হুনাইন যুদ্ধের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল আলোচনা করঃ
মহানবি (সা.) মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে কাবাঘর
থেকে পৌত্তলিকতা ও মূর্তিপূজার অবসান ঘটান।মহানবি (সা.) প্রায় বিনা বাধায় মক্কা
বিজয় করলে ইসলাম দ্রুত মক্কার আশপাশে বিস্তার লাভ করে। ইসলামের বিস্তারে মক্কা ও তায়েফের
মধ্যবর্তী স্থানে বসবাসকারী বনু হাওয়াজিন ও বনু সাকিফসহ বেদুইন গোত্রগুলো ভীত হয়ে
পড়ে। তারা নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় কাবাঘরে পুনরায় মূর্তি স্থাপনের জন্য মুসলমানদের
বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মহানবি (সা.) ইসলামের এই শত্রুদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য ৬৩০
খ্রিস্টাব্দে হুনাইন যুদ্ধ পরিচালনা করেন।হুনাইন যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হলে বেদুইনরা
আর কখনও ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে সাহস দেখায়নি।
হুনাইন যুদ্ধের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল : হুনাইন যুদ্ধের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. মক্কা বিজয় :
মহানবি (সা.) ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রায়
বিনা বাধায় মক্কা বিজয় করেন। মক্কা বিজয় করে কাবাঘরে স্থাপিত ৩৬০টি মূর্তি অপসারণ
করেন। মহানবি (সা.) কাবাঘর থেকে মূর্তি অপসারণের মাধ্যমে পৌত্তলিকতার অবসান ঘটান। মহানবি
(সা.) মক্কা থেকে পৌত্তলিকতার অবসান ঘটালে আশেপাশের পৌত্তলিক বেদুইনরা চিন্তায় পড়ে
যায়। তারা ধারণা করে যে, এরপর তাদের নির্মূল করা হবে। ফলে তারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার
জন্য ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে । ফলে হুনাইন যুদ্ধ ত্বরান্বিত হয়।
২. বেদুইনদের সাথে মিত্রতা :
মুসলমানদের মক্কা বিজয়ের পর তায়েফ ও
মক্কার মধ্যবর্তী বনু হাওয়াজিন ও বনু সাকিফ গোত্র ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য যুদ্ধের
প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের জন্য আরবের বেদুইনদের
সাথে মিত্রতা স্থাপন করে। বনু হাওয়াজিন ও বনু সাকিফ গোত্র বেদুইনদের সহায়তায় মুসলমানদের
বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে। ফলে হুনাইন যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে.
৩. অনৈক্য :
মক্কার কুরাইশদের সাথে তায়েফের বনু সাকিফ
ও বনু হাওয়াজিনের বাণিজ্যিক বিরোধ চলছিল। মহানবি (সা.) মক্কা বিজয় করলে এ বিরোধ আরও
বৃদ্ধি পায়। মহানবি (সা.) এই সুযোগ গ্রহণ করে তাদের ধ্বংস করার জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি
গ্রহণ করেন। ফলে হুনাইন যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
হুনাইন যুদ্ধের ঘটনা :
ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলমানরা
মহানবি (সা.)-এর নেতৃত্বে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা জয় করলে কয়েকটি সম্প্রদায় তখনও
ইসলামের এ বিজয়কে মেনে নেয়নি। মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী অঞ্চলে বসবাসরত এসব গোত্রের
মধ্যে বনু হাওয়াজিন ও বনু সাকিফ গোত্রদ্বয় শীঘ্রই মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ
করে। এসময় এ গোত্রদ্বয় কাবাগৃহে আবার পৌত্তলিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য পার্শ্ববর্তী
কতিপয় বেদুইন গোত্রের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে ২০,০০০ সৈন্যসহ মক্কার তিন মাইল দূরে
হুনাইন উপত্যকায় সৈন্য সমাবেশ করে। এমতাবস্থায় মহানবি (সা.) ১২,০০০ সৈন্যের একটি
মুসলিম বাহিনী নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য অগ্রসর হন।
কিন্তু হুনাইন উপত্যকার পাহাড়ি পথ পার হওয়ার সময়
হঠাৎ পর্বত গুহায় লুকিয়ে থাকা বেদুইন সৈন্যরা মুসলমানদের ওপর তীর নিক্ষেপ করলে মুসলিম
সেনাদের অনেকে আহত হয়ে পলায়ন করেন। এ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে মহানবি (সা.)-এর আহ্বানে
সাড়া দিয়ে সৈন্যরা ফিরে আসলে মহাবীর খালিদ বিন ওয়ালিদ মুসলিম সৈন্যদের নিয়ে যুদ্ধে
ঝাঁপিয়ে পড়েন। হযরত আলি ও খালিদ বিন ওয়ালিদ বীরত্ব এবং মহানবি (সা.)-এর নেতৃত্বগুণে
মুসলিম বাহিনী চূড়ান্তভাবে জয়ী হয়। প্রায় ৬,০০০ শত্রুসেনা বন্দি হয় এবং ২৪,০০০
ভেড়া, ২৮,০০০ উট, ৪১,০০০ তোলা রুপাসহ বিপুল পরিমাণ যুদ্ধাস্ত্র ও গনিমত মুসলমানদের
হস্তগত হয়। অন্যদিকে, মাত্র ৪-৫ জন মুসলিম সেনা এ যুদ্ধে শহিদ হন ।
হুনাইন যুদ্ধের ফলাফল : হুনাইন যুদ্ধের ফলাফল নিম্নরূপ :
১. বেদুইনদের পরাজয় :
হুনাইন যুদ্ধে আরবের বেদুইনরা একজোট হয়ে
ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ২০,০০০ সৈন্যের বিশাল বাহিনী গঠন করে । কিন্তু এ যুদ্ধে
তারা মুসলমানদের নিকট পরাজিত হওয়ার পর আর কখনও এত বিশাল বাহিনী গঠন করতে পারেনি। ফলে
মুসলমানরা নির্বিঘ্নে ইসলাম প্রচার করতে পারে।
২. বনু হাওয়াজিন ও বনু সাকিফ গোত্রের বশ্যতা স্বীকার:
হুনাইন যুদ্ধে বিশাল বাহিনী নিয়ে পরাজিত হওয়ার
পর বনু হাওয়াজিন ও বনু সাকিফ গোত্রদ্বয় মুসলমানদের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। তারা
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে বসবাস করতে থাকে। ৩. বেদুইনদের বশ্যতা স্বীকার : হুনাইন যুদ্ধে
২০,০০০ সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে পরাজিত হওয়ার পর বেদুইনরা মুসলমানদের বশ্যতা ও
আনুগত্য স্বীকার করে। তারা আর কখনও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করার সাহস দেখায়নি।
ঐতিহাসিক এম ওয়াট বলেন, “এরপর যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন, ততদিন আরবের
সব অঞ্চলের প্রতিনিধি দল সাথে মৈত্রী স্থাপন ও একাত্মতা ঘোষণা করতেই ব্যস্ত ছিল।”
৪. ইসলামের দ্রুত প্রসার :
মহানবি (সা.) হুনাইন যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার
ফলে আরবের অন্য কোনো গোত্র ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে সাহস করেনি। এই যুদ্ধের
পর আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গোত্র প্রতিনিধিরা এসে মহানবি (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে
তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে নেয়। ফলে গোটা আরবে ইসলামকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো শক্তি
অবশিষ্ট ছিল না। এতে ইসলাম সারা আরবে দ্রুত বিকাশ লাভ করে ।
৫. মুসলমানদের
ধৈর্য পরীক্ষা :
হুনাইন যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী শত্রুপক্ষকে প্রথমে
খুব হালকাভাবে নেয়। ফলে তাদের ওপর প্রাথমিক বিপর্যয় নেমে আসে। মুসলমানদের অনেকে আহত
হয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করেন। এতে মুসলিম বাহিনী কঠিন বিপদে পতিত হয়।
৬. মহানবি (সা.)-এর দৃঢ় নেতৃত্ব :
হুনাইন যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী প্রাথমিকভাবে
বিপর্যয়ের মুখে পড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এই বিপদের সময়ে মহানবি (সা.) বিচলিত না
হয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান। মহানবি (সা.)-এর দৃঢ়তা ও সাহস দেখে মুসলিম
বাহিনী আবার যুদ্ধের ময়দানে ফিরে আসে। ফলে যুদ্ধের মোড় পরিবর্তন হয়ে যায় । হুনাইন
যুদ্ধের মাধ্যমে মহানবি (সা.)-এর দৃঢ় নেতৃত্বের আরেকবার পরিচয় মিলে।
৭. মুসলমানদের অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ:
হুনাইন যুদ্ধে মুসলমানরা বেদুইনদের পরাজিত
করে বিপুল পরিমাণ গনিমত লাভ করে। এ যুদ্ধে মুসলমানরা শত্রুদের ২৪,০০০ ভেড়া, ২৮,০০০
উট, ৪১,০০০ তোলা রুপাসহ বিপুল পরিমাণ যুদ্ধাস্ত্র গনিমত হিসেবে লাভ করে। এতে বিপুল
পরিমাণ গনিমত মুসলমানদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয় ।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, হুনাইন
যুদ্ধ ছিল আরবের বেদুইন গোত্রসমূহের মহানবি (সা.)-এর বিরুদ্ধে পরিচালিত সর্বশেষ যুদ্ধ।
কঠিন বিপদের মুহূর্তে মুসলিম বাহিনী ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে আল্লাহর রহমতে বিজয় অর্জন
করে। এ যুদ্ধের পর আরবের বেদুইন গোত্রসমূহ পরবর্তীতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ
করতে সাহস করেনি। তারা এ যুদ্ধে মহানবি (সা.)-এর আনুগত্য স্বীকার করে নেয়। ফলে ইসলাম
দ্রুত সারাবিশ্বে বিকাশ লাভ করে এবং ইসলাম পৃথিবীর অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিতে রূপান্তরিত
হয়।