ট্রানজিট কি? ভারত-বাংলাদেশ ট্রানজিট ইস্যুর ইতিহাস ও ধারা উল্লেখপূর্বক চট্টগ্রাম বন্দরের ভূমিকা লিখুন:
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ
রাজনীতিতে বাংলাদেশের ভূমির উপর দিয়ে ভারতের বৃহত্তর মূল ভূখন্ড থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন
স্থলপরিবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহে সহজ নিরাপদ ও কম দূরত্বের সংযোগ স্থাপনের
জন্য ভারত- প্রস্তাবিত 'ট্রানজিট ইস্যু' ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। 'ট্রানজিট'
সুবিধাকে বাংলাদেশের বিরোধী দলসহ এর বিরুদ্ধবাদী সকল সংগঠন, সংস্থা ও বিশেষজ্ঞ-বুদ্ধিজীবীবৃন্দ
ভারতের জন্য বাংলাদেশের উপর দিয়ে 'করিডর (Corridor) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অন্যদিকে
সরকার একে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক ও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতির সুযোগ বলে দাবি
করেছেন।
ট্রানজিট কি :
'ট্রানজিট' বলতে বাংলায় ‘পারাপার সুবিধা'
বুঝায়। ট্রানজিট (Transit) শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে “Process of
going or conveying across, over or throught" (Hawking, 1981)।ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের
উপর দিয়ে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভূ-খন্ডসমূহে লোকবল, যন্ত্র ও পণ্য পারাপারের সুবিধা
লাভকেই বর্তমানে বহুল আলোচিত ট্রানজিট সুবিধা (Transit Facilities) বুঝানো হয়ে থাকে।
এ ট্রানজিট সুবিধার আওতায় (চুক্তি বাস্তবায়িত
হলে) ভারত তার পশ্চিমবঙ্গ বা অন্য যেকোনো প্রদেশ থেকে মালামাল ও পণ্য বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর
(চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর), নৌপথ, রেলপথ এবং স্থলপথ ব্যবহারের মাধ্যমে সরাসরি বাংলাদেশের
ভূমির উপর দিয়ে ‘শর্ট-কার্ট’ পন্থায় দ্রুত
লাভজনক ও কৌশলগত সুভিধাজনকভাবে তার স্থলপরিবেষ্টিত বিচ্ছিন্নপ্রায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয়
সাতটি রাজ্যে সহজেই পারাপারের সুযোগ পাবে এবং বিনিময়ে বাংলাদেশ লাভ করবে আর্থিক সুবিধা
।
করিডোর :
‘করিডোর' হচ্ছে
এমন যোগাযোগ সংযোগ, যার মাধ্যমে অন্য দেশের ভূখন্ডের উপর দিয়ে একই দেশের এক অঞ্চল
থেকে আবার ঐ দেশেরই বিচ্ছিন্ন বা যোগাযোগহীন অন্য কোনো অংশে জন, যান বা মালামালের পারাপারের
জন্য দেয়া সংযোগ পথ ।
ভারতের ট্রানজিটের কারণ :
ভারতের শিল্পোন্নত রাজ্য গুজরাট, পাঞ্জাব,
হরিয়ানা, দিল্লিসহ বিভিন্ন পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য ও বিহার, উড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশ
ও পশ্চিমবঙ্গের কৃষিপ্রধান অঞ্চলের নানা ধরনের শিল্পজাত ও কৃষিপণ্যাদি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয়
রাজ্যসমূহের ভোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে উত্তরবঙ্গের ‘শিলিগুড়ি করিডর’ ঘুরে হাজার হাজার
কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে দুর্গম পাহাড়ি পথ অতিক্রমপূর্বক রেল ও সড়কপথে পারাপার
করতে হয়। এর ফলে ভারতকে প্রতিবছর শুধু পরিবহন খরচ বাবদ অতিরিক্ত পাঁচ থেকে সাত হাজার
কোটি রুপি ব্যয় করতে হয়।
তাছাড়া অত্যন্ত নাজুক ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানের
কারণে ঐসব রাজ্যে ভারতকে বিপুল সামরিক স্থাপনা পরিচালনা, সৈন্য ও রসদ সরবরাহ বজায়
রাখতে হয়। বাংলাদেশের রেল, সড়ক ও নৌপথকে ব্যবহারের মাধ্যমে ভারত যদি সরাসরি শর্ট-কাট
পথে ঐসব রাজ্যে যাতায়াত, মালামাল পরিবহন ও পারাপারের সুযোগ পায়, তবে হাজার হাজার
কোটি রুপি ও প্রচুর সময়ের সাশ্রয় হবে বলে প্রমাণিত হয়েছে। তাছাড়া প্রতিরক্ষা ও
নিরাপত্তার ব্যাপারেও নিশ্চিত হওয়া যায় এর মাধ্যমে খুব সহজেই।
ভারতের ট্রানজিট প্রস্তাবের রূপরেখা :
ভারতের প্রস্তাবিত ট্রানজিট সুবিধাবলির
আওতায় বাংলাদেশের ভূমির উপর দিয়ে স্থল (সড়ক ও রেল) ও নৌপথ পশ্চিমবঙ্গ থেকে অথবা
চেন্নাই (মাদ্রাজ), বিশাখাপত্তম বন্দর থেকে আনীত মালামাল উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় দূরবর্তী
সাতটি রাজ্য আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, মণিপুর ও অরুনাঞ্চলে পৌঁছানো
হবে।
পণ্য প্রথমে চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস
করে তা স্থানীয়ভাবে গড়ে তোলা নিরাপদ এবং সুপরিসর ওয়্যারহাউসে মজুদ করবে এবং পরে
তা বিলোনিয়া সীমান্ত দিয়ে ত্রিপুরায় যাবে অথবা ত্রিপুরার দক্ষিণাঞ্চলীয় নদীবন্দর
সাবরুমে (ফেনী নদীর উত্তরে) প্রবেশ করতে পারবে ছোট ছোট বার্জে করে। আর এখান থেকে স্থলপথে
নতুন করে তৈরি সড়ক পথে চলে যাবে আসাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ডসহ দূরবর্তী রাজ্যসমূহে।
তাছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর থেকে তোলা পণ্য ও সামরিক
সরঞ্জামাদি সহজেই পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর দিয়ে কাপ্তাই, দিঘীনালা, বাঘাছড়ি, মারিস্যা
হয়ে কিংবা পূর্বদিকের দুর্গম পাহাড় সড়ক দিয়ে মিজোরাম, ত্রিপুরা ও নাগাল্যান্ড,
মণিপুর চালান দেয়া সম্ভব হবে। ভারত চট্টগ্রাম বন্দরকে ঢেলে সাজানোর কথা বলে তার উন্নয়নের
প্রস্তাব দিয়েছে।
তাছাড়া স্থলপথে ভারত বেনাপোল, দর্শনা
ইত্যাদি সীমান্ত দিয়ে সড়কপথে দূরপল্লার ভারী ট্রাকসহযোগে বাংলাদেশের উপর দিয়ে জন,
পণ্য ও যন্ত্র তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহে প্রেরণের সুবিধা পাবে। ভারত পশ্চিমের
বর্ণিত সীমান্তসমূহ দিয়ে প্রবেশ করে বাংলাদেশের পূর্বাংশের কুমিল্লার কসবা, আখাউড়া,
সিলেটের তামাবিল (মেঘালয় শিলং হয়ে আসামের গৌহাটি পর্যন্ত ও অন্যান্য দূরবর্তী স্থানে
যাওয়া পথ), জকিগঞ্জ, কাছাড়, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি ইত্যাদি হয়ে তিনসুকিয়া হয়ে
অরুণাচল কিংবা ডিব্ৰুগড়, ডিগবয়, ইম্ফল, আইজল ইত্যাদি শহরে সহজেই যোগাযোগ স্থাপন ও
লাভজনক নিরাপদ পরিবহন, পণ্য ও জন পারাপার নিশ্চিত করতে পারবে।
ভারতের ট্রানজিট প্রস্তাবনা প্রধানত তার
পণ্য পরিবহনের সুবিধার কথা বললেও উপধার হিসেবে এতে থাকছে ঐসব লাইন নিরাপদ ও নিশ্চিত
করার জন্য স্বীয় মেইনটেন্যান্স ও ম্যানেজমেন্টের অধিকারের ধরা; চট্টগ্রাম বন্দরের
সুবিধাবলী ও স্থাপনা সম্প্রসারণের প্রস্তাবনা এবং স্বাভাবিকভাবে ঐ ট্রানজিট চালু হলে
তা হঠাৎ করে যাতে বাংলাদেশ একতরফাভাবে কোনোদিন বন্ধ করে দিতে না পারে সেজন্য শর্তাবলি
।
ট্রানজিটের স্বার্থ ও লাভালাভ :
ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে পারস্পারিক ট্রানজিট
ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হলে এর দ্বারা ভারত ও বাংলাদেশ দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রই আর্থিকভাবে
লাভবান হতে পারে। কিন্তু ট্রানজিটের নামে করিডোর প্রদানের মাধ্যমে উভয় দেশ অর্থনৈতিক
দিক দিয়ে লাভবান হবে এমন কোনো সম্ভাবনা নেই। ভারত বর্তমানে ট্রানজিটের জন্য যে তোড়জোড়
ও প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং প্রস্ত বিনা তৈরি করছে তার জন্য তুলে ধরেছে একটি অর্থনৈতিক
রূপরেখা। নিচে সংক্ষেপে ভারতের ট্রানজিট প্রস্তাবের অর্থনৈতিক লাভালাভের চিত্র তুলে
ধরা হলো ।
ভারতের লাভ: ট্রানজিটের মাধ্যমে ভারতের স্বার্থ ও আর্থিক লাভের চিত্র নিম্নরূপ :
১. ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের খনিজ সম্পদ
(প্রাকৃতিক তেল, গ্যাস, কয়লা, ইউরেনিয়াম, চুনাপাথর, কঠিন শিলা, চীনামাটি ইত্যাদি)
যা ভারতের পশ্চিমাঞ্চল ও অন্যান্য রাজ্যের শিল্পের বিকাশ ও ব্যবহারের অন্যতম উপাদান,
তা পরিবহন ও স্থানান্তরের জন্য বাংলাদেশের উপর দিয়ে ভারতের ট্রানজিট সুবিধা লাভ একান্ত
প্রয়োজন ৷
২. ভারতের আসামের করিমগঞ্জ, কাছাড় জেলা,
ত্রিপুরা, মেঘালয়, উত্তরবঙ্গের নেপাল ও ভুটান সীমান্ত সংলগ্ন দার্জিলিং, কুচবিহার
এবং জলপাইগুড়ি জেলাসহ আরো কিছু উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ও জেলার বিভিন্ন পাহাড়
অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ ও বিস্তীর্ণ চা- বাগান, কফি,
রাবার, তেজপাতা, কমলালেবু, নাশপাতি আর নানা মূল্যবান ফল ও ভেষজ বৃক্ষের বাগান বা প্লানটেশন।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রয়েছে প্রায় ৮/৯শ ছোট-বড় চা- বাগান।
ভারত আসামের ঐসব পণ্যের বিরাট অংশ বিদেশে রফতানি
করে কোটি কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে (Foreign Exchange) থাকে। কিন্তু ঐ অঞ্চলের
সাথে সরাসরি কোনো সমুদ্রবন্দর সংযোগ না থাকার ফলে ভারতকে এতদঞ্চলের পণ্য প্রায় পাঁচশ
থেকে দেড়/দু'হাজার কিলোমিটার পথ ঘুরিয়ে শিলিগুড়ি করিডর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা
বাহলদিয়া বন্দরে নিয়ে আসতে হয়। এর ফলে ভারতকে প্রতি বছর প্রায় ৫ থেকে ৭ কোটি রুপি
অর্থ অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়। বাংলাদেশের উপর দিয়ে যদি মোট ৫-৭ শ' কে কিংবা বড়জোর
১ হাজার কোটি রুপি ট্যারিফ বা ট্রানজিট ফি দিয়ে ভারত 'শর্ট-কার্ট' ট্রানজিট নিতে পারে
তবে ভারত পরিবহন খাতে অন্তত ৫/৬ হাজার কোটি রুপি অর্থের সাশ্রয় করতে সক্ষম হবে।
৩. আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মণিপুর,
অরুণাচল ও মেঘালয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে রয়েছে ভারতের বৃহত্তম সমৃদ্ধতম বনাঞ্চল।
ঐসব গভীর ক্রান্তীয় অরণ্যে (Dense Tropical Forests) রয়েছে অত্যন্ত মূল্যবান কাঠের
বৃক্ষ, যেমন-বার্মা-সেগুন (Burmese Teak), মেহগনি, আগর, শিশু, গর্জন, জারুল, শিরীষ,
কড়ই, বাঁশ, গল্পাবেথ ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর-প্রদেশ, দিল্লি, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাবসহ
বিভিন্ন মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যের শহর ও নগরসমূহে এবং নানা প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্রে
রয়েছে এসব মূল্যবান ও বহু ধরনের কাঠ অরণ্যজাত পণ্যের দারুণ চাহিদা।
দূরত্ব ও পরিবহন অসুবিধার কারণে এসব ভারী
ও কলেবর-সমৃদ্ধ পণ্যাদি লাভজনকভাবে বর্তমান পশ্চিমের বাজার বা চাহিদা কেন্দ্রে নেওয়া
সম্বব হচ্ছে না। বাংলাদেশের উপর দিয়ে আসাম, ত্রিপুরা বা অন্য অঞ্চল সমূহে সরাসরি সংযোগ
স্থাপিত হলে শত শত কোটি টাকার কাঠ ও অরণ্যজাত সম্পদ লাভজনকভাবে অনায়াসে এবং দ্রুততার
সাথে কলকাতা ও অন্যান্য স্থানে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
৪. বাংলাদেশের সাথে ট্রানজিট চুক্তি সম্পাদিত
হলে ভারত তার এসব উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় দূরবর্তী দীর্ঘ সংযোগ লাইনসমূহের (রেল, সড়ক
ও বিমান যোগাযোগ) ব্যয়বহুল রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন খাতের বিপুল
বাজেট (প্রতি বছর অন্তত দেড়-দু'হাজার কোটি রুপি) প্রায় অর্ধেকে কমিয়ে আনতে পারবে।
অপর পক্ষে বাংলাদেশে এর মাত্র দশ ভাগের এক অংশ খরচ করতে হবে প্রতি বছর (ফি ছাড়া)।
বোড়ো, মণিপুরী ও উলফা (ULFA) বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলাদের গুপ্ত হামলায় ও নাশকতামূলক
আক্রমণে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার পণ্য নষ্ট হয়।
ট্রানজিট সুবিধা ভারতকে ঐ ভীতি ও আশঙ্কা থেকে মুক্তির
নিশ্চয়তা দেবে বিপুলাংশে। ভারত ট্রানজিটের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর দিয়ে তার জন, যন্ত্র,
পণ্য এবং যান পরিবহন ও পারাপারের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের উপর দিয়ে আসাম থেকে বিদ্যুৎ
গ্রিড লাইন ও প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইন বসানোর সুবিধাও আদায় করতে পারে। আর
তা লাভ করলে আসামের সস্তা ও বিপুল পানি, বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক গ্যাস অত্যন্ত লাভজনকভাবে
ও অনায়াসে পশ্চিমবঙ্গসহ বিহার, উড়িষ্যা ইত্যাদি দূরবর্তী রাজ্যের গ্রিডসমূহে প্রবাহিত
করতে সক্ষম হবে। এভাবেও ভারত বিপুল আর্থিক স্বার্থ হাসিল করবে।
৫. বাংলাদেশের উপর দিয়ে ট্রানজিটের মাধ্যমে
সামরিক পরিবহন সুবিধা লাভের দ্বারা ভারত সহজেই তার বিচ্ছিন্নতাপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে বিদ্রোহ
দমন, সম্পদের মালিকানা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, স্বীয় সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে তার
বাজার ও ব্যবসায়িক স্বার্থ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে বিপুল অর্থনৈতিক ফায়দাও হাসিল করতে
সক্ষম হবে।
বাংলাদেশের লাভ : ট্রানজিটের মাধ্যমে বাংলাদেশেরও আর্থিক লাভবান হবার সুযোগ রয়েছে। নিম্নে তা তুলে ধরা হল-
১. ভারত-বাংলাদেশ ট্রানজিট স্থাপিত হলে
বাংলাদেশ ভারতকে যে ট্রানজিট সুবিধা দেবে তার বিনিময় ফি বা ট্যারিফ থেকে বছরে ৭০০
থেকে ১০০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে। যা দিয়ে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত ও
বন্দর উন্নয়নের কাজ করা যাবে।
২. ট্রানজিটের জন্য ভারত বাংলাদেশের হাইওয়ে,
রেলওয়ে এবং বন্দরসমূহের (চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরসহ) নির্মাণ ও উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য
অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করবে এবং বাংলাদেশ বিনা খরচে তারা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন,
মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের অনুকূল সুযোগ পাবে, যা দেশটিকে শত শত কোটি টাকার অর্থ সাশ্রয়ে
সাহায্য করতে পারে ।
৩. ভারত-বাংলাদেশ ট্রানজিট বিনিময়ের দ্বারা
বাংলাদেশকেও ভারতের উপর দিয়ে নেপাল ও ভুটানের সাথে বাণিজ্যিক ট্রানজিট স্থাপনের কথা
বলা হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের পণ্য নেপাল ও ভুটানে যেতে পারবে। ফলে বাংলাদেশের
বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে।
৪. ট্রানজিটের বিনিময়ে বাংলাদেশকে সাপটা
চুক্তির আওতায় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাণিজ্যিক তৎপরতা বিস্তার করার কথা বলা হয়েছে,
এটি কার্যকর হলে বাংলাদেশও লাভজনকভাবে আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম প্রভৃতি অঞ্চলে
ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি মাধ্যমে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা
অর্জনে সক্ষম হবে।
৫. ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ট্রানজিট চুক্তি
সম্পাদিত হলে এর ধারার আওতায় বাংলাদেশ- ভারতের মেঘালয় ও আসাম থেকে বৈদ্যুতিক গ্রিডের
মাধ্যমে সস্তায় পানি-বিদ্যুৎ নিয়ে আসতে পারবে এবং বাংলাদেশের জ্বালানী ও বিদ্যুৎ
সংকট অনেকাংশে দূরীভূত হবে।
৬. ট্রানজিট ব্যবস্থা চালু হলে বাংলাদেশের
ভারতীয় চোরাকারবারজাত পণ্যের সরবরাহ কমে বৈধ বাণিজ্যজাত পণ্যের সরবরাহ বাড়বে এবং
একই কারণে বাংলাদেশ ঐসব ভারতীয় পণ্যের উপর আরোপিত ট্যারিফ বাবদ শত শত কোটি টাকার অর্থ
লাভ করতে সক্ষম হবে। একই সঙ্গে চোরাকারবার বন্ধ হলে এবং ভারতীয় প্রয়োজনে নিরাপত্তা,
আবগারি ও শুল্ক বিভাগ তৎপর হয়ে উঠলে বাংলাদেশের বেশি পরিমাণের সীমান্ত নিরাপত্ত ব্যবস্থা
হ্রাস করে BGB সদস্য সংখ্যা ও তৎসংশ্লিষ্ট বাড়তি খরচ বহুলাংশে কমাতে সক্ষম হবে।
ট্রানজিটের মন্দ দিক :
১. সমতা (Equity) চুক্তির স্বার্থে যদি
ভারত ‘সাপটা’র আলোকে বাংলাদেশকেও
তার উত্তর- পূর্বাঞ্চলে বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান করতে রাজি হয় তাহলে ভারতের বিপুল
পরিমাণ সস্তা ও উন্নত মানসম্মত পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে কোনোক্রমেই বাংলাদেশ ঐ
অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে সফলতা লাভ করতে পারবে না বলে ধারণা করা হয়। কারণ ভারতীয় ব্যবসায়ীদের
পরিচিত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংযোগ এবং প্রশাসনিক আনুকূল্য তাদেরকে সব সময়ই এ বিষয়ে
সহযোগিতা করবে।
২. ট্রানজিট চুক্তির মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের
উপর দিয়ে মালামাল ও পণ্য পারাপারের সুযোগ পেলে তারা আরো বেশি ও জোরালো বাণিজ্যিক তৎপরতা
চালানোর সুযোগ ও সুবিধা পাবে। সাপটা (SAPTA) চুক্তির বাইরে বিশ্ব মুক্ত অর্থনীতির সুযোগের
আওতা ছাড়াই ভারত ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ১০০ : ৪ অনুপাতের বিপুল বাণিজ্যিক আধিপত্য বিস্তার
করে নিয়েছে। এই বাণিজ্যিক প্রতিকূল ভারসাম্য আরো বেড়ে যেতে পারে।
৩. বর্তমানে 'Open Secret' চোরাকারবারের
মাধ্যমে যে হাজার কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশের বাজারে আসে, ট্রানজিট সুবিধার
মাধ্যমে স্বাভাবিক কারণেই ভারতীয় ঐসব চোরাই পণ্য আরো বেশি হারে বাংলাদেশে প্রবেশ করে
বাজারকে ভারতীয় পণ্যে সয়লাব করে দেবে। ফলে লাভ হবে ভারতের, আর ক্ষতিগ্রস্থ হবে বাংলাদেশ।
৪. বাংলাদেশের ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন
এবং ভারত কর্তৃক ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্র সিকিম দখল করে নেয়ার (১৯৭৫) পরপরই ভারতের
উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বইতে শুরু করে স্বাধীনতার হাওয়া, বিচ্ছিন্নতাবাদের সংগ্রাম। ক্রমে
সত্তর, আশি এবং নব্বইর দশকে গড়ে উঠতে থাকে উলফা, স্বাধীন বোড়োল্যান্ড, ত্রিপুরা লিবারেশন
আর্মি, দার্জিলিং-এর সুভাষ ঘিষি - এর গোর্খাল্যান্ড প্রভৃতি আন্দোলন। প্রায় সাড়ে
তিন কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত লাখ বর্গকিলোমিটার ভূ-ভাগ সাতরাজ্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলের
কখনো বিচ্ছিন্ন এবং কখনো স্বাধীনতার সম্মিলিত সশস্ত্র সংগ্রাম। তাই ভারত যদি ঐসব বিচ্ছিন্নতাবাদী
আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের ট্রানজিট দিয়ে সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জামাদি পরিবহন
করে তবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতভাবেই ক্ষুণ্ন হবে।
৫. ট্রানজিটের আওতায় ভারতকে বাংলাদেশের
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ ও সুবিধা প্রদান করলে বাংলাদেশের প্রধানতম বহির্বাণিজ্যের
অপ্রতুল আয়োজন সম্পন্ন এ বন্দরটিকে বাংলাদেশের বিপুল প্রয়োজনে ব্যবহার করা থেকে বহুলাংশে
ছাড় দিতে হবে। এখনই প্রত্যহ পরিসরের অভাবে এ বন্দরে বহু জাহাজকে দিনের পর দিন বহির্নোঙ্গরে
অবস্থান ও অপেক্ষা করতে হয়। কর্ণফুলী নদীতে পানির অভাব, খাড়ির প্রশস্ততার অপ্রতুলতা
এবং বন্দরের ‘হারবার' ও ‘অ্যাঙ্কারেজ'
ফ্যাসিলিটিজ-এর অসুবিধাজনক পরিস্থিতির জন্য ভারত এ বন্দর ব্যবহারের সুযোগ লাভ করলে
বাংলাদেশকে বিস্তর অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে; ডেমারেজ খেসারত দিতে হবে শত শত কোটি
টাকা ।
৬. বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার
কারণে যদি ভারতের ট্রানজিটভুক্ত পণ্যাদি পারাপারে বিঘ্ন ঘটে অথবা কোনো নাশকতামূলক প্রচেষ্টায়
ঐসব পণ্য ও পথ ধ্বংস হয় তবে চুক্তির স্বাভাবিক ধারা বা শর্তানুযায়ী বাংলাদেশকে সমুদয়
ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অন্যদিকে স্বাধীনতাকামী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম
বন্দরসহ ট্রানজিট পথের নানা সড়ক, রেলপথ, পুল-কালভার্ট-ব্রিজ ইত্যাদিসহ আরো নানা স্থাপনায়
নানা ধরনের ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালাতে পারে-যা হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার
জন্য দারুণ ক্ষতিকর।
উপসংহার :
বিশ্বায়নের যুগে কোন দেশই দরজা জানালা
বন্ধ করে বসে থাকতে পারে না। প্রতিবেশী ও বন্ধু দেশসমূহের মধ্যে পারস্পারিক যোগাযোগ
ও নেটওয়ার্ক স্থাপনের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ আদায় করে নেওয়াই আজ সময়ের দাবি।
সেই বিবেচনায় ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে ট্রানজিট সুবিধা স্থাপন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
উন্নয়নের স্বার্থেই প্রয়োজন। তবে এক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনা
করা প্রয়োজন ।
Tags
India
Bangladesh Transit |
Bangladesh exploring transshipment |
Transit
Agreement Between Bangladesh and India |
Transit
Agreement |
India-Bangladesh
Transit |
India Bangladesh relationship |
waterways between India and Bangladesh India |
a Bangladesh trade Bangladeshi |
a
Bangladesh transit |
India-Bangladesh Inland Transit Agreement |
transit
visa India |
Bangladesh India transit |
|