রোহিঙ্গা সংকট অনুচ্ছেদ। রোহিঙ্গা সমস্যা কী? সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশ-মিয়ানমার কূটনৈতিক সম্পর্ক ২০২৪

 

রোহিঙ্গা সংকট অনুচ্ছেদ। রোহিঙ্গা সমস্যা কী? সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশ-মিয়ানমার কূটনৈতিক সম্পর্ক ২০২৪

রোহিঙ্গা সংকট অনুচ্ছেদরোহিঙ্গা সমস্যা কী? সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশ-মিয়ানমার কূটনৈতিক সম্পর্কে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে আলোচনা করুনঃ 

মিয়ানমারের সাম্প্রতিক জাতিগত দাঙ্গায় আবারও জীবন্ত হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গা ইস্যুটি। একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নারীকে ধর্ষণ এবং হত্যার অভিযোগকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক এই জাতিগত দাঙ্গার শুরু। দেশটির সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ই বরাবরের মত এবারও নির্মম নির্যাতনের শিকার। মিয়ানমার সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ এবং অসহযোগিতায় বাধ্য হয়ে সহায়-সম্বলহীন এই শরণার্থীরা তাই বাংলাদেশে আশ্রয় লাভের আশায় অনুপ্রেবেশের চেষ্টা করছে। অভ্যন্তরীণ সমস্যা জর্জরিত বাংলাদেশের জন্য এটি বোঝার উপর শাঁকের আটি হয়ে দেখা দিয়েছে। এমনিতেই বাংলাদেশ বর্তমানে রোহিঙ্গাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম আবাসস্থল হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় মানবিক দিক বিবেচনা করেও বাংলাদেশের পক্ষে নতুন করে আর কোন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া কঠিন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ-মিয়ানমার কূটনৈতিক সম্পর্কে শুরু হয়েছে নতুন টানাপোড়েন ।

রোহিঙ্গাদের পরিচয়:

পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম হলো সনাতন বা হিন্দু ধর্ম। প্রাচীনকাল থেকেই প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা বসবাস করত। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এখানে শাসকেরও পরিবর্তন হয়। প্রচলন হয় মুসলিম শাসনের। মুসলিম শাসকদের পরিচালিত এ শাসনব্যবস্থা চালু হওয়ায় অনেকেই সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এদিকে সনাতন ধর্মের অনুসারী রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও গৌতম বুদ্ধ যখন বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার শুরু করেন তখন অনেকেই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। আবার, খ্রিস্টান মিশনারিরা আসার পর এবং মূলত বৃটিশ শাসন চালু হওয়ার পর স্বল্পসংখ্যক মানুষ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। এভাবে ভারত উপমহাদেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মাবলম্বী মানুষের বসবাস শুরু হয়।

 

হিন্দুরা দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাহিরে থাকার পর আবারো ক্ষমতায় আসে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর। তাঁরা বৌদ্ধ ধর্ম নির্মূল অভিযান শুরু করে। বৌদ্ধদের উপর শুরু হয় ব্যাপক অত্যাচার ও নির্যাতন । এ পরিস্থিতিতে বৌদ্ধরা তৎকালীন আরাকান রাজ্যে (বর্তমান মিয়ানমার) আশ্রয় গ্রহণ করে। এভাবে আরাকান রাজ্য বৌদ্ধ অধ্যুষিত হয়ে গড়ে উঠে। পরবর্তীতে বৌদ্ধধর্ম আরাকান থেকে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও চীন পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। মিয়ানমারে বৌদ্ধদের সাথে বাস করতে থাকে মুসলমানরা। বৌদ্ধরা মগ বা রাখাইন নামে পরিচিত হয় আর মুসলমানরা মিয়ানমারের প্রাচীন নাম রোসাঙ্গ থেকে রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলার সম্রাট নাসির উদ্দিন শাহ রোহিঙ্গাদের উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং আরাকানে একটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

 

রোহিঙ্গা নামকরণঃ

রোহিঙ্গা নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা মত।রোহিঙ্গারা আফগানিস্তানের অন্তর্গত ঘোর প্রদেশের রোহিঙ্গা জেলার অধিবাসীদের বংশধর। মূলত: তারা তুর্কি বা আফগানি। কারণ ইখতিয়ার উদ্দিন  মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজিসহ বাংলার মুসলমান বিজেতা ও শাসক ইসলামের প্রচার ও প্রসারে আফগানিস্তানের রোহার অঞ্চলের কিছু ব্যক্তিকে আরাকানে পাঠিয়েছিলেন। রোহার অঞ্চলের ঐ মুসলমানরা আরাকানের নামকরণ করেছিলেন রোহাং।


এ রোহা বা রোহাং শব্দ থেকেই রোহিঙ্গা নামকরণ করা হয়েছে। অন্যমতে, রাখাইন শব্দ থেকে রোয়াং এবং রোয়াং থেকে রোহিঙ্গা শব্দটি এসেছে। কেউ কেউ মনে করেন রোয়াং তিব্বতী বর্মি শব্দ যার অর্থ আরাকান। এ মতে রোয়াং শব্দের অপভ্রংশ রোহিঙ্গা। আবার কেউ কেউ মনে করেন রোহিঙ্গা হলো 'রেঙ্গুন' এর অপ্রভ্রংশ। সেই মতে রেঙ্গুনে বসবাসকারী বার্মিজ সম্প্রদায় রোহিঙ্গা নামে পরিচিত পায় ।

 

রোহিঙ্গা সংকটের পটভূমি:

১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা কর্তৃক আরাকান দখল হলে তৎপরবর্তী ৪২ বছরের দুঃশাসনে মুসলিমদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। বর্মিরাজ বোদাফিয়ার মুসলমানদের ছিন্ন- বিছিন্ন করে সে ধ্বংসস্তুপের উপর বৌদ্ধ ধর্মের প্যাগোডা নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তিনি মুসলমানদের শক্তি বিলীন করতে মুসলমানদের মসজিদ-মাদ্রাসা ধ্বংস করে সেখানে নির্মাণ করেন প্যাগোডা ও বৌদ্ধ বিহার। বর্মিরাজের অত্যাচার আর নির্যাতনে এ সময় বেশ কিছু মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। তখন থেকেই বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আগমনের শুরু। ১৮২৩ সালে বৃটিশ সরকার বার্মা দখল করে নেয় এবং ১৯৩৭ সালে স্বায়ত্ত্বশাসনের নামে বর্মিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে। এর ফলে বার্মায় সামরিক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত বার্মায় বারবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। প্রতিটি দাঙ্গায় অসংখ্য রোহিঙ্গা প্রাণ হারায় এবং তাদের অনেকেই নিজ বাসগৃহ থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে চলে আসে ৷

 

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীন দেশে বৌদ্ধদের ক্ষমতা সুসংহত করতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নির্মূল অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ অভিযানে রাষ্ট্র নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করে পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা পালন করে। সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধরা মুসলমানদের অসংখ্য গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। হত্যা, লুণ্ঠন ও নির্যাতনে জর্জরিত রোহিঙ্গারা শেষ পর্যন্ত অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নেমে পড়ে।

 

এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা সশস্ত্র যুদ্ধের ঘোষণা দেয় এবং আরাকানের ৮০ শতাংশ অঞ্চল নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হয়। সরকার বাধ্য হয়ে মুসলমানদের সাথে সমঝোতায় বসে। উক্ত সমঝোতায় পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব, চাকুরির নিশ্চয়তা, ভাষার স্বীকৃতিসহ সর্বোপরি রোহিঙ্গাদের স্বাতন্ত্র জাতিসত্তার স্বীকৃতি দেয়া হয়। কিন্তু এসকল স্বীকৃতি শুধু কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ থাকে, তা কখনো বাস্তবতার মুখ দেখতে পারেনি।

 

১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান ঘটে। সেনা সরকারের প্রধান নে উইন পূর্ববর্তী সরকার বনাম রোহিঙ্গাদের মধ্যকার চুক্তি উপেক্ষা করে মুসলমানদের প্রতি কঠোর মনোভাব পোষণ শুরু করে। সেনাপ্রধান শুধু মুসলমানদের প্রতি কঠোর মনোভাব পোষণ করে তা নয় তিনি প্রচলিত গণতন্ত্রেরও সমাধি রচনা করেন এবং দেশের একমাত্র দল বার্মা সোস্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি এর নেতৃত্বে দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। এ সমাজতন্ত্র বার্মার প্রায় এক কোটি মুসলমানদের উপর মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায় ।

 

১৯৭৮ সালে জেনারেল নে উইন নাগামিন ড্রাগন' নামে একটি অপারেশন পরিচালনা করে। এ অপারেশনে নিষিদ্ধ ন্যাশনাল লিবারেশন পার্টির সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে নির্বিচারে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয় এবং প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এ ঘটনাটি বিশ্বব্যাপী আলোচনায় আসে। United Nations High Commissioner for Refugees (UNHCR) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপের মুখে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের সিংহভাগ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয় মিয়ানমার সরকার। কিন্তু, সে দেশে তারা পূর্ণাঙ্গ নাগরিক সুবিধা পাননি। এখনো। তাদেরকে ঘোষণা করা হয়েছে ভাসমান নাগরিক (Stateless People)। যদিও জাতিসংঘের আইন অনুযায়ী পৃথিবীতে কোন দেশহীন মানুষ থাকতে পারে না ।



১৯৯১ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক আরেকটি অপারেশন চালানো হয় যার নাম 'Operation Peezay'। এ অপারেশনের মাধ্যমে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় উগ্রপন্থিরা রোহিঙ্গা গ্রাম ধুলিস্যাৎ করে মুসলমান রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে এবং সেখানে বৌদ্ধ রাখাইনদের পুনর্বাসিত করে। এ সময় সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে শুধু জীবনের নিরাপত্তা রক্ষার্থে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। পৃথিবীতে সবচেয়ে নির্যাতিত ক্ষুদ্র এই জাতিগোষ্ঠী বারবার মিয়ানমারের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী কর্তৃক অকাতরে প্রাণ দিচ্ছে, হারাচ্ছে মৌলিক মানবাধিকার।

 

সাম্প্রতিক জাতিগত দাঙ্গা:

রোহিঙ্গা সংকট অনুচ্ছেদ


একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নারীকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগকে কেন্দ্র করে ৩ জুন, ২০১২ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা একটি বাস থেকে ১০ জন রোহিঙ্গা মুসলমানকে নামিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে । এ ঘটনার প্রতিবাদে ৮ জুন ২০১২ বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মংডু জেলায় জুমার নামাজের পর মুসলমানরা মিছিল বের করলে তাদের মিছিল ও মসজিদ লক্ষ্য করে ইট পাথর ছুঁড়ে মারে বৌদ্ধরা। এর ফলে ছড়িয়ে পড়ে দাঙ্গা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় যাতে নিহত হয় পাঁচ রোহিঙ্গা।

এরপর প্রদেশটিতে শুরু হয় সাম্প্রতিককালের বৌদ্ধ-রোহিঙ্গা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন দু'টো গ্রামে ঘরে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয় দাঙ্গাকারীরা। হত্যা করে অগণিত নারী-পুরুষ-শিশু যাদের অধিকাংশই মুসলমান। উদ্বাস্তু হয় হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান। বার্মা থাইল্যান্ড সীমান্ত ক্যাম্পগুলোতে ১ লাখের অধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়। দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ।

বাংলাদেশের জন্য সমস্যার কারণ:

রোহিঙ্গা মিয়ানমারের নিজস্ব একটি সমস্যা। কিন্তু বাস্তবে লক্ষ করা যায় প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় নানা কারণে রোহিঙ্গা সমস্যা' বাংলাদেশের জন্য একটি বড় হুমকি । কারণগুলো নিম্নরূপ:

১. সীমান্ত সংঘর্ষ:

রোহিঙ্গারা মুসলিম হওয়ার কারণে খুব সহজেই সীমানা অতিক্রম করে মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে প্রবেশ করে আশ্রয় পেতে চায়। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাসাকা তাদেরকে বাংলাদেশে পুশ ইন করে ঝামেলা মুক্ত হতে চায়। অন্যদিকে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি এ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথিদের গ্রহণ না করে পুশ ব্যাক করতে চায়। এর ফলে সীমান্তে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয় ৷

২. বাড়তি চাপ:

বাংলাদেশ বিশ্বের এমন একটি দেশ যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি ৷ এদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এসে যুক্ত হয়ে জনসংখ্যা যখন আরো বৃদ্ধি করে তখন তা যেন গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়ায় ।

৩. বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে টানাপোড়ন:

প্রতিবেশী দেশ হলেও রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের এর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়।

৪. অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা:

রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশের পর কোন না কোন স্থানে তারা বসতি স্থাপন করে। বসতি স্থাপন করতে না পারলে ভ্রাম্যমাণ হিসেবে ঘুরে বেড়ায়। এতে দেশের অভ্যন্তরে অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় ।

৫. অবৈধ ব্যবসার প্রসার:

সম্প্রতি বাংলাদেশে ইয়াবা' নামক যে মাদকের প্রসার ঘটেছে তার উৎস মিয়ানমার। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা শুধু ইয়াবা নয় অন্যান্য মাদকদ্রব্য পাচার ও চোরাকারবারির সাথে নিজেদের যুক্ত করে অবৈধ ব্যবসার প্রসার ঘটাচ্ছে।

৬. রাজস্ব আয় হ্রাস:

বৈধ প্রক্রিয়ায় কোন মালামাল বন্দর হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করলে বাংলাদেশ রজস্ব আয় করতে সক্ষম হয়। কিন্তু, অবৈধ উপায়ে অনেক মালামাল বাংলাদেশে প্রবেশ করছে বলে সরকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

৭. আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি:

বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব একটা সন্তোষজনক নয়। রোহিঙ্গারা এদেশে প্রবেশের পর নানা ধরনের আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজে নিজেদের জড়িত করে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটাচ্ছে।

৮. মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার দখল:

অতীতে অনুপ্রবেশকারী বহু রোহিঙ্গা পরবর্তীতে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে যায় এবং এর ফলে আমাদের শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু তাই নয়, বিদেশে গিয়ে তারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হয় ব্যাপক হারে ।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য:

গত তিন দশকে বাংলাদেশ এবার তৃতীয় বারের মত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সমস্যা মোকাবিলা করছে। সত্তরের দশকের শেষে আর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের প্রত্যাবাসন করানোর নীতিকে কার্যকর করানোটা যে বাংলাদেশের জন্য কেবল কষ্টসাধ্য হয়েছে তা নয়, এখনো দুই লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। অন্যান্য সমস্যা বাদ দিলেও তারা বাংলাদেশের উপর অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রতিকূলতা সৃষ্টি করেছে।

অতএব অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ স্বাভাবিকভাবেই মনে করছে যে নতুন করে এই সমস্যা কিছুতেই আবার সৃষ্টি হতে দেওয়া যায় না। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার অনুরোধের জবাবে তিনি জানান, আমাদের নিজেদেরই সমস্যা অনেক। নতুন করে আর সমস্যা তৈরি করতে চাই না। কিছুতেই আমরা জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেব না। আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও মানবিক কারণে বাংলাদেশ এখনো দুই লক্ষের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে এদেশে থাকতে দিচ্ছে বলেও তিনি জানান।

রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশে সামাজিক, রাজনৈতিক, পরিবেশগত এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। এর আগে ১৯৭৯, ১৯৯১ এবং ১৯৯২ সালে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটে। তখনো মিয়ানমার সরকার তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। সেই সময় অনুপ্রবেশকারী বহু রোহিঙ্গা পরবর্তীতে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে যায় এবং এর ফলে আমাদের শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্থ হয়। শুধু তাই নয়, বিদেশে গিয়ে তারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হয় ব্যাপকহারে ।

 

মিয়ানমার সরকারের ভাষ্য:

মিয়ানমার প্রায় সাড়ে ছয় কোটি মানুষের এবং বর্তমানে সরকারিভাবে স্বীকৃত ১৩৫টি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর একটি দেশ। আশ্চর্য হলেও সত্য, মিয়ানমারের অতীতের সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের একটি স্বতন্ত্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করেছে। যদিও পঞ্চাশের দশকের গণতান্ত্রিক উনু (Unu) সরকার তাদের এই স্বীকৃতিটি দিয়েছিল। ঐতিহাসিক সত্য এই যে রোহিঙ্গা মুসলমান আর রাখাইন বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করেছে।

১৯৭৭ সালে যখন মিয়ানমার সরকার সেই দেশে বহিরাগতদের বেআইনি অনুপ্রবেশ বন্ধ করার জন্য একটি পদক্ষেপ নেয়, তখন রাখাইন বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং মিয়ানমার সরকার অন্যায়ভাবে রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন শুরু করে। ১৯৭৮ এর মে মাস পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু ১৬ মাসের মধ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে তারা স্বদেশে ফিরে যায়। তবে দুভার্গ্যবশত ১৯৮২ সালে সেই 

দেশের সামরিক শাসকেরা এমনভাবে তাদের নাগরিক আইন সংশোধন করে যা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব হতে বঞ্চিত করে। ১৯৯১ সালে তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে দৃষ্টি ফেরানোর জন্য আবার তারা রোহিঙ্গাদের উপর চড়াও হয়। তার ফলে ১৯৯২ এর মার্চের মধ্যে অন্তত ২ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী আবার বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। মিয়ানমারের সামরিক সরকার তখন এদের সন্ত্রাসবাদী বলে আখ্যায়িত করে। এর পর থেকে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশে অনুপ্রেবেশকারী এই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখায়নি। এ প্রেক্ষিতে মিয়ানমারের বর্তমান সামরিক প্রধান থেইন সেইন ২০১২ সালের জুলাই মাসে এক বিবৃতিতে জানান মিয়ানমার সরকার আর কোন রোহিঙ্গাদের সেই দেশে ফিরিয়ে নিবে না।

জাতিসংঘের তৎপরতা:

সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানকল্পে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা UNHCR বিশেষ তৎপরতা শুরু করেছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই ইস্যু সৃষ্টিকারী দেশ মিয়ানমারকে কোন ধরনের চাপ না দিয়ে সংস্থাটি বার বার বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য। UNHCR-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি ক্রেইগ স্যান্ডার্স সম্প্রতি বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ উপেক্ষা করে টেকনাফ সীমান্ত পরিদর্শন করে এসে মানবিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দানের অনুরোধ জানান। জবাবে বাংলাদেশ এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ উপক্ষো করায় সতর্ক করে দিয়ে তার ঐ এলাকায় চলাফেরায় বিধিনিষেধ আরোপ করে।

বাংলাদেশ-মিয়ানমার কূটনৈতিক সম্পর্কের গতিধারা:

'কারো সাথে বৈরিতা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা' বিদেশ নীতির এই মূল বিষয়কে সামনে রেখে বাংলাদেশ বর্তমানে অগ্রসর হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ এখন ভারতের পাশাপাশি পূর্বাঞ্চলের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদারে মনোযোগী হয়েছে। অর্থাৎ 'লুক ইস্ট' পলিসির আওতায় ইন্দোনেশিয়া ও মিয়ানমারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের লক্ষ্যে ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐ দুটি দেশ ভ্রমণ করেন। মিয়ানমারে বর্তমানে স্বল্পমাত্রায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ২০১২ সালের ১ এপ্রিল উপনির্বাচনে অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির অভূতপূর্ব সাফল্য মিয়ানমারের ২০১৫ সালের আগামী নির্বাচনে গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ফলে যখনই বাংলাদেশ মিয়ানমারের সাথে তার কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের চিন্তা-ভাবনা করছে তখনই সাম্প্রতিক এই রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সমস্যা দুই প্রতিবেশি দেশের মধ্যে নতুন করে কূটনৈতিক টানাপোড়েন সৃষ্টি করেছে।

বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে বাণিজ্য বর্তমানে ২০ কোটি ডলারেরও কম। অথচ এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বাণিজ্যের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা তথা কানেক্টিভিটি উন্নত করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এশিয়ান হাইওয়ের ক্ষেত্রে ২০০৭ সালের ৭ জুলাই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের তামব্রু সীমান্ত থেকে বাওয়ালীবাজার পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করছে। বাওয়ালীবাজার থেকে কিয়াউকট পর্যন্ত মিয়ানমারের ভিতরে ১০৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ সরকার বার বার মিয়ানমারকে অনুরোধ জানাচ্ছে। এমতাবস্থায় সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সমস্যা প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যকার এই উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

আবার, প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার হতে বাংলাদেশে গ্যাস আমদানির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। গত দেড় দশক ধরে প্রধানত ভারতের উদ্যোগে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ত্রিদেশীয় পাইপলাইন নির্মাণের প্রস্তাবটি ঝুলে আছে। বাংলাদেশের আগ্রহের অভাবে কাজটি হয়নি। মিয়ানমার এখন রাঙানি করার মত গ্যাস চীনকে সরবরাহ করছে। বাংলাদেশ সুযোগটি হারিয়ে ফেলেছে। এখন মিয়ানমার বলছে, নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কৃত হলে বাংলাদেশে গ্যাস রপ্তানির বিষয়টি বিবেচিত হবে। এমতাবস্থায় রোহিঙ্গা ইস্যুটি তাদের সিদ্ধান্ত বদলে আদৌ প্রভাবিত করে কিনা তাও দেখার বিষয়।

মিয়ানমারে এখন গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশের উচিৎ মিয়ানমারে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল প্রেরণ করা এবং সেই দলটির ম্যূখ উদ্দেশ্য হবে মিয়ানমার সরকারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য আলোচনা করা এবং সেই উদ্দেশ্যে তাদের রাখাইন প্রদেশে এমন একটি অবস্থা সৃষ্টির জন্য চাপ দেওয়া যাতে করে সেই প্রদেশের উত্তেজনা উপচে পড়ে দুই দেশের সম্পর্ক ব্যহত না করে। অতীতে রোহিঙ্গারা যেসব দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গেও বাংলাদেশ এই বিষয়ে আলোচনা এবং যৌথ পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নিতে পারে। একই সাথে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি নেতাদেরও উচিৎ রোহিঙ্গাদের প্রতি যাতে আগামীর মিয়ানমার সরকার একটি বাস্তবধর্মী নীতি গ্রহণ করে তার উপর জোর দেওয়া ।

 

 


Post a Comment

Previous Post Next Post