সম্পর্কের
ক্ষেত্রে পানি বণ্টন সমস্যা একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। ভারত বাংলাদেশের নিকটতম
প্রধান প্রতিবেশী রাষ্ট্র। দেশ দুটির জনগণের মধ্যে রয়েছে প্রাচীন ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক
সম্পর্কের বন্ধন। তাছাড়া একই ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থানের ফলে দেশ দুটির মধ্যে
রয়েছে পারস্পরিক স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ে অবিভাজ্য সম্পৃক্তা। তৃতীয় বিশ্বের দুটি
দেশ ভারত ও বাংলাদেশকে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় নিজেদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে উভয় রাষ্ট্রের
কল্যাণের জন্য। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমেই কেবল পানি বণ্টন সমস্যার স্থায়ী
সমাধান করা যেতে পারে। তাই ভারত-বাংলাদেশের উচিত দেশের স্বার্থে ও জনগণের কল্যাণে দ্বিপাক্ষিক
সমস্যা সমাধানের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সমস্যাটি সমাধান করা।