কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের ইতিহাস- একটি আলোচনা।

কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের ইতিহাস- একটি আলোচনা।

ভূমিকা :


পঞ্চদশ শতকে কলম্বাস কর্তৃক আমেরিকা আবিষ্কার একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। প্রাচ্যের জলপথ আবিষ্কারের জন্য বের হয়ে এ দুঃসাহসী ইতালিয়ান নাবিক ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে সানসালভেদরে এসে পৌঁছান এবং আবিষ্কার করেন এক বিপুল সমৃদ্ধিশীল ও প্রাচুর্যময় মহাদেশ। এ দুঃসাহসী অভিযানের পিছনে আছে এক আকর্ষণীয় ইতিহাস। তার নিজের অদম্য ইচ্ছা ও রাজা-রানির পৃষ্ঠপোষকতা তাকে এ অভিযানে আরও উদ্বুদ্ধ করে।

 

কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের কাহিনি : 


স্পেনীয় রাজদম্পতি ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলার একান্ত উৎসাহে ও সহযোগিতায় ক্রিস্টোফার কলম্বাস তার মহাদেশ আবিষ্কারের যাত্রা শুরু করেন। যদিও তিনি জানতেন না যে, তিনি নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কার করেছেন । কিন্তু তার আবিষ্কৃত নতুন ভূখণ্ড বর্তমানে বিশ্বের পরাশক্তিধর দেশ। নিম্নে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের কাহিনি আলোচনা করা হলো :


১. কলম্বাসের পরিচয় : 


কলম্বাসের পুরোনাম ক্রিস্টোফার কলম্বাস। তিনি ছিলেন ইতালীয় নাবিক, তিনি ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে ইতালির জেনোয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন পোশাক বয়ন শিল্পী। কলম্বাস স্পেন সরকারের চাকরি করলেও সমুদ্র অভিযানের প্রতি তার ছিল অদম্য আগ্রহ। তিনি স্পেনের রাজা-রানির পৃষ্ঠপোষকতায় তার অদম্য দুঃসাহসিক অভিযান শুরু করেন এবং তাতে তিনি সফলও হন।


২. নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারের উদ্দেশ্য :


ভৌগোলিক আবিষ্কারের যুগে ক্ষমতাধর দেশসমূহে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারের জন্য মনস্থির করে। এ সময় প্রাচ্য দেশের প্রাচুর্যের কথা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এ প্রাচ্য দেশে সহজে আসার জন্য বিভিন্ন নাবিক অবিরত চেষ্টা চালিয়ে যায়। এর ধারাবাহিকতায় কলম্বাসও প্রাচ্য দেশের জলপথ আবিষ্কারের জন্য বের হন কিন্তু ঘটনাক্রমে তিনি একটি নতুন ভূখণ্ড আমেরিকা আবিষ্কার করেন।


৩. রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ : 


সমুদ্র অভিযান ঐ সময় কোনো সাধারণ ব্যাপার ছিল না। এক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল প্রচুর অর্থ ও প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জম যা ছিল অতি ব্যয়বহুল। ফলে কলম্বাসের নিজের পক্ষে, এসব জোগাড় করা সম্ভব না হওয়ায়, তিনি স্পেনের রাজদম্পতি রাজা ফার্ডিন্যান্ড ও রানি ইসাবেলার আনুকূল্যের জন্য আবেদন করেন। ফলে রাজদম্পতির আনুকূল্যে পর্যাপ্ত অর্থ ও প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম তিনি যোগাড় করতে সক্ষম হন। এবং রাজদম্পতি ঘোষণা দেন যে, সমুদ্র অভিযানে কলম্বাস কোনো দেশ আবিষ্কার করতে পারলে তাকে রাজপ্রতিনিধি করা হবে এবং মহাসমুদ্রের অ্যাডমিরাল' পদে ভূষিত করা হবে।

 

 ৪. নৌবহর গঠন : 


কলম্বাস তার অভিযানের জন্য একটি দক্ষ নৌবহর গঠন করেন। এতে ৯০ জন বাছাই করা স্পেনীয় দাঁড় মাঝি সমৃদ্ধ ৭০৮০ ফুট লম্বা তিনটি বেশ শক্তিশালী জাহাজ সংগ্রহ করেন। যার নাম ছিল নিনা, পিন্টা ও সান্টামারিয়া । তাদের সাথে নেওয়া হয় উন্নত মানের মানচিত্র এবং শক্তিশালী কম্পাস । যার মাধ্যমে সঠিক দিক নির্ণয় করা যায়।


৫. জলপথ আবিস্কারে কলম্বাসের যাত্রা :


১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ৩ আগস্ট কলম্বাস পালোস বন্দর হতে যাত্রা শুরু করেন, সাথে ছিল অভিজ্ঞ নাবিকগণ এবং শক্তিশালী নৌজাহাজ।দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত বাতাসের ধাক্কায় জাহাজগুলো এগিয়ে চলে। পথে অসংখ্য বাধার মধ্য দিয়ে তারা সমুদ্রযাত্রা করেন।


৬. প্রবল ঝড়ের সম্মুখীন :


১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে কলম্বাস তার দুঃসাহসিক অভিযান শুরু করেন । মাঝ পথে কলম্বাসের নৌবহর প্রবল ঝড়ের সম্মুখীন হয়। এতে দুটি জাহাজ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয় । এবং তাদের রসদও বিপুল পরিমাণে নষ্ট হয়। তবুও তারা নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারের লক্ষ্যে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। একপর্যায়ে তারা তা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়। 


৭. নতুন ভূখণ্ড বা আমেরিকা আবিষ্কার :


কলম্বাস তার নৌবহরসহ অবশেষে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ১১ অক্টোবর গভীর রাতে দূরে হালকা আলো দেখতে পান। সম্ভবত দ্বীপের অধিবাসীরা সেখানে আগুন জ্বালিয়েছিল। ১২ অক্টোবর তারিখে অভিযাত্রীরা তীরে নতুন ভূখণ্ড দেখতে পান। তারা মনে করেছিল, এটি হয়তো প্রাচ্যের ইন্ডিয়া। কিন্তু তারা মূলত পৌঁছেছিল বাহামা দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত সানসালভেদরে ।


৮. আবিষ্কার নিয়ে বিতর্ক : 


কলম্বাস নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারকে প্রাচ্যের ইন্ডিয়া আবিষ্কার মনে করে পরের বছর স্পেনে ফিরে যান। এবং তিনি সমুদ্রপথের ও নতুন ভূখণ্ডের অবস্থা বর্ণনা করেন। কিন্তু তার বর্ণনার সাথে প্রাচ্যের কোনো মিল পাওয়া না যাওয়ায় আবিষ্কার নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। যদিও কলম্বাস নিজে দাবি করছেন তিনি প্রাচ্য দেশে গেছেন। কিন্তু অন্যান্যরা দাবি করেন তিনি নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কার করেন, যা প্রাচ্য দেশ ছিল না।


৯. আমেরিকার নামকরণ : 


কলম্বাস যেমন স্পেনের রাজার সাহায্যে সমুদ্র যাত্রা করেন, আমেরিগো ভেসপুচি তেমনি পর্তুগালের পতাকা নিয়ে ১৫০১ ও ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে যাত্রা করে দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলে গিয়ে উপস্থিত হন। ভেসপুচির নিজের সমুদ্রযাত্রার বিষয়ের ওপর লেখা এতই প্রসিদ্ধ লাভ করে যে, তাকেই দক্ষিণ আমেরিকার আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় । আর আমেরিকা আবিষ্কারক হিসেবে আমেরিগোর নাম অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রের নামকরণ করা হয় আমেরিকা নামে ।


উপসংহার :


উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আমেরিকা আবিষ্কার ইতিহাসের খুবই আকর্ষণীয় এক অধ্যায়। এ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে বর্তমান আমেরিকা বিশ্বের এক পরাশক্তিতে পরিণত হয়। আর কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার পরবর্তীতে অনেক নাবিককে সমুদ্রযাত্রায় অনুপ্রাণিত করে। ফলে আরও অনেক নতুন ভূখণ্ড, নতুন জলপথ আবিষ্কার হয়। যার মাধ্যমে সারা বিশ্বে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভাব ব্যাপকতা লাভ করে ।

Post a Comment

Previous Post Next Post