মজলিস উস শুরা কী? মজলিস উস শুরার কার্যাবলি কি কি ছিল? ২০২৪ খ্রি।

মজলিস উস শুরা কী? মজলিস উস শুরার কার্যাবলি কি কি ছিল? ২০২৪ খ্রি।

মজলিস উস শুরা কী? 

ভূমিকা : 

হযরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল মজলিস উস শুরা। এ ব্যবস্থা ছিল রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের প্রধান চাবিকাঠি । মজলিস উস শুরার পরামর্শ ব্যতীত হযরত ওমর (রা.) রাষ্ট্রের কোনো কাজ সম্পাদন করতেন না। তবে প্রাক ইসলামি যুগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত মজলিস উস শুরা বিদ্যামান থাকায় তা প্রশাসন ব্যবস্থায় যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা প্রমাণিত ।

মজলিস উস শুরা : নিম্নে মজলিস উস শুরা এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

১. মজলিস উস শুরার পরিচয় : 

মজলিস উস শুরা আরবি শব্দ। মজলিস' অর্থ বসার স্থান তথা সভা, সমিতি, পরিষদ। শুরা' শব্দের অর্থ পরামর্শ, মন্ত্রণা। মজলিস উস শুরা শব্দের অর্থ পরামর্শ সভা বা পরামর্শ পরিষদ। জনগণের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি ও স্বচ্ছভাবে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.) যে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রণা পরিষদ গঠন করেন তা মজলিস উস শুরা নামে পরিচিত ।

২. মজলিস উস শূরার প্রকারঃ 

মজলিস উস শুরা দুই ভাগে বিভক্ত । যথা : মজলিসে আম এবং মজলিসে মাস। নিম্নে এ প্রকার মজলিসের পরিচয় তুলে ধরা হলো :

ক. মজলিসে আম : 

মজলিসে আম বা সাধারণ পরিষদে বৈঠক আহ্বান করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলিসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতো। প্রাদেশিক শাসকগণ, মদিনার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, মুহাজির ও আনসারগণ এ পরিষদের সদস্য ছিলেন। মজলিসে আমের অধিবেশনে উপস্থিত সব মুসলমানের পরামর্শ গ্রহণ করা হতো ।

খ. মজলিসে খাস : 

মজলিসে খাস বা উচ্চ পরিষদ কিছুসংখ্যক বিশিষ্ট মোহাজেরিনদের নিয়ে গঠিত ছিল। হযরত ওসমান, আলি, তালহা, জুবায়ের (রা.) প্রমুখ সাহাবি এ পরিষদের সদস্য ছিলেন। রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কার্য পরিচালনার জন্য এ পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হতো ৷

৩. মজলিস উস শুরার অধিবেশন প্রক্রিয়া : 

মজলিস উস শুরার অধিবেশনের শুরুতে জনৈক ঘোষণাকারী 'আসসালাতু জামিআতুন' বলে ঘোষণা দিতেন। ঘোষণার পর মসজিদে নববিতে জনসাধারণ সমবেত হতেন। এরপর হযরত ওমর (রা.) সেখানে পৌঁছে সবাইকে নিয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করতেন এবং মিম্বরে বসে উপস্থিত সমস্যার ওপর আলোকপাত করতেন।

অতএব বলা যায় যে, হযরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে মজলিস উস শুরা ছিল গণতন্ত্রের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। এ ব্যবস্থার সমন্বয়ে সৃষ্ট সুশৃঙ্খল প্রশাসন কাঠামো হযরত ওমর (রা.)-এর শাসনব্যবস্থাকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। হযরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে জনসাধারণের সমর্থনে প্রতিষ্ঠিত শাসনব্যবস্থা সর্বদা প্রশংসনীয় ।

 মজলিস উস শুরার কার্যাবলিঃ

ইসলামি শাসনব্যবস্থায় মজলিস উস শুরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। রাজ্য শাসনের ব্যাপারে জনগণের পরামর্শ নিয়ে সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য পরিচালনার মাধ্যম হিসেবে মজলিস উস শুরা কাজ করে। মজলিস উস শুরার পরামর্শ ব্যতীত হযরত ওমর (রা.) তার শাসনকার্য পরিচালনা করতেন না। এর মাধ্যমে হযরত ওমর (রা.)-এর গণতান্ত্রিক মনোভাবের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ।

মজলিস উস শুরার কার্যাবলি : নিম্নে মজলিস উস শুরার কার্যাবলি উল্লেখ করা হলো 

১. রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কার্য পরিচালনায় পরামর্শ দান : 

হযরত ওমর (রা.) মজলিসে খাসের পরামর্শ গ্রহণ করে রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কার্য পরিচালনা করতেন। তিনি বলতেন, খিলাফত তথা রাষ্ট্রপরিচালনার কাজ পরামর্শ ছাড়া সুষ্ঠুভাবে হতে পারে না ।

২. জটিল সমস্যার সমাধান : 

যেকোনো জটিল সমস্যার সমাধানে মজলিসে আমের সভা আহ্বান করা হতো। হযরত ওমর (রা.) কাসেসিয়া যুদ্ধের পূর্বে এবং ইরাক ও সিরিয়ার ভূমি বন্টনের ব্যাপারে সাধারণ সভা আহ্বান করেন।

৩. সামরিক ক্ষেত্রে পরামর্শ দান :

মজলিস উস শুরা সামরিক ক্ষেত্রে পরামর্শ প্রদান করতো। যুদ্ধে অংশগ্রহণ, অধিনায়ক প্রেরণ, যুদ্ধ পরিচালনার কৌশল নির্ধারণ, সেনাবাহিনীর অফিসারদের নিয়োগ, বদলি, বরখাস্ত প্রভৃতি কাজে পরামর্শ গ্রহণ করা হতো। 

৪. রাজস্ব সংক্রান্ত পরামর্শ দান : 

হযরত ওমর (রা.)-এর রাজ্য সম্প্রসারণ নীতির ফলে জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। মজলিস শূরার সদস্যরা রাজস্বসংক্রান্ত পরামর্শ প্রদান করতেন।

৫. বিচারকার্যে পরামর্শ দান : 

হযরত ওমর (রা.) নিরপেক্ষ বিচারক ছিলেন। তিনি মজলিস উস শূরার পরামর্শ গ্রহণ করে।

পরিশেষে বলা যায় যে, ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.)-এর শাসনব্যবস্থা ইসলামের ইতিহাসে আদর্শ শাসন ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত।  তিনি মজলিস উস  সুরার মতামত গ্রহণ করে ইনসাফভিত্তিক শাসন প্রতিষ্ঠিত করেন। যা তাঁকে পৃথিবীর ইতিহাসে আদর্শিক শাসকদের শ্রেষ্ঠ আসনে আসীন করেছে। 

খালিদ বিন ওয়ালিদের পরিচয় দাও।

ভূমিকা :

ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ ইসলামের প্রাথমিক যুগে বিভিন্ন যুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন। তিনি কখনও কোনো যুদ্ধে পরাজিত হননি। তিনি চরম নৈপুণ্যের সাথে যুদ্ধ করে মুসলিম বাহিনীকে চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে ইসলামের গৌরব বৃদ্ধি করেন। তার অসাধারণ বীরত্বের কাহিনি ইসলামের ইতিহাসে চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে।

খালিদ বিন ওয়ালিদ : নিম্নে খালিদ বিন ওয়ালিদ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

১. জন্ম ও প্রাথমিক পরিচয় : 

খালিদ বিন ওয়ালিদ মক্কার কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ওয়ালিদ । তিনি প্রাথমিক যুগে ইসলামের ঘোরবিরোধী ছিলেন। তার সাহসিকতা ও দক্ষতার কারণে ওহুদ প্রান্তরে মুসলমানদের সাময়িক বিপর্যয় ঘটেছিল ।

২. ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ :

সত্যান্বেষী খালিদ হুদায়বিয়া সন্ধির পর আমর বিন আল আসের সাথে মদিনায় গমন করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ইসলামের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন ।

৩. বিভিন্ন যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন :

ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর থেকে খালিদ বিন ওয়ালিদ বিভিন্ন যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করেন। ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে মৃতার যুদ্ধে তার বীরত্বের কারণে মহানবি (সা.) তাকে সাইফুল্লাহ বা আল্লাহর তরবারি উপাধিতে ভূষিত করেন। হযরত আবু বকর (রা.)-এর শাসনামলে তিনি ভণ্ড নবি ও স্বধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে ইসলামকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি উলিসের যুদ্ধে পারসিকদের পরাজিত করে হিরা দখল করেন এবং ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে রোমানদের পরাজিত করে দামেস্ক, হিমস প্রভৃতি স্থান দখল করেন। হযরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে খালিদ রোমান বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেন এবং সমগ্র সিরিয়া দখল করেন।

৪. সিরিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত : 

খালিদ বিন ওয়ালিদ সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে দামেস্ক, হিমস, হামা প্রভৃতি শহর দখল করলে ওমর (রা.) তাকে সিরিয়ার শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করেন। তিনি এ অঞ্চলে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে সুশাসক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।

৫. পদচ্যুতি :

খালিদ বিন ওয়ালিদের জনপ্রিয়তা ও শৌর্য বীর্যের কারণে জনগণ তাকে দেবতাজ্ঞানে শ্রদ্ধা করতে থাকে। তাদের ধারণা হয়েছিল প্রথম যুগে ইসলামের বিস্তৃতি খালিদ বিন ওয়ালিদের বীরত্বের কারণেই হয়েছিল । জনগণের এ ভুল ধারণা, খালেদের নির্মম ব্যবহার ও অর্থ অপচয়ের জন্য হযরত ওমর (রা.) তাকে পদচ্যুত করেন ।

৬. মৃত্যু : 

খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)-এর জীবনের শেষের দিনগুলো অত্যন্ত দীনহীনভাবে কাটে । ইসলামের এ মহান বীর ও সাহসী সৈনিক ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন ।

উপসংহার : 

পরিশেষে বলা যায় যে, ইসলামের ইতিহাসে খালিদ বিন ওয়ালিদের অবদান চিরভাস্বর । তিনি ইসলামের চরম দুর্দিনে অসীম সাহসিকতা ও বিরল বীরত্ব প্রদর্শন করেন। ইসলামের প্রয়োজনে যেকোনো ত্যাগ-তিতিক্ষা গ্রহণে তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন । খালিদ বিন ওয়ালিদ নিঃসন্দেহে সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর ও সেনানায়ক ছিলেন।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post