হুদায়বিয়া সন্ধির কারণ, হুদায়বিয়া সন্ধির শর্তাবলি ও ফলাফল বর্ণনা কর:
মহানবি হযরত মুহম্মদ (সা.) ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে
চৌদ্দশ সাহাবি নিয়ে মক্কায় ওমরাহ পালনের জন্য গমন করেন । কিন্তু পথিমধ্যে হুদায়বিয়া
নামক স্থানে মক্কার কুরাইশগণ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হন। মক্কার কুরাইশদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত
হওয়ার পর সেখানে উভয়পক্ষ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটি সন্ধি করে। ইতিহাসে এটা 'হুদায়বিয়া
সন্ধি' নামে পরিচিত। এ সন্ধিতে স্বাক্ষর করে মহানবি (সা.) এক অসাধারণ রাজনৈতিক প্রতিভা
ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। তাই হুদায়বিয়ার সন্ধি মহানবি (সা.)-এর জীবনের ‘Land Mark' বা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত।
আল কোরআনে একে 'ফাতহুম মুবিন’ বা স্পষ্ট বিজয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
হুদায়বিয়ার সন্ধির কারণ ও ফলাফল : নিম্নে হুদায়বিয়ার সন্ধির কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
হুদায়বিয়ার সন্ধির কারণ : হুদায়বিয়া সন্ধির কারণসমূহ নিম্নে বর্ণনা করা হলো :
১. মহানবি (সা.)-এর স্বপ্ন :
মহানবি (সা.) ৬২২ খ্রিস্টাব্দে নিজ বাসভূমি
মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করেন । মদিনায় হিজরতের দীর্ঘ ছয় বছর পর ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে
স্বপ্নে দেখেন যে, তিনি সাহাবিদের নিয়ে কাবাশরিফ তাওয়াফ করছেন। মহানবি (সা.) স্বপ্নে
হজ করার প্রত্যাদেশ লাভ করে কাবাশরিফ তাওয়াফের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ।
২. খালিদ বিন ওয়ালিদ ও ইকরামা বিন আবু জেহেলের নেতৃত্বে বাধা দান :
মক্কার কুরাইশরা চৌদ্দশ সাহাবি নিয়ে হযরত
মুহম্মদ (সা.)-এর মক্কা আগমনের সংবাদ জানতে পেরে ভীত ও রাগান্বিত হয়ে ওঠে। তারা মহানবি
(সা.)-কে বাধাদানের জন্য খালিদ বিন ওয়ালিদ ও ইকরামা বিন আবু জেহেলের নেতৃত্বে সৈন্য
প্রেরণ করে।
৩. মহানবি (সা.)-এর হুদায়বিয়া আগমন :
মহানবি (সা.) মক্কার উদ্দেশে ওমরাহ পালন
করার জন্য বের হয়েছিলেন। কিন্তু মক্কার কুরাইশরা মুসলমানদের বাধা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি
নেন। মহানবি (সা.) খোজা সম্প্রদায়ের বোদাইলের মাধ্যমে মক্কার কুরাইশদের প্রস্তুতির
কথা জানতে পারেন। মক্কার কুরাইশরা মুসলমানদের বাধা দেওয়ার প্রস্তুতি নিলে মহানবি
(সা.) মক্কার ৯ মাইল অদূরে হুদায়বিয়া নামক স্থানে তাঁবু ফেলে শিবির স্থাপন করেন ।
৪. আবওয়া বিন মাসুদের দুর্ব্যবহার :
মহানবি (সা.) কুরাইশদের নিকট বোদাইলকে প্রেরণ করলে
তারা সন্ধির জন্য আবওয়া বিন মাসুদকে মহানবি (সা.)-এর নিকট প্রেরণ করেন। কিন্তু আবওয়া
বিন মাসুদের দুর্ব্যবহারের কারণে সন্ধি হয়নি।
৫. হযরত ওসমান (রা.) হত্যার গুজব :
আবওয়া বিন মাসুদের কারণে সন্ধি করতে ব্যর্থ
হলে মহানবি (সা.) প্রথমে খেরাস বিন উমাইয়া ও পরে হযরত ওসমান (রা.)-কে সন্ধির জন্য
কুরাইশদের নিকট প্রেরণ করেন। কুরাইশরা হযরত ওসমান (রা.)-কে আটকে রাখে। তখন গুজব ছড়িয়ে
পড়ে যে, কুরাইশরা হযরত ওসমান (রা.)-কে হত্যা করেছে। মুসলমানদের নিকট হযরত ওসমান (রা.)
হত্যার গুজব ছড়িয়ে পড়লে তারা খুব মর্মাহত হন। তখন মহানবি (সা.)সহ সব মুসলমান ইহরাম
খুলে হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর হাতে শপথ গ্রহণ করে যে, তারা হযরত ওসমান (রা.)-এর হত্যার
প্রতিশোধ না নিয়ে মদিনা ফিরে যাবে না। ইতিহাসে এটি ‘বায়আতে রিদওয়ান' নামে পরিচিত।
এ শপথ বাবলা গাছের নিচে হয়েছিল বিধায় একে ‘বায়তুস শাজারা'ও বলা হয় ।
৬. সুহাইল বিন আমরের সন্ধির প্রস্তাব :
মুসলমানরা হযরত ওসমান (রা.)-এর হত্যার
বদলা নেওয়ার শপথ গ্রহণ করলে মক্কার কুরাইশরা ভয় পেয়ে যায়। তারা তাড়াতাড়ি হযরত
ওসমান (রা.)-কে মুক্তি প্রদান করে। হযরত ওসমান (রা.)-কে মুক্তি দিয়ে কুরাইশরা সুহাইল
বিন আমরকে সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে মহানবি (সা.)-এর নিকট প্রেরণ করে। সুহাইল বিন আমর
এসে দীর্ঘ আলোচনা করে মুসলমানদের সাথে ‘হুদায়বিয়া সন্ধি’ স্বাক্ষর করেন ।
হুদায়বিয়া সন্ধির শর্তাবলি :
৬২৮ খ্রিস্টাব্দে হুদায়বিয়া নামক স্থানে
মুসলমান ও কুরাইশদের মধ্যে স্বাক্ষরিত হুদায়বিয়া সন্ধির শর্তসমূহ নিম্নে তুলে ধরা
হলো :
১. চলতি বছর অর্থাৎ ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানগণ
হজ পালন না করে মদিনায় ফিরে যাবে।
২. পরবর্তী বছর মুসলমানগণ হজ করতে পারবে কিন্তু তিনদিনের বেশি মক্কায় অবস্থান করতে পারবে না। এ সময় মুসলমানগণ হজ করতে আসলে কুরাইশরা ঐ তিনদিন মক্কার বাইরে অবস্থান করবে।
৩. হজের উদ্দেশ্যে মুসলমানদের মক্কায়
আগমনকালে তারা কেবল নিজ নিজ আত্মরক্ষার জন্য কোষবদ্ধ তরবারি ব্যতীত অন্যকোনো মারণাস্ত্র
সাথে আনতে পারবে না ।
৪. পরবর্তী দশ বছর যুদ্ধ বন্ধ থাকবে ।
৫. কোনো মক্কাবাসী অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিরেকে
মদিনায় আশ্রয় প্রার্থনা করলে মদিনার মুসলমানগণ তাকে আশ্রয় দিতে পারবে না । পক্ষান্তরে,
কোনো মুসলমান মদিনা থেকে মক্কায় চলে আসলে মক্কাবাসীর ওপর তাকে প্রত্যার্পণের কোনো
দায়িত্ব বর্তাবে না ।
৬. আরবের যেকোনো গোত্র ইচ্ছা করলে মুসলমান
বা কুরাইশদের সাথে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হতে পারবে। এতে কোনো পক্ষই কোনো আপত্তি করতে পারবে
না ।
৭. মক্কার কোনো নাবালেগ তার অভিভাবকের
অনুমতি ব্যতীত মুসলিমদের দলে যোগ দিতে পারবে না, যদি যোগ দেয় তাহলে মুসলিমরা তাকে
ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে ।
৮. হজের সময় কুরাইশগণ মুসলমানদের জানমালের
নিরাপত্তা বিধান করবে।
৯. মক্কার বণিকরা নির্বিঘ্নে মদিনার পথ দিয়ে
সিরিয়া, মিসর প্রভৃতি দেশে বাণিজ্য করতে পারবে।
১০. চুক্তির মেয়াদকালে জনসাধারণের পূর্ণ
নিরাপত্তা রক্ষিত হবে এবং একে অপরের কোনো প্রকার ক্ষতি করতে পারবে না।
১১. এ সন্ধি আগামী দশ বছর স্থায়ী হবে।
১২. সন্ধির শর্তাবলি উভয়পক্ষ কর্তৃক পুরোপুরি
পালিত হবে। কোনো পক্ষ সন্ধি চুক্তির একটি শর্তও ভঙ্গ করলে পুরো চুক্তিপত্র বাতিল বলে
বিবেচিত হবে।
হুদায়বিয়া সন্ধির ফলাফল
হুদায়বিয়া সন্ধির ফলাফল : হুদায়বিয়া সন্ধির ফলাফল নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১. সুস্পষ্ট বিজয় :
হুদায়বিয়া সন্ধির শর্তাবলি আপাতদৃষ্টিতে মুসলমানদের জন্য অপমানকর ছিল। কিন্তু গভীরভাবে এ শর্তগুলো পরবর্তীতে ইসলামের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এ সন্ধির পর দ্রুত ইসলামের বিকাশ ঘটিয়ে মুসলমানরা মক্কা বিজয় করেন। এজন্য আল কোরআনে আল্লাহ তাআলা এ সন্ধিকে 'ফাতহুম মুবিন' বা সুস্পষ্ট বিজয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন ।
২. মহানবি (সা.)-কে নেতা হিসেবে স্বীকৃতি :
হুদায়বিয়ার সন্ধিতে স্বাক্ষরের মাধ্যমে মক্কার কুরাইশরা সর্বপ্রথম মহানবি (সা.)-কে মদিনার রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে লিখিত স্বীকৃতি প্রদান করে। এতে মুহম্মদ (সা.)-এর সম্মান ও মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি পায় । তিনি দ্রুত বিশ্বনেতায় পরিণত হন ।
৩. শ্রেষ্ঠ বীর ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ইসলাম গ্রহণ :
হুদায়বিয়ার সন্ধির পর শ্রেষ্ঠ বীর খলিদ বিন ওয়ালিদ, আমর বিন আস ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ফলে ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি পায়। এ সম্পর্কে পি. কে. হিট্টি বলেন, “খালিদ ও আমর ইসলামের সামরিক অভিযানে শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিলেন।" এ সন্ধি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরই মক্কার বনু খোজা সম্প্রদায় মুহম্মদ (সা.)-এর সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে এবং পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে । পরে বিভিন্ন গোত্রের লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি পায়।
৪. ইসলামের প্রসার :
এ সন্ধির ফলে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের পথ প্রশস্ত হতে থাকে। ইসলামের সৌন্দর্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য | বুঝতে পেরে কুরাইশরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। উনিশ বছর কঠোর পরিশ্রমের ফলে যেখানে মুসলমানদের সংখ্যা হয়েছিল মাত্র চৌদ্দশ সেখানে হুদায়বিয়ার সন্ধির দুই বছর পর মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০,০০০ জনে। হুদায়বিয়া সন্ধির ফলে মুসলমানগণ আরবের বাইরে বিভিন্ন দেশের রাজদরবারে গমন করে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকে। ফলে অল্পদিনের মধ্যে ইসলাম ধর্ম আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিস্তার লাভ করে ।
৫. মক্কা বিজয়ের সূচনা :
ঐতিহাসিক এম. ওয়াট বলেন, “হুদায়বিয়ার সন্ধির ফলে
মক্কাবাসী মদিনা প্রজাতন্ত্রকে স্বাধীন রাষ্ট্র এবং মুহম্মদ (সা.)-কে রাষ্ট্রপ্রধান
হিসেবে স্বীকার করে নেয়।” অন্যদিকে, দশ বছর যুদ্ধ বন্ধ থাকার নিশ্চয়তা লাভের ফলে
মুসলমানরা ইসলামের প্রসার ও মদিনা রাষ্ট্রের ভীত মজবুত করে নেয় । এ সন্ধির পর ইসলাম
দ্রুত বিকাশ লাভ করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিস্তৃতি লাভ করে। হুদায়বিয়ার সন্ধির
পর মাত্র ২ বছরের ব্যবধানে মহানবি (সা.) ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয়
করেন।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়
যে, আপাতদৃষ্টিতে এ সন্ধিকে কুরাইশদের অনুকূলেই সম্পাদিত হয়েছে বলে মনে হয় । কিন্তু
দূরদৃষ্টিতে বিচার করলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এটি সর্বোতভাবে মুসলিম স্বার্থের
অনুকূলে হয়েছিল। এ সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করে মহানবি (সা.) অসাধারণ প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার
পরিচয় দেন। মহানবি (সা.) এই সন্ধি স্বাক্ষরের মাধ্যমে যুদ্ধবিগ্রহ থেকে নিষ্কৃতি লাভ
করেন। ফলে ইসলাম দ্রুত সারা বিশ্বে বিকাশ লাভ করে। মুসলমানরা অল্পসময়ে, অর্থাৎ মাত্র
২ বছর পর বিনা রক্তপাতে মক্কা জয় করেন।